সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে হাইটেক পার্ক : সফল করার উপায়

ইঞ্জিনিয়ার আবুবকর হানিপ

বাংলাদেশে হাইটেক পার্ক : সফল করার উপায়

বাংলাদেশে ২৮টি হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি (বিএইচটিপিএ) গঠন করা হয়েছে আগেই, আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, সিলেট হাইটেক প্রজেক্ট, বঙ্গবন্ধু হাইটেক প্রজেক্ট রাজশাহী, শেখ কামাল হাইটেক পার্ক এবং ইনকিউবেশন সেন্টারসহ বেশ কিছু প্রকল্প অন্যতম। লক্ষ্য ২০২৫ সাল নাগাদ ‘চতুর্থ বিপ্লব’ নামের এই নতুন ডিজিটাল বিপ্লব থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা। ২০১৭ সালে যেটা সর্বসাকুল্যে ছিল ৮০০ মিলিয়ন ডলার। তার অর্থ হলো এ ৬ বছরের মধ্যে আয় ৬ গুণ বাড়ানো। সেটা কি রাতারাতিই সম্ভব? নাকি এ আইটি পার্কগুলোকে সফলভাবে দাঁড় করানোর জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে?

যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের একজন আইটি উদ্যোক্তা হিসেবে আমার নিজস্ব ভাবনায় বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি এবং ভারতে আইটি অফিস থাকার সুবাদে তাদের অগ্রযাত্রা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগও হচ্ছে আমার প্রতিনিয়ত। সে সব বিষয় কিছুটা তুলে ধরতে চাই আপনাদের সামনে।

হাইটেক পার্ক কী : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে সারা বিশ্বের যে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক, সেখানে থেকে আয় বাড়ানোর জন্য, বিশেষায়িত এলাকা বা প্রতিষ্ঠান-এটাই হলো হাইটেক বা আইটি পার্ক। এটা কিছুটা ইপিজেড বা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের মতো, যেখানে বিশ্বের বড় বড় গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান বা রপ্তানিকারকরা বিশেষ সুবিধায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং সেই ব্যবস্থাপনায় গার্মেন্ট শিল্প পার্ক ধারণা ও পরিচালনায় বাংলাদেশ মোটামুটি সফল। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে ২টি অফিস (গুরগাঁও এবং নয়ডা) থাকার সুবাদে এবং যুক্তরাষ্ট্রে গত ১৫ বছর ধরে আইটি ট্রেনিং ও জব প্লেসমেন্টের কাজ করতে গিয়ে আইটি পার্ক সম্পর্কে নিবিড় জানাশোনার সুযোগ হয়েছে। সেখানে একটি সফল আইটি পার্কের জন্য, নানা প্রজাতির প্রযুক্তি সুবিধা, প্রযুক্তি সেবা ক্রেতা, প্রযুক্তি জনশক্তি, অর্থাৎ ভেন্ডর এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকিকিনির পরিবেশ, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প, প্রভৃতির একটি মিলনমেলা বা অনুকূল পরিবেশ আইটি পার্কের সফল হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে আমরা এ পার্কের ধারণা, হাইটেক পার্কের বেলায় কতটুকু নির্মাণ করতে পেরেছি বা পারছি।

ভারত কীভাবে আইটি বিপ্লবের সুবিধা নিচ্ছে?

২০১৭ সালের কথাই যদি আমরা ধরি তাহলে দেখব ভারত এ বছরে আইটি এবং প্রযুক্তি খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। ওই একই বছর আমরা করেছি ৮০০ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে যেটা ৫ বিলিয়নে উন্নীত করার কথা, সেটা কি এমনি এমনিই আসতে পারে?

ভারতের সুবিধা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী এর প্রযুক্তি দক্ষ জনশক্তির পরিচিতি। গার্মেন্টসে যেমন বাংলাদেশের পরিচিতি আছে, ভারতের পরিচিতি আইটি ক্ষেত্রে। সারা বিশ্বের যত আউট সোর্সিং বাণিজ্য তার সিংহভাগ এখন ভারতীয়দের দখলে। সেখানে উদীয়মান মার্কেট হিসেবে বাংলাদেশকে ইন্টারনেট জগতে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে কিছু বিষয় সামনে আনতে হবে। তার আগে দেখে নেই কীভাবে ভারত সেটি করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের যত ফরচুন ১০০ বা ফরচুন ৫০০ কোম্পানি আছে তাদের সামনের সারিতেই সিসকো, মাইক্রোসফট, আইবিএম এগুলো আছে। এসব ছোট বড় কোম্পানিগুলোর অনেকেই তাদের প্রজেক্ট অফিস স্থাপন করেছে ভারতে। কারণ একটাই, যুক্তরাষ্ট্রে যেই প্রযুক্তি কর্মীকে বছরে দেড় লাখ দুই লাখ ডলার বেতন দেওয়া লাগে, ভারতে এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ দিলেই চলে।

তবে, দক্ষকর্মীর এ সহজলভ্যতাই একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে ভারতের আইটি পার্কগুলো এসব ফরচুন কোম্পানিগুলোকে এক লোকেশনের মধ্যেই প্রযুক্তি জনশক্তির সঙ্গে সঙ্গে, অন্য শক্তিও জোগান দিতে পারছে। এখন বাংলাদেশে একটিও ফরচুন ১০০ বা ৫০০ কোম্পানিকে আমরা নিতে পারিনি। কারণ, আমাদের যতটুকুই দক্ষ জনশক্তি আছে সেটিও আমরা ভালোভাবে প্রচার করা শুরু করিনি এখনো। আমাদের এখন পর্যন্ত কার্যক্রম হলো, কম্পিউটার বিকিকিনি এবং পার্ক মানেই হলো আইটি প্রশিক্ষণ। যেখানে কেবল শিক্ষার্থীদের যাতায়াত। সেখানে আন্তর্জাতিক ভেন্ডর, ডেভেলপার, ভালো হোটেল, নিবিড় রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ এগুলোর ঘাটতি রয়েছে পরিকল্পনায়। মাইক্রোসফট কেন ভারতে? বাংলাদেশে নয় কেন? বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান যেমন গুগল, মাইক্রোসফট, সিসকো অথবা ওরাকল বা সমগোত্রীয় কোম্পানিগুলো তাদের প্রজেক্ট অফিস ভারতে নিয়েছে। এসব উদাহারণ ভারতের আইটি সার্ভিসকে বিশ্বব্যাপী বিক্রি করার জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আমরা যদি চাই, এসব কোম্পানিগুলো ভারতের পরিবর্তে বাংলাদেশে আসুক, তাহলে আগে প্রশ্ন করতে হবে কেন তারা বাংলাদেশে আসবে?

► আমরা কি তাদের জন্য ১০ বছর বা ২০ বছরের লোভনীয় ট্যাক্স মওকুফ করছি?

► তাদের কী সুবিধামতো জায়গায় জমি দিচ্ছি?

► তাদের অর্থের লেনদেনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক রেয়াত দিচ্ছি?

► তাদের সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা দুশ্চিন্তা দূর করছি।

► ২৪/৭ আইটি পার্ক এবং সংলগ্ন এলাকায় নির্বিঘ্ন কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছি? যেহেতু আমেরিকার সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সময় তফাত আছে ১০ ঘণ্টার।

► আইটি পার্কের আশপাশে বা অভ্যন্তরে আমরা কি বিশ্বমানের হোটেল, মানসম্মত রেস্টুরেন্ট, বিনোদন, হাইস্পিড ইন্টারনেট, বিরামহীন বিদ্যুৎ, যাতায়াত, নারী-পুরুষ কর্মীদের রাতে কাজ করার উপযোগী নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারছি?

সহজ বিষয় হলো, আমেরিকা বা গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে পণ্য বা সার্ভিস পেতে চায় এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শ্রম বা সেবার মূল্য ভারতে কিছু পরিমাণ বেশি হলেও তারা ভারতে থাকতেই বেশি পছন্দ করবে, কেননা, ভারতে প্রযুক্তি দক্ষতা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সেখানে বাংলাদেশ এখনো হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। এক্ষেত্রে একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট অফিস বাংলাদেশে নিতে হলে তাদের অভাবনীয় রেয়াত সুবিধা অফার করতে হবে। যেই প্রণোদনার আকর্ষণে তারা তাদের প্রজেক্ট নিয়ে আসবে বাংলাদেশে। যদি ফরচুন ১০০ বা ৫০০ কোম্পানি নাও যায়, তাহলে ফরচুন ১০০০ মানের কোম্পানিদেরকে টার্গেট করতে হবে। কেননা, দু-একটি কোম্পানিকে নিতে পারলে আরও প্রতিষ্ঠান তাদের অনুসরণ করতে পারবে।

কেন বড় প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট অফিস দরকার বাংলাদেশের আইটি পার্কে?

টেকনোলজি ট্রান্সফার : এটাই হওয়া উচিত সবচেয়ে বড় যুক্তি। ধরুন, মাইক্রোসফট একটি প্রজেক্ট অফিস করল বাংলাদেশের কোনো এক আইটি পার্কে। তো, সেখানে প্রজেক্ট করা মানেই হলো, স্থানীয়ভাবে লোক নিয়োগ দেওয়া। দেখা গেল নির্ধারিত প্রজেক্ট শেষের পরে যদি প্রতিষ্ঠান সে জায়গা ত্যাগও করে, অথবা ওই প্রকল্প যদি শেষও হয়ে যায়, সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা একটি দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা অর্জন করল। এ অভিজ্ঞতা তারা অন্যখানে বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্যোগে সফল ভাবে সংযোজন করতে পারে। এ সুযোগটুকুও করে দিতে হবে আমাদের প্রযুক্তি শিক্ষার্থী বা যারা উদ্যোক্তা তাদের।

বিদেশি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন : ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের টার্গেট অনুযায়ী প্রযুক্তি খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে, কেবল দেশীয় ছেলে-মেয়েদের ফাইভআর, কিংবা আপওয়ার্কে কাজ করলেই চলবে না। বরং, বৃহাদাকারের সফটওয়্যার রপ্তানি, জনশক্তি রপ্তানি, আইটি সল্যুশন রপ্তানি করতে হবে। সফটওয়্যার, আইওটি সামগ্রীর উৎপাদন দেশীয়ভাবেই করতে হবে এবং সেগুলো রপ্তানি থেকেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। না হলে এ পরিসংখ্যানগুলো কেবলই বাগাড়ম্বর হিসেবে পরিচিতি পাবে।

চতুর্থ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা : গার্মেন্টস শিল্প বিপ্লব হয়েছে বহু বছর আগেই। নানা প্রতিকূলতায় এখনো বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। এ পোশাক শিল্প এবং সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি বা প্রবাসী শ্রমিকরাই দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু সময়ের আবর্তনে এ দুই অর্থনৈতিক খাতের ওপর অধিক নির্ভরতা কমানোর পথে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে চতুর্থ স্তম্ভ বা প্রযুক্তি বিপ্লব। সেই প্রযুক্তি বিপ্লবের জন্যেই বাইরের ফরচুন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে নিয়ে আনা দরকার যেমনিভাবে বাইরের গার্মেন্টস শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজ করছে বাংলাদেশে।

হাইটেক পার্কে বড় কোম্পানিকে নেওয়ার জন্য কী কী করতে হবে?

১. মার্কেটিং : বিশ্বমার্কেটে চীন তাদের যাত্রা শুরু করেছে ১৯৯০ সালের পর থেকে। এখন সারা বিশ্বই জানে, কম দামে আধুনিক প্রযুক্তির সেরা মার্কেট চীন। কিন্তু সেই পরিচিতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত কি করণীয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের চেষ্টায় বা ইচ্ছায় কি যাবে সেখানে? নাকি এখানে জোরালো মার্কেটিং একটি বড় বিষয়?

এ মার্কেটিং করবে কারা? অবশ্যই প্রাথমিকভাবে সরকার। দ্বিতীয় ভাগে বাংলাদেশের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো, কিন্তু সেখানেও সরকারি অবকাঠামোর সুবিধা তাদের দরকার। কীভাবে? সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে বলছি কীভাবে সরকার এ মার্কেটিংটি করতে পারে।

দূতাবাসের মাধ্যমে : যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে যিনি ইকোনমিক মিনিস্টার আছেন বা কমার্শিয়াল কাউন্সিলর আছেন তারা নানা ফরচুন কোম্পানিগুলোকে পরিদর্শনে যেতে পারেন নিয়ম করে। সেখানে বাংলাদেশের আইটি পার্ক, দক্ষ জনশক্তি বা অন্য যেসব সুবিধা প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে বা সুযোগ আছে সেগুলোর প্রচারপত্র নিয়মিত সরবরাহ করতে পারেন। এর বাইরে নিয়মিত সেমিনার, ট্রেড শো অথবা রোড শোর ব্যবস্থা করে ফরচুন কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের দাওয়াত করতে পারে দূতাবাস। সেখানে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আইটি প্রতিষ্ঠান বা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবের বিনিয়ম করার ব্যবস্থা করা। শুধু তাই নয়, দূতাবাসের কমার্শিয়াল উইং এসব কোম্পানির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ফলোআপ মিটিং করার ব্যবস্থা করা। কেননা, একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিয়মিত ফরচুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগ অনেক সময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের মধ্যস্থতা থাকলে ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের পথ অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। এ কাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্র তো নয় বরং ইউরোপের অন্য দেশ অথবা এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতেও করা যেতে পারে।

► কনসাল্টেন্ট নিয়োগ : দূতাবাসের যেহেতু অনেক রকম কাজ করতে হয়, সেহেতু আইটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে হাজারো প্রতিষ্ঠান ভারতীয় দূতাবাস এবং এককভাবে নিজেরাও দূতাবাসের মাধ্যমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। তারা ভারতের প্রযুক্তি সক্ষমতাকে আমেরিকার বাজারে নিয়মিত তুলে ধরার কাজ করছে নানা ভাবে। কখনো সেমিনার, কখনো বড় আয়োজন, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার, কখনো বা রোড শো বা ফেয়ার আয়োজন করে। বাংলাদেশের হাইটেক পার্ক বা প্রযুক্তি সক্ষমতাকে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো বিপণন চোখে পড়ার মতো নয়, অথবা একেবারেই নেই।

► দূতাবাসের অবকাঠামো কাজে লাগানো : এর অর্থ হলো, দূতাবাসকে লিয়াজোঁ করার কাজে লাগানো। আপনারা দেখে থাকবেন আমেরিকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা যখন বাংলাদেশে যায়, বাংলাদেশের সরকার বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করার ব্যবস্থা করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দূতাবাস। ধরুন, বাংলাদেশের ডেটাসফট, তারা নিজেরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজের জন্য অ্যাপ্রোচ করতে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে পেতে যে বেগ পেতে হবে, যদি দূতাবাস থেকে কোনো ফোন করে অথবা দাওয়াত দেওয়া হয় ওই একই প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে, তার সঙ্গে ডেটাসফটের মিটিং হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি সৃষ্টি হয়। সে কারণে আটটি পার্ক সফল করতে হলে দূতাবাসের অবকাঠামো কাজে লাগাতে হবে। মূলকথা হলো, এ বিষয়ে যদি বাংলাদেশ তার দক্ষতা প্রচার করতে চায়, অথবা ২/৪টি বড় কোম্পানিকে বাংলাদেশে নিতে চায় তাহলে উডপেকার বা কাঠঠোকরার মতো লেগে থাকতে হবে।

বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করা : প্রতিটি বড় বিনিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুই ধরনের নীতির বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান ঘোষণা থাকা উচিত। এক. অ্যান্ট্রি ক্রাইটেরিয়া বা সূচনার সময়কার চুক্তির শর্ত আর দুই. এক্সিট ক্রাইটেরিয়া বা বেরিয়ে যাওয়ার সময়কার শর্তাবলি।

অনেক সময় দেখা যায়, শর্তাবলির অনেক কিছুই পরিষ্কার থাকে না। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক শর্তে বিনিয়োগ করলেও পরে অন্য বিষয়াবলি সামনে চলে আসে যা তাদের হতচকিত করে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিনিয়োগ করে, তার বিনিয়োগের লভ্যাংশ সহজ শর্তে সে ফেরত নিতে পারবে কিনা, এসব বিষয়াবলিতে পরিষ্কার আইনি ঘোষণা থাকা প্রয়োজন। কেননা, এর ওপরে নির্ভর করে বিনিয়োগ সম্পর্কিত সুনাম। এ সুনাম বা দুর্নামই বিদেশি বিনিয়োগের পথে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এ জন্য ওয়ালস্ট্রিটসহ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আলাদা দফতরকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

আমি বলছিলাম বড় কোম্পানিকে বাংলাদেশে টানতে হলে কিছু লোভনীয় প্রণোদনা দেওয়ার কথা। কিন্তু মাঠপর্যায়ে অনেক সময় উল্টোচিত্র দেখা যায়। অনেক সময় বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে চাইলেও, স্থানীয় পর্যায়ে, রাজনৈতিকভাবে অথবা প্রশাসনের ক্ষমতাধরদের তরফ থেকে ব্যবসার ভাগ চাওয়া হয়। অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দাবি করা হয়। তাতে শুরুতেই বিগড়ে যান বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। এক্ষেত্রে এ দুর্নীতির মূলোৎপাটন করাটা একটা বড় কাজ।

কোর্স কারিকুলামকে আধুনীকিকরণ : বাংলাদেশে প্রতি বছর লক্ষাধিক ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থীরা বের হচ্ছে তাদের পড়াশোনা কেবল পাঠ্য বই কেন্দ্রিক। এসব শিক্ষার্থীকে হাতে কলমে কাজের উপযোগী করতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কম্পিউটার সায়েন্স বা আইটি  পড়াশোনায়  মূল কোর্সের সঙ্গে অ ই ঈ উ কোর্সের প্রবর্তন জরুরি।

A= Artificial Intelligence (Robotics, Machine Learning , IoT etc.)

B = Block Chain

C= Cyber Security

D= Data Analytics ( Big Data)

আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ব মার্কেট প্রতিযোগিতামূলক সার্ভিস কিনতে চায় সেটা সত্য, তবে তার চেয়ে বড় সত্য হলো তারা কাজ বা সার্ভিসের কোয়ালিটি ঠিক রেখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ডেলিভারি চায়। সে কারণে বিজনেস এথিক্স, এবং বিজনেস ইংলিশসহ অন্য বিষয়গুলো এসব পড়াশোনায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। TTT= Train The Trainers

যারা প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তাদের উপরোক্ত কোর্স কারিকুলাম বিষয়ে সম্যক প্রশিক্ষণের সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য, প্রযুক্তি বদলের ধরন ইত্যাদি সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেন তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকতে পারেন এবং তাদের শিক্ষার্থীদের সময়ের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। রিলায়াবেল কানেক্টিভিটি, রিলায়েবল ওয়ার্কফোর্স এবং রিলায়েবল কমিউনিকেশন : এ বিষয়গুলো যদি আমরা প্রতিষ্ঠা না করতে পারি তাহলে একই সুবিধা নিয়ে বিদেশি উদ্যোক্তা বা ফরচুন প্রতিষ্ঠানগুলো বরং চীন, ভারত ও হংকং-এ যাবে। একটি ফরচুন প্রতিষ্ঠান যদি এখানে বিনিয়োগ করে তাকে যদি যোগ্য কর্মী আবার বিদেশ থেকে নিয়োগ দিতে হবে, তাহলে তারা কেন আসবে? সুতরাং দক্ষ জনশক্তি বড় বড় কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশে আসার পেছনে একটি বড় নিয়ামক। এর বাইরে আরও যেসব বিষয় মনে রাখা দরকার সেগুলো নিম্নরূপ :

লোকাল ইন্ডাস্ট্রি ফোকাস : আপাতত বড় বড় কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের প্রকল্প বা প্রজেক্ট অফিস তৈরির আগে, স্থানীয়ভাবে এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাজের সুযোগ দিতে হবে। যেমন বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রণালয় বা প্রকল্পের আইটি ম্যানেজমেন্টে আমরা দেখি বিদেশি ফার্মকে তারা সুযোগ দেন বেশি। এতে করে বিদেশিরা, তাদের নিজেদের লোকজনকে নিয়োগ দিয়ে নিজেরাই টাকা পয়সা নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা সত্য যে টেন্ডারের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে না আনলে দেশে প্রযুক্তি জ্ঞানের বিস্তার ঘটবে না। তবে টেন্ডারের সময় স্থানীয় এজেন্ট বা মধ্যস্থতাকারী কোম্পানিগুলোর জন্য শতকরা ভাগে দেশীয় ছেলেমেয়েকে নিয়োগ দেওয়ার শর্ত থাকা উচিত।

বাংলাদেশে দেশীয় ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে ইউনিভার্সিটিগুলোর যোগাযোগ একেবারেই নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশের শিল্প বিকাশ, অবকাঠামো উন্নয়নের প্রযুক্তিতে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকা দরকার ছিল।

তাতে করে একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ হারাচ্ছে। মনে রাখতে হবে দেশীয়ভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নিজেদের প্রজেক্ট পরিচালনার মাধ্যমে ভুল ত্রুটি শোধরানোর সুযোগ না পায় তবে তারা আমেরিকা বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে নিজদের গ্লোবাল কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ অর্জন করবে না। এক্ষেত্রে আইটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতের ইনফোসিস, উইপ্রো, টিসিএস, টেশমাহিন্দ্রাসহ বেশ কিছু ফার্মের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তারা নিজেদের দেশে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলো দেখিয়েই এখন আমেরিকাসহ ইউরোপের নানা দেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করছে। চতুর্থ বিপ্লব করতে হলে শুধু দক্ষ জনশক্তি দিয়ে হবে না, দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিলে, তারাই বাণিজ্য নিয়ে আসবে দেশের জন্য।

ঋণ প্রদানে শিথিলতা : আমাকে প্রায়শই আমার ছাত্ররা বাংলাদেশে অভিযোগ করেন সরকারি স্বল্প শর্তের ঋণ তাদের বেলায় জোটে না। একটি গার্মেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সহজেই ঋণ পাওয়া যায়, কিন্তু একটি আইটি শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কোথাও টাকা চেয়ে পাওয়া যায় না। আইটিকে চতুর্থ স্তম্ভে রূপ দিতে হলে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে, নিয়ম এবং অগ্রাধিকার এসব বিষয়ে যুগান্তকারী নীতি অবলম্বন করতে হবে।

এর বাইরে, আমাদের নানা রকম নিরাপত্তা সূচকে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক স্থিরতা, নিরাপত্তা, ইন্টারনেট বা ডাটা নিরাপত্তা, ব্যাংকিং নিরাপত্তা সেই বিষয়ে যত আন্তর্জাতিক সূচক আছে, সেগুলোতে ক্রমাগত উন্নতি ঘটাতে হবে। এসব বিষয়ে দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিকতার অবসান ঘটানো গেলেই কাক্সিক্ষত চতুর্থ স্তম্ভ খুব ভালোভাবেই সম্ভব।

পরিশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্লোগান আমাদের তরুণ প্রজন্ম, উদ্যোক্তা ও পরিকল্পনাকারীদের মনোজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় গ্রামের সাধারণ একজন ব্যবসায়ীও এখন আইটি ব্যবসায় নাম লেখাচ্ছেন বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছেন। এটাই মাইন্ডসেট বা মনোজগতের পরিবর্তন। এই পরিবর্তন সূচিত করার মূল স্থপতি হিসেবে পেছন থেকে কাজ করছেন প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। আর বিশ্বস্ত সেনাপতির মতো প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সেটির বাস্তবায়নে দিনান্ত পরিশ্রম করছেন। এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চতুর্থ একটি স্তম্ভ যোগ করা। কেননা, এখন পর্যন্ত কৃষি, গার্মেন্ট আর রেমিট্যান্স এই তিন স্তম্ভেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি অর্জনের পথে আমাদের দরকার আরও একটি স্তম্ভ। চতুর্থ বিপ্লবের যুগে এই চতুর্থ স্তম্ভের সফল হওয়াটা এখন সময়ের দাবি। সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। হাইটেক পার্কগুলো চতুর্থ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিপ্লব ঘটাতে পারলেই উন্নত বিশ্বের কাতারে স্বগৌরবে উড়বে বাংলার লাল সবুজ পতাকা।

লেখক : প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা, পিপলএনটেক।

সর্বশেষ খবর