সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পরিকল্পিত নগরায়ণ প্রসঙ্গে

মোশাররফ হোসেন মুসা

কথাটি সাধারণ হলেও তাৎপর্য ব্যাপক; তা হলো- গ্রামের উন্নয়ন হওয়া মানেই নগর হয়ে যাওয়া। প্রতিটি সরকার গ্রামের উন্নয়নের জন্য সাধারণ প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি নতুন প্রকল্পও গ্রহণ করে থাকে। সে জন্য ‘সিডিএলজি’ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে আমরা চাই কিংবা না-ই চাই, ২০৫০ সালের মধ্যে সমগ্র দেশের মানুষ নগরীয় সুবিধা নিয়ে বসবাস করবে। নগর হবে স্থায়ী সভ্যতা। যেটি দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেটার জন্য মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সরকার কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের মুখে উপযুক্ত পরিকল্পনার কথা শোনা যায় না। বর্তমান সরকারের ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ প্রকল্পটিও গতানুতিক চিন্তার বাইরে নতুন কোনো বিষয় নয়। মুঘল আমলে বাংলাদেশ পুরোপুরি গ্রামীণ অবস্থায় ছিল। ব্রিটিশ আমলেও এদেশের সামগ্রিক অবস্থা গ্রামনির্ভর ছিল। তবে ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসন পরিচালনার স্বার্থে অফিস-আদালত, বাসস্থান, সৈনিকদের দুর্গ নির্মাণ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে কয়েকটি শহর এলাকার (পৌরসভার) জন্ম দেয়। সেসব এলাকায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী এবং শর্ত সাপেক্ষে অনুগত ধনী ব্যক্তিরাই শুধু বসবাসের সুযোগ পেতেন। তাদের কাছে ছিল শহর মানে কৃষিমুক্ত এলাকা। সে ধারা এখনো বজায় রয়েছে। অর্থাৎ পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে গ্রামীণ-নগরীয় মানসিকতা নিয়ে নগরায়ণের চিন্তা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫-৭% লোক নগরে বসবাস করত। সে কারণে গ্রামের কৃষকের সন্তানেরাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন বেশি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল ব্যবস্থা, জিয়ার ১৯ দফা, এরশাদের ১৮ দফা সবই ছিল গ্রামের উন্নয়নকে সামনে করে। এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় এসে স্লোগান দেনÑ ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে (অর্থাৎ তার মতে শহরের লোকেরা কিছু করে না)। যদিও সে সময় গ্রামের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৬ হাজার। তিনি এ স্লোগান দিয়ে পল্লীবন্ধু উপাধি লাভ করেন। আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ এক ভাষণে বলেন, ‘প্রতি গ্রামে যৌথ চাষ হবে এবং ফসলের ভাগ যাবে মালিক, শ্রমিক ও গ্রাম তহবিল তিন জায়গায়।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেনÑ ‘গ্রামকেই করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু।’ আবার পৌরসভা অধ্যাদেশ ১৯৭৭ অনুযায়ী একটি গ্রামীণ ইউনিটকে পৌরসভা ঘোষণা দেওয়ার আগে যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে, তাহলোÑ (১) এলাকার জনসংখ্যা কমপক্ষে ১৫ হাজার হতে হবে; (২) প্রতি বর্গমাইলে ২ হাজার অধিবাসী হতে হবে এবং (৩) তিন-চতুর্থাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক জনসংখ্যাকে অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকতে হবে। পৌরসভা অধ্যাদেশ, ২০০৯-তে কিছুটা পরিবর্তন করে বলা হয়; (১) এলাকার জনসংখ্যা ৫০ হাজারের কম হবে না; (২) প্রতি বর্গ কি.মিতে জনসংখ্যা ১ হাজার ৫০০-এর কম হবে না; (৩) এলাকার তিন-চতুর্থাংশ ব্যক্তি অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকতে হবে; এবং (৪) এলাকার শতকরা ৩৩ ভাগ ভূমি অকৃষি প্রকৃতির হতে হবে। মজার বিষয় হলোÑ বর্তমান নতুন নতুন পৌরসভাগুলোর কোনোটাই উপরিউক্ত শর্ত পূরণ করে গঠিত হয়নি। বেশিরভাগ গঠিত হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তার মধ্যে এক নম্বরেই রয়েছে- ‘আমার গ্রাম আমার শহর’। এর সূত্র ধরে প্রতিটি ইউনিয়নের একটি গ্রামকে ‘মডেল ভিলেজ’ নামে ঘোষণা করা হয়েছে। এলজিআরডি মন্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ বিষয়ে ইতিমধ্যে দেশব্যাপী প্রতিটি গ্রামে উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্রামীণ হাটবাজার, গ্রামপর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা ইত্যাদিকে একটি পরিকল্পনার মধ্যে আনার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা শুরু হয়েছে। এর আগে কৃষিজমি রক্ষার জন্য সরকার প্রতিটি উপজেলায় একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে সভাপতি এবং উপজেলা প্রকৌশলী, কৃষি অফিসার, একজন স্থাপত্যবিদ, একজন পরিকল্পনাবিদকে সদস্য করা হয়। বলা হয় নতুন করে কোনো বিল্ডিং করার আগে এই কমিটির অনুমতি নিতে হবে। সরকারের উপরিউক্ত বিষয়গুলো আমলাতন্ত্রের রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া কিছুই নয়। একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবেÑ গ্রামীণ এলাকায় কোনো রাস্তার প্রয়োজন হলে চেয়ারম্যান-মেম্বরের কাছে তালিকা চাওয়া হয়। সেই মোতাবেক স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (কার্যত কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ) এস্টিমেট তৈরি করে রাস্তা নির্মাণ শুরু করে। ফলে সেসব রাস্তা নির্মাণের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কোনো সম্পর্ক থাকে না। বলা যায়, এর সঙ্গে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয় জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে সরকারি দলের তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সভা-সেমিনার এবং কারোর সঙ্গে মতবিনিময় করতে দেখা যায় না। ফলে জনগণের গ্রামীণ-নগরীয় মানসিকতা দূর হচ্ছে না। এক ধরনের গ্রাম্য মানসিকতা নিয়ে তারা নগরে বসবাস করছে। ‘সিডিএলজি’ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে নগরীয় সংস্কৃতি, নগরীয় খাদ্যাভ্যাস, নগরীয় পরিবেশ, নগরীয় শিক্ষা, নগরীয় কৃষি, নগরীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা ইত্যাদি মানস জগতে নিয়ে আসতে হলে সমগ্র সরকার ব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে। সরকার হবে দুই প্রকারের; কেন্দ্রীয় সরকার আর স্থানীয় সরকার। স্থানীয় সরকারের স্তর বিন্যাস করে নামকরণ ও প্রকারভেদকরণ ঠিক করতে হবে। ইউনিয়নকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তর এবং জেলাকে গ্রামীণ ও নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকারকে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিটি ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিতে হবে। যেমন, ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার, উপজেলা সরকার (যদি এর প্রয়োজনীয়তা থাকে) এবং জেলা সরকার। অর্থাৎ পরিকল্পিত নগরীয় বাংলাদেশ গড়তে হলে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে অবশ্যই বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবী, বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

সর্বশেষ খবর