মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ডেঙ্গু-জীবাণুবাহী এডিস মশার কামড় যে কত ভয়ানক হতে পারে তা ইতিমধ্যে আমরা অবগত। এই মশার দুটি প্রজাতি (এডিস অ্যাজিপটাই ও এডিস অ্যালবপিকটাস) মূলত ডেঙ্গু-ভাইরাস ছড়ায়। যারা একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তারাই বুঝেছেন কি বাজে ও ভয়ানক যন্ত্রণা। জুন, ২০১৯ থেকে এডিস মশা নিয়ে আমরা কমবেশি সবাই আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি। ধীরে ধীরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমতে থাকলেও এই আতঙ্ক এখনো বিরাজমান। সাধারণ থেকে বিশেষ, সবার অভিজ্ঞতাই ছিল বেশ তিক্ত। প্রায় দুই দশক ধরে এডিস মশা আমাদের জন্য সমস্যা হলেও এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব পেছনের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বলা যায়, এডিস মশা ও ডেঙ্গু ভাইরাসের কাছে আমরা একপ্রকার পরাজিত। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে আমরা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (এডিস মশাবাহক) দ্বারা ব্যাপক সংক্রমিত হয়েছিলাম। এক বছরের ব্যবধানে ডেঙ্গু ভাইরাস যে এভাবে ছড়াতে পারে তা ছিল সবার ধারণার বাইরে। এডিস মশা বা ডেঙ্গু রোগ শুধু আমাদের বাংলাদেশেই সমস্যা নয়, বরং বিশ্বের ১২৫টি দেশে এ সমস্যা আছে। পৃথিবীর ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ এডিস মশা বা ডেঙ্গু রোগের রিস্কের মধ্যে বসবাস করছে এবং প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোক শুধু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু অংশ, অস্ট্রেলিয়ায়ও এর প্রকোপ রয়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ এখন মারাত্মক ডেঙ্গুপ্রবণ। এ বছর ফিলিপাইনে ডেঙ্গু রোগকে মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে।  ১. বিগত দু-তিন বছর যাবৎ ‘এল নিনো’র প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশসহ সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে (বিশেষ করে দ্বীপবেষ্টিত বা দ্বীপতীরবর্তী) অতিখরা, অতিবৃষ্টি, অতিবন্যা ও অস্বাভাবিক তাপমাত্রা (স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি) বৃদ্ধির নজির স্থাপিত হয়েছে। তাই এসব অঞ্চলে মশাবাহিত রোগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে এবং দেশগুলোয় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায়ই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এল নিনোর প্রভাব দ্বীপবেষ্টিত (ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড) বা দ্বীপতীরবর্তী দেশগুলোয় অপেক্ষাকৃত বেশি। ২. ডেঙ্গুর প্রতিষেধক ‘ডেঙ্গভেক্সিয়া’র আবিষ্কার ও অনুমোদনের পর এটা খুব আশার আলো জুগিয়েছিল এবং মনে করা হয়েছিল এটা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের হার ও মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে কমাতে সাহায্য করবে। কিন্তু ২০১৭ সালে ফিলিপাইনে ব্যাপক ব্যবহারের (প্রায় ৮ লাখ মানুষের ওপর) পর ভ্যাকসিনটি বিতর্কের (অনেক শিশু মারা যাওয়ায়) জন্ম দেয়। তাই এই ভ্যাকসিনের ওপর এখন অনেক দেশই পুরোপুরি নির্ভর করতে পারছে না। সম্প্রতি ফিলিপাইনে এই ভ্যাকসিনের পুনরায় ব্যবহারে মানুষকে অনীহা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। উল্লেখ্য, ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্যানেফি পাস্তর’ ডেঙ্গুর এই ভ্যাকসিনটি তৈরির পর ২০১৬ সালের দিকে এটি মানবদেহে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পায়। তবে এটি ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। বিজ্ঞানীরা এখন আরও কার্যকর নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

৩. এডিসসহ অন্য মশাদের কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে ওঠা। সবার একই অভিযোগ, কীটনাশকে মশারা এখন আর মরে না। কীটনাশক প্রয়োগ করলে মশা পালিয়ে যায়, কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। বছরের পর বছর একই কীটনাশকের ব্যবহার (একই কার্যধরন হওয়ায়), মাত্রাতিরিক্ত বা ভুল ডোজ প্রয়োগে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে কীটনাশক প্রতিরোধী হওয়ার। প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্য দেহের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে প্রধানত সাইটোক্রোম পি-৪৫০ মনোঅক্সিজিনেজ এনজাইম তথা পি-৪৫০ জিনকে (কীটনাশক প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে চরম প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কীটনাশক দিয়ে এদের আর সহজে দমন করা যায় না।

৪. মশা নিয়ন্ত্রণে নতুন প্রযুক্তি তথা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল যেমন ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যাহত করে), স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে কিন্তু ডিম উৎপাদন হবে না), জেনেটিক্যালি মডিফাইড মশার ব্যবহার, মশক প্রিডেটরস (মশক মাছ : গাপ্পি, গ্যামবুসিয়া) ইত্যাদির কথা বেশ বলা হয়। মনে করা হয় এরা মশা নিধনে কীটনাশকের (অ্যাডালটিসাইড ও লার্ভিসাইড) উত্তম বিকল্প হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সময় ও কার্যকারিতা বিবেচনায় এসব বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল পদ্ধতির ব্যাপক বা বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

এসব ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে আমরা আধুনিক মশা নিধন পদ্ধতি ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা এখনো একটি সফল ও টেকসই মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের মশা নিধন কার্যক্রম মোটেও গবেষণানির্ভর নয়। মশার সার্ভিল্যান্স ডেটা আমাদের কাছে নেই যা মশা দমনে আমরা ব্যবহার করতে পারি। দেশে মশা নিয়ে যতটুকু গবেষণা হচ্ছে তার বেশির ভাগই ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদ্যোগে এবং তা প্রয়োজনের তুলনায় অতিনগণ্য। ফলে গবেষণালব্ধ কোনো ফল আমরা বাস্তবে কাজে লাগাতে পারছি না। আমরা কীটনাশক প্রয়োগ করছি কিন্তু মশা মরছে না। কেন মরছে না তার প্রকৃত কারণ আমাদের জানা নেই। তাই মশা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আগত বছরগুলোয় মশা আমাদের জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে আসতে পারে। সুতরাং এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের আরও বেশি জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক (ডেপুটেশন), কীটতত্ত্ব বিভাগ, পবিপ্রবি, বাংলাদেশ।

 

সর্বশেষ খবর