শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া আমাদের অঙ্গীকার

নূরে আলম সিদ্দিকী

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া আমাদের অঙ্গীকার

সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্র্রগ্রহণের বিষয়টি সবারই জানা। বিষয় দুটি প্রাকৃতিক এবং অল্পক্ষণের জন্য অবস্থান করে। কিন্তু গোটা পৃথিবীর পরিবেশকে লন্ডভন্ড করে দেয় না।

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, নির্যাতন-নিগ্রহ এমনকি স্বৈরাচারী শক্তির নিষ্ঠুর বুলেটকে অবলীলাক্রমে বুক পেতে গ্রহণ করে এ দেশের প্রান্তিক জনতা রাজপথে হেঁটেছে। শুধু হাঁটেনি, ভাষা থেকে স্বাধীনতা সবকিছুই তারা অর্জন করতে পেরেছে। পৃথিবীর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এটা শুধু গৌরবোজ্জ্বলই নয়, অনন্যসাধারণ এবং বিরল ঘটনা। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ ঘটনঅঘটনে পটীয়সী। রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতা আনল বটে, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই দেশটিই আবার দুর্নীতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে গেল। জাতিসংঘের বিশ্লেষণে দুর্নীতিতে ১৭তম স্থানে বাংলাদেশ অবস্থান করছে। এটা জাতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পথপরিক্রমণে যারা অক্লান্ত, অবিশ্রান্ত সৈনিক হিসেবে বিবেচিত, তারা এই অকল্পনীয় দুর্নীতির মর্মান্তিক দৃশ্যে একান্তভাবেই লজ্জিত ও বিস্ময়াভিভূত। আমার মুক্তির বিশেষত্ব হলো শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়, গোটা জাতি সামগ্রিকভাবে একযোগে অকুতোভয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিল, তারই স্রোতধারায় গোটা দেশকে একটি অদৃশ্য রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করেছে। পাকিস্তানি হিংস্র সেনাবাহিনীর মর্মান্তিক ও লজ্জাকর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে অস্ত্র কখনো ঐক্যবদ্ধ জনতার শানিত চিন্তাকে পরাজিত করতে পারে না। বরং অস্ত্রসর্বস্ব স্বৈরাচারী সামরিক শক্তিকে দাসখত লিখে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেই রক্ষা পেতে হয়। কিন্তু গোটা দেশটাই দুর্নীতির অতল গহ্বরে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে যাবে, রক্তস্নাত বাংলাদেশের এটা যেমন অস্বাভাবিক তেমনি বেদনাদায়কও বটে। আল্লাহর অশেষ রহমতে একটা দুর্ধর্ষ বর্বর সামরিক শক্তিকে আমরা পরাভূত করতে পেরেছি, ঠিক তেমনি একটা অজানা অভিশাপে আমরা দুর্নীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছি এবং গোটা জাতিই যেন দুর্নীতির সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এমন পর্যায়ে দেশটি এসে দাঁড়িয়েছে যে, সরকারপ্রধানের কথার চাইতে উৎকোচের মূল্য অনেক বেশি ও মূলত কার্যকর। একমাত্র মরা মানুষকে জীবন্ত করা ছাড়া উৎকোচে বাংলাদেশে অসম্ভব বলে কোনো কিছু নেই। সেখানেও ইদানীং এমনও কথা শোনা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো কোনো হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগী মৃত্যুবরণ করার পরও লাইফ সাপোর্ট অবমুক্ত করা হয় না অতিরিক্ত বিল আদায়ের লক্ষ্যে। ডাক্তারি পেশা, যেখানে দুস্থ মানবতার সেবার শপথ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পথচলা শুরু হয়। লাইফ সাপোর্টের নামে এহেন পাশবিক মানসিকতায় অর্থ উর্পাজনের এমন ঘৃণ্য প্রবণতা শুধুই ওই পেশাটির জন্যই অবমাননাকর নয়, জাতির জন্যও নিদারুণ লজ্জাকর। এই সংবাদের বিরুদ্ধে সবার আগে  চিকিৎসক ও চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্রছাত্রীদের রুদ্ররোষে বিস্ফোরিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের, দুর্ভাগা প্রান্তিক জনতার- এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো প্রতিবাদী পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি। এ যেন নিছক একটা সাদামাটা ঘটনা। বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বারান্দায় নিতান্ত অবহেলা ও উপেক্ষায় রোগীর মৃত্যুবরণের এবং আপনজনদের আহাজারির মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সচিত্র খবরের কাগজে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো দৃষ্টিগোচর প্রতিবিধানের বা দুষ্টচক্রের কারও কোনো শাস্তির খবর আমরা পাই না। আমি শতভাগ নিশ্চিত, এ রকম কোনো ঘটনা বিদেশে এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ঘটলেও তীব্র প্রতিবাদ হতো, তুলকালাম ঘটে যেত। সরকার পতন পর্যন্ত হয়ে যেতে পারত। ভুল চিকিৎসার ক্ষতিপূরণের বিধান এ দেশেও আছে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রে কেন? সব বিষয়ে সমীচীন ও যথাযোগ্য আইনের অভাব আমাদের দেশে নেই কিন্তু সে আইন কেবলই কাগজে-কলমে। এর প্রয়োগ হয় ক্ষমতার প্রভাব-প্রতিপত্তির ধার অনুযায়ী। প্রভাব-প্রতিপত্তির ধারভার না থাকলে লাশ বা মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার জন্য হাসপাতাল থেকে আনতে একটা মোটা ধরনের ঘুষ দিতে হয়। বিদেশিরা এসব কথায় এতটাই আশ্চর্যান্বিত হয় যে, সুস্থ লোকেরাই এসব ঘটনার প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অবাক হওয়ার বিষয় হলো এই, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে অ্যাম্বুলেন্সকে রাজপথে সাইড দেওয়া হয় না, সে যত জোরেই সাইরেন বাজাক না কেন, কারও কর্ণকুহরে সেই সাইরেনের শব্দ পৌঁছায় না। বরং অবলীলাক্রমে অ্যাম্বুলেন্সের পথরোধ করে রাখা হয়। এখানে ট্রাফিকরাও কোনো ভূমিকা পালন করেন না। অনেকে বলবেন যানজটের কারণে অ্যাম্বুলেন্সকে সাইড দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যানজট তো সৃষ্টিই হয় ট্রাফিক আইন অমান্যের কারণে। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো ক্ষমতা প্রদর্শনের এক উদগ্র প্রবণতা। আমি আইন মানব না অথচ কেউ আমাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করবে না বা করার সাহস রাখবে না- তবেই না আমি প্রভাবশালী! টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের বখরা থাকার মানেই হচ্ছে আমি প্রভাব ও প্রতাপশালী।

ভাবতে অবাক লাগে, একজন সন্ত্রাসীর মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর থাকে! জানি না, তাদের গডফাদারদের অবস্থান কত শীর্ষ শিখরে। সংবাদমাধ্যমে দেখি, প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। তার মধ্যে যতটুকু বিদেশে লগ্নি হয়েছে, সেটা বেদনাদায়ক। সোনার দামে পিতল কিনে সেসব লগ্নি করা হয়েছে। এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলে মানুষ শিউরে ওঠে। আবার কখনো কখনো কোনো কোনো দুষ্টচক্র সৃষ্টি হয় এ ধরনের অপকর্ম করে রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাধারণত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের এমনকি অবরুদ্ধ বা কারারুদ্ধ করারও বিপক্ষে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে জনবহুল অঞ্চলে দিন-সময় ঘোষণা করে সৌদি আরবের মতো অপরাধীদের শিরñেদের ব্যবস্থা করতে পারলে অপরাধের প্রবণতা অবশ্যই কমে আসত। বাংলাদেশের অপরাধের বিস্তৃতির অন্যতম একটি কারণ বিচারের বিলম্ব। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এটি স্বীকার করে প্রকাশ্য মতামত দিলেও সরকার নির্বিকার থাকে। আস্ফালন, লম্ফঝম্প যা-ই করুন না কেন, দুর্ধর্ষ অপরাধীদের শাস্তি হয় না বললেই চলে। দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী গ্রেফতার হলে এলাকায় একটা স্বস্তি নেমে আসে। ক্ষেত্রবিশেষ আনন্দ মিছিলও বের হয়। কিন্তু সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই অপরাধী জামিনে বেরিয়ে আসে এবং দোর্দ- প্রতাপে সমাজে বুক চিতিয়ে অবস্থান করে। পরিবর্তন একটা আসে বটে, তবে সেটা আরও হয় ভয়ঙ্কর। প্রথম দিকে অপরাধী ছিল একা, তার দুঃসাহস ও বেআইনি অস্ত্র ছিল তার সঙ্গী। জামিনে বেরিয়ে আসার পর সে ডন হয়ে যায় এবং রাতারাতি তার অনুগত একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে ওঠে। তিনি ভাই বা দাদা হয়ে যান। এক কাপ চা নিজের পয়সায় খেতে যার কষ্ট হতো, চুল কাটাতে তিনি সিঙ্গাপুরে যান। ছেলেমেয়ে, ভাইবোন ও নিকটাত্মীয়দের বিয়েশাদিতে তাদের অর্থজৌলুস প্রকাশের প্রবণতা এতই প্রকট হয় যে, তাকে যারা চেনে তারা বিস্মিত হয়, আশ্চর্যান্বিত হয়। অবাক হয়ে ভাবে- কোন আলাদিনের চেরাগ এমনভাবে তার কপাল খুলে দিল!

সম্রাট, খালিদ এবং জি কে শামীমের মতো সমাজবিরোধী সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা যখন বেড়ে উঠতে থাকেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সমস্যাটা আজকের মতো প্রকট হয়ে ওঠে না। অনেক সময় ক্ষমতাসীনরা এদের সযত্নলালিত্য প্রদান করেন একটি প্রত্যাশা মাথায় রেখে যে, দুঃসময়ে এরা হয়তো কাজে লাগবে। কিন্তু কাজে লাগা দূরে থাক, যেহেতু এরা ভোল পাল্টাতে পারদর্শী, তাই এদের ভূমিকা হয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো। এই ভয়াবহ সন্ত্রাসীদের শক্তির উৎস হলো- ক্ষেত্রবিশেষ রাজনীতির ঊর্ধ্বতন শক্তিধরদের সঙ্গে এদের গাঁটছড়া বাঁধা থাকে। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এরা যেমন রাতারাতি ভোল পাল্টান, রাজনীতিবিদরাও তেমনি বিভ্রান্ত মানসিকতায় এদের প্রশ্রয় দেন, কাছে টেনে নেন- সময়ে অসময়ে এদের ব্যবহার করা যাবে এই অলীক প্রত্যাশায়।

দুর্নীতির এই ভয়াবহ চিত্র যতটুকু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, সেটা বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও এত ভয়ঙ্কর তো হতোই না, মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগেই এর একটা প্রতিবিধান হয়ে যেত। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, কর্মজীবনের আরম্ভ যার যুবলীগের অফিসের পিয়ন হিসেবে, তিনি আজ অর্থবিত্তে এমন জায়গায় অবস্থান করছেন যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব এবং পুলিশের কিছু কর্তাব্যক্তিও যেন ওই ভাই বা দাদার পকেটে। সংবাদপত্রে দেখলাম, এক প্রকৌশলীকে জি কে শামীম ১১০০ কোটি টাকা এবং অন্য আরেকজনকে ৪০০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন একটি কাজ পাওয়ার জন্য। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা প্রশাসনের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আরও কত টাকা তিনি দিয়েছেন তা আল্লাহই মালুম। সমাজে পরগাছার মতো প্রায়ই এরা গজিয়ে ওঠে এবং সমাজের সমস্ত মৌলিক ও মানবিক মূল্যবোধকে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করে দেয়। এদের উত্থান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নয়। পদ বেচাকেনার যে প্রক্রিয়া ইদানীং নির্লজ্জভাবে শুরু হয়েছে, সে প্রক্রিয়ার বদৌলতে এসব ‘প্রতিভাবান(!)’ ব্যক্তি গজিয়ে ওঠে। উৎকোচ ও অর্থের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের কোনো না কোনো ব্যক্তিত্বকে কব্জা করে। এই যে খালিদ ও জি কে শামীম আজকে এত প্রকট হয়ে প্রতিভাত, তাদের হাতেখড়ি মির্জা আব্বাসের আনুকূল্যে। তখন তাদের অবস্থান এতটা প্রকট ও অপ্রতিরোধ্য ছিল না। বিএনপি নেতৃত্বের মোসাহেবি তারা করতেন বটে, কিন্তু দুর্নীতিতে তারা ছিঁচকে পর্যায়ের ছিলেন। আজকের মতো এতটা দাপুটে ও অর্থবিত্তে এমনকি উৎকোচ প্রদানে এত প্রতাপশালী ও প্রতিভাদীপ্ত ছিলেন না। এদের চালচলন, ওঠাবসা দেখলে মনে হয়, এরা বোধহয় একটি অদৃশ্য সরকার (রহারংরনষব মড়াবৎহসবহঃ) পরিচালনা করেন। ভুঁইফোঁড় এসব ব্যক্তির উত্থানে দেশবাসী তো বটেই তাদের পরিবারের সদস্যরাও চমকে ওঠেন। শাশুড়ি থেকে শুরু করে তারা লোক খুঁজতে থাকেন কার নামে টাকা গচ্ছিত রাখবেন। স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল অঙ্কের টাকা তারা নিজের নামে রাখতে পারেন না। তার কারণ উপার্জিত অর্থ কোনো জ্ঞাত সূত্রে সৎ ও স্বাভাবিক পন্থায় আসেনি। ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিল্পকারখানায় একেবারেই অবদানশূন্য এত টাকার মালিক যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি গোষ্ঠীকে এরা এখন এক পয়সার মূল্য দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন না এবং হিসাবেই ধরেন না। তা না হলে ডনের তত্ত্বাবধানে না থেকে এরা বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর ও সৎ শিল্পপতির সংস্পর্শে এসে ধীরে ধীরে সন্তর্পণে এগোতে পারতেন। তাতে তার শেষ পরিণতি কী হতো বলা যায় না কিন্তু টাকাগুলোর একটা সৎ দৃষ্টিগ্রাহ্য বিনিয়োগ হতো। দিশাহারা পাগলপ্রায় এবং বেপরোয়াভাবে যত্রতত্র বিদেশে টাকা পাচার করতে হতো না। সমজে ধিকৃত কালোবাজারি এবং কালো টাকার মালিক হিসেবে অপরাধী হয়ে থাকতে হতো না। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবীÑ দেশ, প্রশাসন, আইন এসবের কথা না হয় বাদই দিলাম। অসদুপায়ে অর্জিত কালো টাকার মালিকরা কীভাবে ভাবেন এই অর্থে তাদের সন্তানরা বেড়ে উঠবে, তাদের সন্তানরা সুনাগরিক হবে! শুনেছি এদের সন্তানদের একটা বিরাট অংশ মাদকাসক্ত হয়ে যায় এবং ব্যভিচারী হয়ে ওঠে। সমাজশৃঙ্খলাকে তো বটেই, পরিবারের অভিভাবকদেরও পরোয়া করে না। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি, টাকার একটা উত্তাপ আছে। সৎভাবে উপার্জিত অর্থও সুশৃঙ্খলভাবে খরচ করতে না পারলে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে ছাড়ে। আর সে ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্ম যদি জানে, অর্থের উৎসটি হারাম, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো লাগাম পরিবারের কারও হাতেই থাকে না। আমার স্থির বিশ্বাস, বেলা অনেক গড়িয়েছে, সমস্যাও অনেক প্রকট হয়েছে। তবু সমস্যা সমাধানের সময় একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। তাই সমস্যাটিকে পাশ না কাটিয়ে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে সমস্যা সমাধানের। সন্তানের আবদার মেটাতে অনেক ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকেও কোনো কোনো অভিভাবক অতিমূল্যবান গাড়ি এমনকি স্পোর্টস কারও কিনে দেন। এতে সন্তানটিকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণহীন করা হয় তা তারা ভেবে দেখেন না। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতীদের যে নিয়ন্ত্রণহীন চলাফেরা তা কালে কালে তাকে উচ্ছৃঙ্খল ও মাদকাসক্ত বানিয়ে ফেলে। এরা সম্রাট ও খালিদদের মাদক বিক্রয়ের বাজারে পরিণত হয়। হয়তো এরই মধ্যে কেউ কেউ তাদের শিষ্যত্বও বরণ করে। কোনো নিবন্ধ, সাধুবাদ বা বিনম্র চিত্তের আকুল আকুতি এই মারাত্মক উন্মাদনাকে স্তব্ধ করতে পারবে না। চরম বেদনাহত ও বিক্ষুব্ধ চিত্তে বলতেই হয়, দ্রুত বিচার আইনে বিচার করে দু-একটা দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি কার্যকর করা হলে এটা থমকে যেত, বন্ধ হতো। বোধকরি এই সরল সমীকরণটা সবাই বোঝে। কিন্তু এই বখে যাওয়া সন্তানদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটিই এসেছে অভিজাত শ্রেণি থেকে, আবার এই অভিজাত শ্রেণির অধিকাংশ অর্থই উপার্জিত অবৈধ ও অন্যায় পথে। একজন দায়িত্ববান অভিভাবক নিজ সন্তানের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখলে তারা শুরুতেই বুঝতে পারেন, তাদের সন্তানরা কোন পথে হাঁটছে। ছেলেদের চুলে ঝুঁটি করা, কানে দুল পরা- এগুলো সুনিশ্চিতভাবে বখে যাওয়ার নিদর্শন আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এসব প্রতিরোধ করতে আইন বা পুলিশের প্রয়োজন হয় না। পরিবার থেকে তীক্ষè সচেতনতাই এই ঊচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া কর্মকান্ড থেকে নিজ নিজ সন্তানদের ধরে রাখলে অনেকটাই প্রতিরোধ হয়ে যায়। তারুণ্যের এই উন্মাদনা ক্ষণস্থায়ী। আমি সুনিশ্চিত, বখে যাওয়া তারুণ্য একটা বয়সে এসে নিজেই অনুতপ্ত হয়। তাই বলি, ওই বিপজ্জনক উচ্ছ্বাসপ্রবণ তারুণ্যের প্রাক্কালে অভিভাবকরা সজাগ ও সচেতন থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে তার সন্তান যেমন বখে যাবে না, সমাজও তেমনি মূল্যবোধভিত্তিক ভিত্তির বিনির্মাণে যোগ্য কারিগর খুঁজে পাবে।

অনেক দেরিতে হলেও দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার জন্য জনগণ একটা বিরাট প্রত্যাশায় বুক বেঁেধ এটার শেষ দেখতে চান। মাঝপথে এই উদ্যোগ থেকে সরে দাঁড়ালে মানুষের প্রত্যাশা মুখ থুবড়ে পড়বে। অন্যদিকে সমাজবিরোধীরা দুর্দমনীয় হয়ে উঠবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে স্থিরপ্রত্যয়ী হতে হবে, কঠোর হতে হবে এবং সাংগঠনিক ও আত্মীয়তার সব প্রভাব থেকে বিমুক্ত হয়ে এমন জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো একটি জাতীয় ঐক্য ও উত্তাপ গড়ে ওঠে।

এই দেশটি সোনার দেশ। প্রবহমান নদীর উচ্ছ্বাসের মতো এ দেশের মানুষের হৃদয় দেশ ও জাতির প্রয়োজনে জাগেÑ মহিমায় উজ্জীবিত এ জাতির ইতিহাস। যখনই ডাক এসেছে, সব প্রতিবন্ধকতার অর্গল ভেঙে দেশবাসী একত্রিত হয়েছে সব প্রতিবন্ধকতা উতরে সামনে এগিয়ে গেছে। সরকারপ্রধান আজকে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন জনগণ সেটিকে প্রচন্ড আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করলেও সরকারের প্রশাসনে এবং দলীয় সংগঠনের অভ্যন্তরে অনেকের আঁতে ঘা লাগার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ধরেই নেওয়া যায়, তারা এই প্রচেষ্টাকে বানচাল করার যে কোনো চেষ্টাই করবেন। আজকের সরকারপ্রধানের যে মানসিক দৃঢ়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে, অতিসূক্ষ্ম কৌশলে সেটিকেও দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করতে পারেন তারা। প্রকারান্তরে কেউ কেউ দলভাঙার ভয়ভীতি এমনকি তার প্রাণনাশের আশঙ্কার কথাও তুলে তার আঁচল ধরে পেছনে টানতে পারেন। তারা সফল হলে প্রচেষ্টার বারোটা তো বাজবেই, জাতিও মুষড়ে পড়বে। আর শেখ হাসিনা যদি কিছুতেই কর্ণপাত না করে দুর্বিনীত ও সামাজিক অপরাধগুলো দমনে আপসহীন, নিষ্ঠাবান ও সাত্ত্বিক থাকতে পারেন, তাহলে তো আল্লাহর কাছে গোটা জাতি শোকর আদায় করবে। এহেন মুহূর্তে এ জাতি আগে কখনো বিভ্রান্ত হয়নি, আল্লাহর অশেষ রহমত থেকেও বঞ্চিত হয়নি। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবিমুক্ত সমাজ, মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ, উন্নয়নের ধারায় বিবর্তনের প্রবাহে এগিয়ে যাওয়া সমাজ সেই স্বপ্নের সৈকত নির্মাণ করতে পারে। আমরা তারই প্রত্যাশী।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর