সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জাতিসংঘে উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, উজ্জ্বল শেখ হাসিনা

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

জাতিসংঘে উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, উজ্জ্বল শেখ হাসিনা

জাতিসংঘ অধিবেশনে মাত্র একবার কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। পরের সেপ্টেম্বর দেখার সুযোগ তার হয়নি। এর আগেই নৃশংস উপায়ে স্বজাতির হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে। জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রায় ২৫টি ইস্যু তুলে ধরেছিলেন; যা তৎকালীন বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা বিশে^র পররাষ্ট্রনীতিকে নাড়া দিয়েছিল। বিশ্ব সর্বোচ্চ সংস্থায় বাংলায় উচ্চারিত এ ভাষণটি আজও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ও সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধুর বিস্তৃত এ ভাষণের আবেদন কখনো শেষ হওয়ার নয়। গত ৪৫ বছরেও হয়নি। ভাষণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এটাকে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ আখ্যা দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা, আর বাংলাদেশের কাছে তা কূটনৈতিক সম্পর্কের চিরঞ্জীব এক সনদ। গতকাল ৭৪তম অধিবেশনের বক্তৃতা দানকালেও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের উদ্ধৃতি টেনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘দুঃখ দুর্দশা সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রস্থল। নানা অসুবিধা ও বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও জাতিসংঘ তার প্রতিষ্ঠার পর সিকি শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মানবজাতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।’ ভাষণে বাংলাদেশের উন্নয়ন, বিশ্বশান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন রোহিঙ্গা সংকট ও ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ-বাংলাদেশের কয়েক দশক ধরে চলা সম্পর্কের রসায়ন নিয়েও।

বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের শুরুটা মূলত বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে; ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট সে সময় পাকিস্তানি গণহত্যাকে ‘মানব ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়’ আখ্যা দিয়ে ৭ কোটি বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পাশে ছিলেন প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ বাংলাদেশি শরণার্থীকে সাহায্য করেও। জাতিসংঘের এ সম্পৃক্তির ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কৌশলগত ভাবেও লাভবান হয়। যদিও সম্পর্ক উত্তরোত্তর গভীর হওয়ার এই ধাপট ততটা মসৃণ ছিল না। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরের বছরই (১৯৭২ সাল) বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদপ্রাপ্তির তৎপরতা শুরু করলে তাতে বাদ সাধে পাকিস্তান। জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনায় চীন ভেটো দিলে সদস্যপদ লাভে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৭৩ সালেও। পরবর্তীতে অবশ্য অসাধারণ দক্ষতায় এই সমস্যা মোকাবিলা করেন বঙ্গবন্ধু। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় বাংলাদেশকে ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। বৈশি^ক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানতম এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে সেদিন উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিলেন জাতির জনক। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে।’ এর ঠিক এক সপ্তাহ পর সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন জাতির জনক। ভাষণের শুরুতেই জাতির জনক বলেছিলেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’

বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের প্রতিটি শব্দ শুধু ৭ কোটি বাঙালি নয়, ৩০ লাখ শহীদও যেন আকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন। শহীদদের অবদান স্বীকার করে জাতির জনক সেদিন বলেছিলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন।... শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন।’ ভাষণেও বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। ভাষণে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের প্রতি খানিকটা চড়া সুরই তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও সমাধান চেয়েছেন এমন এক উপায়ে, যেখানে রোহিঙ্গাদের কল্যাণ নিশ্চিতভাবে বজায় থাকে। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি সমস্যার বোঝা বহন করে চলেছি, যা মিয়ানমারের তৈরি। এটি সম্পূর্র্ণ মিয়ানমার এবং তার নিজস্ব নাগরিক রোহিঙ্গাদের মধ্যকার একটি সমস্যা। তাদের নিজেদেরই এর সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাখাইনে নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’ নিকটবর্তী সময়ে সমাধান না আসা এই ‘মানবিক সংকট’ এবার চার দফা প্রস্তাবও পেশ করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। জাতিসংঘে ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা। টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ চলতি সপ্তাহেই মর্যাদাপূর্ণ ‘ভ্যাকসিন হিরো’ লাভ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত এক সভায় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই) তাকে এই পদক দেন। এর আগে তিনি জাতিসংঘ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’;  ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ‘আইটিইউ’ অ্যাওয়ার্ডসহ সংস্থাটি থেকে বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সদর দফতরে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় গত মাসে। সভায় বঙ্গবন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ উপাধি দিয়েছেন উপস্থিত বিশ্ব নেতারা।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক দুদক কমিশনার।

 

সর্বশেষ খবর