বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কী ঘটছে মমতার পশ্চিমবঙ্গে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

কী ঘটছে মমতার পশ্চিমবঙ্গে

কলকাতার সাবেক পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করা হলেই মুখোশ খুলে যাবে সারদা ও রোজভেলি কান্ডের বহু রথী-মহারথীর। এমনটাই মনে করছে সিবিআই তো বটেই, বিরোধী রাজনৈতিক মহল। তাদের বক্তব্য, সারদার মতো বিশাল অঙ্কের আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায় বহু রথী-মহারথীকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করে জেরা হয়েছে। তাদের তুলনায় কলকাতার সাবেক নগরপাল রাজীব কুমারের গ্রেফতারি কিছুই নয়। তবু তার গ্রেফতার অনিবার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই কারণে যে, তাকে জেরা করলেই বেরিয়ে আসবে এই কান্ডে মূল মাথা বা মাথাদের নাম।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কেলেঙ্কারির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই তদন্ত শুরু করেছিল রাজ্য পুলিশের সিট। সেই সিটের প্রধান ছিলেন এই রাজীব কুমার। সিট যে সারদার দফতর থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র, ডায়েরি, কম্পিউটার, পেনড্রাইভ উদ্ধার করেছিল, তার বেশির ভাগই পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি। টেলিফোন কলগুলোই হয় মুছে দেওয়া হয়েছিল কিংবা অর্ধেক মোছা (ডিলিটেড) অবস্থায় সিবিআইর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বার বার উঠে আসে একটি লাল ডায়েরির কথা। জেরায় সুদীপ্ত সেনের সহযোগী দেবযানী মুখোপাধ্যায় এই ডায়েরির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, এখানেই যাবতীয় নগদ লেনদেনের বিবরণ লেখা থাকত। রাজীব কুমারের তৎপরতা শুরু হয়েছিল এসব তথ্য-প্রমাণ লোপাট করার মধ্য দিয়ে। যে কম্পিউটারগুলো উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল, সেগুলো আসলে ছিল মনিটর ও কি-বোর্ড। একটি কম্পিউটারের মূল অংশ অর্থাৎ সিপিইউ হয় গায়েব করে দেওয়া হয়েছিল, না হয় গায়েব করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজীব কুমার সিটের প্রধান হিসেবে এই অতিতৎপরতা দেখালেন কেন? কার নির্দেশে? সিবিআই তো বটেই, বিরোধীদেরও বক্তব্য- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটাই নাম বেরিয়ে আসবে। আর তা হলো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সিবিআইর খুদে গোয়েন্দারা নিশ্চিত, রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করে জেরা করলেই বেরিয়ে আসবে সেই নাম। সঙ্গে আরও কিছু রাঘববোয়ালের নামও বেরিয়ে আসতে পারে। সে কারণেই রাজীব কুমারকে হেফাজতে নেওয়ার ব্যাপারে সিবিআইর এত তৎপরতা। রাজীব কুমারও জানেন সে কথা। সে কারণেই হাজিরা ও গ্রেফতারি এড়াতে তারও সমান তৎপরতা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শিলংয়ে যখন তাকে টানা জেরা করা হয়েছিল সে সময় তিনি জানতেন, যতই জেরা করুক, তাকে গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই। ফলে সে সময় নানা অসহযোগিতা করে, মূল প্রশ্ন থেকে সরে গিয়ে সিবিআইকে কার্যত লেজে খেলিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পাকা মাথার এই অফিসার। এবার কলকাতা হাই কোর্ট তার মাথার ওপর থেকে রক্ষাকবচ তুলে নেওয়ার পর সিবিআই রাজীব কুমারকে গ্রেফতার করতে আর বিন্দুমাত্র দেরি করতে চাইছে না।

দ্বিতীয়ত সুপ্রিম কোর্ট সারদা কান্ড তদন্তের ভার সিবিআইর হাতে তুলে দেওয়ার সময় বলেছিল, এই কেলেঙ্কারির বৃহত্তর ষড়যন্ত্র এবং প্রধান সুবিধাভোগীদের খুঁজে বের করতে হবে। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েও হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তৃণমূল নেত্রীর বাড়িতেই পৌঁছবে, তাও বিলক্ষণ জানেন সিবিআইর গোয়েন্দারা। জানেন রাজীব কুমারও। সে কারণেই সিবিআই ও রাজীব কুমারের লুকোচুরি খেলা তুঙ্গে উঠেছে।

একই কথা বলেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়ও। তিনি বলেছেন, রাজীব কুমারকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে পারলেই উঠে আসবে একের পর এক রাঘববোয়ালের নাম। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, দেশের সঙ্গে যারাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তারা সবাই এখন সিবিআইর ভয়ে ভীত। এত বড় বড় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজীব কুমার মাটির তলায় লুকিয়েও বাঁচতে পারবেন না। সিবিআই ওকে ধরবেই। বরং উনারই উচিত এগিয়ে এসে আইনকে সাহায্য করা। সিপিআই(এম) নেতা তথা বিধানসভায় বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীও একই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, রাজীব কুমার একজন দক্ষ ও শিক্ষিত পুলিশ অফিসার। তার এমন কী প্রয়োজন হলো যে, মমতা ব্যানার্জির নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরতে হবে? তিনি আইন মোতাবেক নিজের কাজ করলেই পারতেন। কিন্তু আইনের পরিধির বাইরে বেরিয়ে সারদা কান্ডে তথ্য হাপিশ করার দুর্বুদ্ধি তাকে কে দিয়েছিল, তা জানা জরুরি হয়ে পড়েছে। সোজা কথা, রাজীব কুমার আসল অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।

কলকাতার সাবেক নগরপাল তথা বর্তমান গোয়েন্দাপ্রধান রাজীব কুমারের আগাম জামিনের শুনানি চলছে কলকাতা হাই কোর্টে। পরপর দুই দিন শুনানির পরও শেষ হয়নি শুনানি প্রক্রিয়া। রাজীব কুমারের আইনজীবীরা আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়েছিলেন। অর্থাৎ আগাম জামিনের শুনানি চলাকালে এবং রায় না বেরোনো পর্যন্ত রাজীব কুমারকে যেন অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়া হয়। কিন্তু কলকাতা হাই কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। এর ফলে আগাম জামিনের শুনানি চলাকালেই সিবিআই রাজীব কুমারের খোঁজ পেলে তাকে গ্রেফতার করতে পারবে।

এদিকে সিবিআইর কাছে পাঠানো রাজ্যের গোয়েন্দাপ্রধান রাজীব কুমারের শেষ বার্তা অনুসারে বুধবারই তার ছুটি শেষ হয়ে গেছে। তাই বৃহস্পতিবার ওই পুলিশকর্তার খোঁজে রাজ্য পুলিশের সদর দফতর ভবানী ভবনে হাজির হয় সিবিআই। কিন্তু রাজীব নিজের কর্মস্থলে আসেননি। সিবিআইর এক কর্তা বলেন, আমরা ফের নবান্নের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। অর্থলগ্নি সংস্থা রোজভেলির আর্থিক তছরুপ মামলায় সম্প্রতি যখন রাজীবকে ডাকা হয়, তিনি লিখিতভাবে সিবিআইকে জানান, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পর এ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। তিনি রাজ্য প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাই তার পক্ষে এখনই সিবিআইর কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রাজীবের এই যুক্তির বিপক্ষে সিবিআইর প্রশ্ন, এতই যদি গুরুত্বপূর্ণ হন, তাহলে তিনি ছুটি নিলেন কী করে? রাজ্য প্রশাসনও তাকে খুঁজে পাচ্ছে না! এত গুরুত্বপূর্ণ অফিসারকে বাদ দিয়ে সরকার কী করে চলছে? রাজীবকে অবিলম্বে ফিরিয়ে আনা হোক, দাবি সিবিআইর তদন্তকারীদের। সারদা কান্ডে হাই কোর্টে রাজীবের আগাম জামিনের মামলার শুনানি শুক্রবারও শেষ হয়নি। বিচারপতি শহিদুল্লাহ মুন্সি ও বিচারপতি শুভাশিস দাশগুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে প্রথমার্ধে সওয়াল করেন রাজীবের আইনজীবীরা। সিবিআইর আইনজীবীরা সওয়াল করেন দ্বিতীয়ার্ধে। চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি সামনে আসার পর সারদাকর্তা প্রতারক সুদীপ্ত সেন ফেরার ছিলেন ১২ দিন। ১৩ দিনের মাথায় তাকে কাশ্মীরের সোনমার্গ থেকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। চিট ফান্ড কান্ডেই রাজ্যের গোয়েন্দাপ্রধান রাজীব কুমার ফেরার দুই সপ্তাহর বেশি দিন ধরে। রাজ্যেই রয়েছেন তিনি। এমনটাই দাবি সিবিআই অফিসারদের। তার পরও একজন আইপিএস আধিকারিকের হদিস পাচ্ছেন না সিবিআইর মতো পেশাদার কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা, যা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতা হাই কোর্টে রাজীব কুমারের আগাম জামিনের আবেদনের নিষ্পত্তি হয়নি। দুপুরে রাজীবের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনে হাই কোর্টের বিচারপতি শহিদুল্লাহ মুন্সি ও বিচারপতি শুভাশিস দাশগুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ। সিবিআই সওয়াল করার সুযোগ পায়নি। রাজীবের আইনজীবীরা রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুনানির জন্য আবেদন জানান। বেলা আড়াইটা নাগাদ শুনানি শুরু হওয়ার সময় বিচারপতিরা জানান, কেবল মামলার সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরাই কক্ষে থাকতে পারবেন। এদিকে অন্তর্ধান পর্বের মধ্যেই কোর্টে একের পর এক আগাম জামিনের আবেদন করে যাচ্ছেন রাজীব কুমার। তাতে সইও থাকছে তারই। কীভাবে তা সম্ভব? রাজ্য সরকারের প্রয়োজনীয় সাহায্য ছাড়া তা অসম্ভব বলেই মনে করছেন সিবিআইর অফিসাররা। গত এক পক্ষকাল ধরে রাজীব কুমারের মোবাইলের নেটওয়ার্ক ধরেও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল সুইচ অফ করে রাখা আছে। মুখে কুলুপ রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশকের।  

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর