বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্গোৎসবের স্মৃতি

তপন কুমার ঘোষ

দুর্গোৎসবের স্মৃতি

শরতের প্রকৃতি জানান দিচ্ছে দুর্গোৎসবের আর বেশি দেরি নেই। জোর কদমে এগিয়ে চলছে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি। আর মাত্র কদিন পরই ঢাকে পড়বে কাঠির বাড়ি। দর্শনার্থীর ঢল নামবে পূজাম-পগুলোয়। আনন্দমুখর পরিবেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মেতে উঠবে দেবীবন্দনায়। দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রামের গরিব ঢাকি থেকে শুরু করে মৃৎশিল্পী, প্যান্ডেলওয়ালা, মন্ডপশিল্পী, ডাকের সাজের কারিগর, আলোকসজ্জার মিস্ত্রি, দশকর্মা ভান্ডারের খুচরা বিক্রেতা সবারই সাময়িক রুটি রোজগারের ব্যবস্থা হয়। পোশাক ব্যবসায়ীদের তো এখন সুসময়। ২৮ সেপ্টেম্বর পালিত হয়েছে মহালয়া। এদিন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গাকে আবাহন জানানো হয়েছে মর্ত্য। ৪ অক্টোবর মহাষষ্ঠী, পূজার শুরু। শেষ হবে ৮ অক্টোবর। এদিন সরকারি ছুটি। পূজার কদিন বিভিন্ন পূজা কমিটির পক্ষ থেকে প্রসাদ বিতরণ, বস্ত্র বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি, কাঙালিভোজ, মেধাবী ছাত্রদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। দুর্গাপূজা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এতটাই ব্যয়বহুল যে, সাধারণের পক্ষে এ পূজা আয়োজন করা সম্ভব হয় না। একসময় জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। তখনকার দিনে বিজ্ঞাপন বা স্পন্সর ছিল না। সময় পাল্টেছে। জমিদারি প্রথা সেই কবে বিলুপ্ত হয়েছে। কালক্রমে গুটিকয় ধনাঢ্য পরিবারের উৎসব থেকে পূজা ‘সর্বজনীন’ অর্থাৎ ‘সর্বজনের’ উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। বারোয়ারি (পাড়া বা ক্লাব) পূজাই এখন বেশি হয়। তবে প্রাচীন রীতিনীতি মেনে আজো কিছু পারিবারিক পূজা হয় যা ‘বনেদি পূজা’ নামে পরিচিত। পূজা এলে পুরনো সেই দিনের কথা মনে পড়ে যায়। নিজ গ্রামের কথা, মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। এখন আমার কাছে পূজা মানে স্মৃতিচারণা। ষাটের দশকের কথা। স্কুলে পূজার ছুটি। পড়াশোনার বালাই নেই। কোনো রুটিন নেই। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এ চার দিন সেজেগুজে দল বেঁধে মন্ডপে মন্ডপে ঠাকুর দেখতে যাওয়া একমাত্র কাজ। অধিকাংশ মন্ডপে এক চালার প্রতিমা। প্রথমেই নজরে পড়ত গায়ে গর্জন তেল মাখা ভয়ঙ্কর এক কালো দৈত্য। নাম তার অসুর। ত্রিশূল দিয়ে মা দুর্গা তাকে কুপোকাত করে ফেলেছেন। দৃশ্যটা ছিল স্বস্তির। কিন্তু ওই দৈত্য যদি কখনো আবার জেগে ওঠে? পারবেন কি মা দুর্গা তাকে বধ করতে? ভয় জাগে মনে! বড়রা অভয় দিতেন- ওরে পাগল! মা দুর্গাকে পরাভূত করতে পারে এমন শক্তি কারও নেই। দশমীর দিন সন্ধ্যায় নড়াইলের চিত্রা নদীতে একে একে সব প্রতিমার বিসর্জন হতো। নদীর ওপারে স্থানীয় সিঙ্গাশোলপুর বাজারজুড়ে বসত মানুষের মিলনমেলা। পূজায় এত আনন্দ! বছর ঘুরে একবার পূজা আসে। বার বার কেন আসে না? বড়দি বুঝিয়ে বলতেন, ওরে বোকা! বছরে একবার আসে বলেই তো পূজায় এত আনন্দ! মহালয়ার ভোরে আকাশবাণী, কলকাতা থেকে প্রচার করা হতো চন্ডীপাঠের অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। দুর্ধর্ষ অসুররাজ ‘মহিষাসুর’ দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য দখল করে নেন। দেবতারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়। দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেন।  দেবতারা ফিরে পান স্বর্গরাজ্য। সংক্ষেপে এই হচ্ছে মহিষাসুরমর্দিনীর কাহিনি। দুই বাংলার শ্রোতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল এ অনুষ্ঠানটি। ভোর সাড়ে ৪টায় শুরু হতো মহালয়ার অনুষ্ঠান। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখা হতো। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে বীরেন্দ্রকৃঞ্চ ভদ্রমহাশয় দরাজ কণ্ঠে স্তোত্র (মন্ত্র) পাঠ করে চলেছেন, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির। ধরণির বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।’ তখন ঘরে ঘরে রেডিও ছিল না। পাড়ার সব রেডিওর ভলিউম চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে প্রতিবেশীরাও শুনতে পায়। যদ্দুর জানা যায়, ১৯৩২ সাল থেকে এ অনুষ্ঠানটি আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত হয়ে আসছে। তখন টেপ রেকর্ডিং চালু হয়নি। প্রথম দিকে ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান হতো। রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। ওই অনুষ্ঠানে ভক্তিগীতি নিবেদন করেন ওই সময়কার নামিদামি সব শিল্পী। যার মধ্যে আছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ প্রমুখ। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। দীর্ঘ ৮৭ বছর ধরে আকাশবাণী, কলকাতা থেকে প্রচার হয়ে আসছে এ অনুষ্ঠান। তবে ব্যতিক্রম ছিল ১৯৭৬ সাল। ওই বছর বীরেন্দ্রকৃঞ্চ ভদ্র মহাশয়কে বাদ দিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠান করানো হয়। অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয় ‘দেবীং দুর্গতিহারিণী’। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃঞ্চের পরিবর্তে উত্তমকুমারের কণ্ঠ মেনে নিতে পারেননি শ্রোতারা। অনুষ্ঠানটি ফ্লপ করে। এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়। কলকাতা বেতার অফিস ভাঙচুর করা হয়। জনদাবির মুখে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ষষ্ঠীর দিন সেই পুরনো অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আবার সম্প্রচার করে। এ ঘটনার নেপথ্যে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে সম্প্রতি ‘মহালয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে কলকাতায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে মন্ত্রপাঠ আজো গায়ে কাঁটা দেয়। আবহমানকাল ধরে মানুষ শক্তির পূজারি। দুর্গা শক্তির দেবী। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র কাহিনিতে নারীশক্তির বিজয় সূচিত হয়েছে। একুশ শতকে নারী ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে এই সময়ের কী আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়!

 

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর