বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা
কামরুল হাসান মঞ্জু

মনে হয় আমিই লেনিন

ফখরে আলম

মনে হয় আমিই লেনিন

কামরুল হাসান মঞ্জু যখন সংসদ ভবনের পাদদেশে দাঁড়িয়ে সূর্য ওঠার আগে চিৎকার করে আবৃত্তি করতেন, ‘মনে হয় আমিই লেনিন’; সুকান্তের ‘লেনিন’ কবিতাটি আমি কিশোর বয়সে পড়লেও মঞ্জু ভাইয়ের কাছে শুনে নিজেকে লেনিনই মনে হয়েছে। আমি আশির দশকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে হেঁটে সংসদ ভবনের উদ্যানে বসে খুব খেয়াল করে কবিতা আবৃত্তি শোনার পর মঞ্জু ভাইকেও লেনিনই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে তিনি শালপ্রাংশু। কবিতার অস্ত্র দিয়ে তিনি সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলবেন। বাংলাদেশের আবৃত্তি শিল্পের নায়ক কণ্ঠ নামিয়ে নীরবে নিভৃতে গেল ২১ সেপ্টেম্বর না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। তবে তার ভক্ত-অনুরাগীরা তারই কণ্ঠ শরীরে ধারণ করে আকুতি জানাচ্ছেন। ‘বাবু মশাইরা আমাকে সোনার মেডেল দেবেননি’। বাংলাদেশের আবৃত্তি শিল্পের অন্যতম নায়ক কামরুল হাসান মঞ্জু। তাকে আমি আশির দশক থেকে চিনতাম। ১৯৮২-৮৩ সালে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ডিগ্রি অর্জন করে টিএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে আবৃত্তি কর্মশালার আয়োজন করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্মরতি’ নামের একটি আবৃত্তি সংগঠন। যত দূর মনে পড়ে এটি দেশের প্রথম আবৃত্তি সংগঠন। সাদা ফুলপ্যান্ট টি-শার্ট পরে মঞ্জু প্রায় প্রতিদিন বিকালে আমাদের নতুন নতুন কবিতা শোনাতেন। আমি, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি কবির হোসেন তাপস, শিল্পী আবুল কাশেম, বাবর আলী, সাংবাদিক অমিত হাবিবসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী মঞ্জু ভাইয়ের কবিতা শুনতাম। ফেরার সময় আমরা কেউ বলতাম ‘ঘুম ঘুম খিদে খিদে’। কেউ বলতাম ‘ভাত দে হারাম দাদা’। মঞ্জু ভাই মোহাম্মদপুরে ‘আশা’ নামের একটি সংগঠনে চাকরি করতেন। আমি সেই অফিসে প্রায় যেতাম। সেখানে শুধু কবিতা নিয়েই কথা হতো। তিনি যেমন আবৃত্তি করতেন তেমনই কবিতা লিখতেন। কবিতায় তার স্বতন্ত্র আবেগ, প্রেম, দ্রোহ আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে আছে। ১৯৮৪ সালে লেখা ‘সংবর্ধনা’ নামের একটি কবিতা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। কবিতার শেষ স্তবক এমন- ‘আমরা ঊর্ধ্বস্বরে জয়ধ্বনি করলাম/জয় মহারানীর জয়/আমাদের চৈতন্যের গোলাপগুলি উত্তরপুরুষের জন্যে/আরো একবার পুরানো কেরানির মতো বিবর্ণ হয়ে গেল/আমরা ধন্য হলাম/ধন্য হলাম’। টিএসসিতে বসে আমরা কয়েকজন বন্ধু পরিকল্পনা করলাম দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাসন্ধ্যা করব। আমাদের স্বপ্নের সেই তারা ফুটল ’৮৪ সালের ২৭ নভেম্বর। আমার যত দূর মনে হয় এটি দেশের প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাসন্ধ্যা। যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে এই সন্ধ্যার শুভ উদ্বোধন করেন কবি আল মাহমুদ। কবিতা পড়েন কবি আজিজুল হক, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ, আবৃত্তিশিল্পী কাজী আরিফ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ও কামরুল হাসান মঞ্জু। আমরা কয়েকজন তরুণ যুবক ওই কবিতাসন্ধ্যায় কবিতা পড়লেও কামরুল হাসান মঞ্জু ছিলেন ‘হটকেক’। তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়লেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতাও পড়লেন। খুবই দরদ আর আবেগ নিয়ে পড়লেন ‘অমলকান্তি রৌদ্দুর হতে চেয়েছিল’। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি/আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি’। আর সুকান্তের লেনিন পড়লেনই। হলভর্তি শত শত কবিতাপ্রেমী মানুষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে করমর্দন করলেন। এই কবিতাসন্ধ্যার পর তার সঙ্গে আরও পথ চলেছি। তিনি তার কবিতা আবৃত্তি নিয়ে নব্বইয়ের দশকে কিংবা আশির দশকের শেষে প্রথম দেশে একটি ফিতে ক্যাসেট বের করেন। ক্যাসেটটির নাম ‘প্রসূনের জন্যে প্রার্থনা’। আমরা সেই ক্যাসেট শুনেছি। বিক্রিও করেছি। এরপর মঞ্জু ভাই ‘আশা’ ছেড়ে নিজে  ‘এমএমসি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন। এমএমসি নিয়েও তার সঙ্গে আমার অনেক আলোচনা হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে মঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় একরকম গৃহবন্দী জীবনযাপন করছি। ২২ সেপ্টেম্বর সকালে মঞ্জু ভাইয়ের বন্ধু কমরেড হারুন অর-রশিদ আমাকে ফোনে জানান, ‘দুঃখের ভিতরেও বলতে হয় মঞ্জু ভাই মারা গেছেন। তাকে যশোরে আনা হয়েছে।’ আমি আবৃত্তিশিল্পী শ্রাবণী সুরকে ফোন করি, তিনি কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি এই কবিতাটি মঞ্জু ভাইয়ের কাছ থেকেই আবৃত্তি শিখেছি। তিনি আমাদের গুরু। কবিতাকে ক্যাসেটবন্দী করে তিনি এ দেশে প্রথম তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন। মানুষকে কবিতা শুনিয়ে কবিতার প্রতি প্রেম জাগিয়েছেন। আমরা যে প্রেমের জন্য এখন কাঙাল হয়ে আছি।’ আমি কবি দারা মাহমুদ ও কবি মাজেদ নেওয়াজের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলেন, ‘মঞ্জু ভাই আবৃত্তিশিল্পের নায়ক। তিনি নায়ক হয়ে থাকবেন। দেশের মানুষ টাকা খরচ করে তার কবিতা আবৃত্তি শুনেছে। কণ্ঠজাদুতে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের লেনিন মনে করেছে।’

                লেখক : কবি ও সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর