শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কে আলী

কালাম আজাদ

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কে আলী

অধ্যাপক কে আলীকে নতুন প্রজন্মের ইতিহাসবিদদের শিক্ষক বলে অভিহিত করলে হয়তো খুব একটা ভুল হবে না। এ মুহূর্তে যারা ইতিহাস গবেষণা করছেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ পর্যায়ে ইতিহাসের শিক্ষকতা করছেন, তার মধ্যে এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া কঠিন যারা ছাত্রজীবনে অধ্যাপক কে আলীর লেখা ইতিহাস বই পড়েননি অথবা তার প্রভাবে প্রভাবিত হননি। অধ্যাপক কে আলীর ইতিহাস- চর্চায় সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কৃতিত্ব ছিল তিনি ইতিহাসকে প্রাণহীন রুক্ষ বিষয়ে পরিণত করেননি। প্রাণবন্ত ভাষার গুণে তার প্রতিটি গ্রন্থ সাহিত্য হয়ে উঠেছিল। বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি তার ঝোঁক ছিল সমীহ করার মতো। অধ্যাপক কে আলীর সহকর্মী হিসেবে কাজ করার সুবাদে তার যে গুণটি মন কেড়েছে, তা হলো তিনি প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করেছেন। তিনি মনে করতেন, ছাত্রছাত্রীদের সামনে ভুল তথ্য উপস্থাপন করলে তা হবে অপরাধের শামিল। প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে চাপিয়ে দেওয়ার ভ্রান্তি থেকে তিনি নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। একজন প্রকৃত ইতিহাসবিদের যেসব গুণ থাকা দরকার তার পুরোটাই বিদ্যমান ছিল এই জ্ঞানতাপস ইতিহাসবিদের মধ্যে। অধ্যাপক কে আলী জন্মগ্রহণ করেন খুলনার ঐতিহ্যবাহী ডুমুরিয়া উপজেলার কাগুজীপাড়া গ্রামে। শিক্ষকতা জীবনের শুরু খুলনার দৌলতপুরের সুবিখ্যাত বি এল কলেজে। এ কলেজে ইতিহাসের শিক্ষক থাকাবস্থায় তিনি বাংলা ভাষায় ইতিহাস পাঠ্যবইয়ের অভাব অনুধাবন করেন। তার অতিপরিচিত ইতিহাসগ্রন্থ ‘ইসলামের ইতিহাস’ লেখা শুরু হয় বি এল কলেজে শিক্ষকতা করার সময়। স্মর্তব্য যে, অধ্যাপক কে আলীর এ বইটি মূলত তার নিজের লেখা  A Studay of Islamic History -এর বাংলা সংস্করণ। ইসলামের ইতিহাস প্রকাশের আগে এর মূল ইংরেজি বইটিও ছাত্রছাত্রীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত শতাব্দীর শেষ দিকে এ বইটি পাঠ্য তালিকায় ছিল। অধ্যাপক কে আলী এবং ইতিহাসচর্চা এ দুটি তার জীবদ্দশায় একে অন্যের পরিপূরক বিবেচিত হতো। অধ্যাপক কে আলী শিক্ষকতা জীবনে দেশের বেশ কিছু কলেজে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থায় তিনি অবসর নেন। শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকেই তিনি ইতিহাসচর্চা বিশেষত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিলেবাস-উপযোগী ইতিহাস গ্রন্থ লেখায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। তাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। তাদের জ্ঞানস্পৃহা জাগ্রত করাকেই তিনি সত্যিকারের কৃতিত্ব বলে মনে করতেন। অধ্যাপক কে আলী বলতেন, ‘দেশ, জাতি বা স্বীয় জনপদের ইতিহাস না জানলে কোনো মানুষের পক্ষে নিজেকে সত্যিকারভাবে চেনা সম্ভব নয়।’ তিনি বলতেন, ‘আত্মান্বেষার জন্যই আমাদের আরও বেশি করে ইতিহাস পড়া উচিত।’ ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না- এ ঐতিহাসিক বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও তিনি বলতেন, ‘আমাদের শাসকদের উচিত আরও বেশি করে পূর্বসূরিদের ইতিহাস জানা; যা তাদের ভুলত্রুটি এড়াতে সহায়তা করবে।’ অধ্যাপক কে আলী ইতিহাস রচনায় যে নিজস্ব লিখনশৈলীর আশ্রয় নিয়েছিলেন তা তাকে পাঠকের কাছে অমর করে রাখবে। সাধু ভাষা এমনকি চলিত ভাষায় লেখা তার বইগুলো লিখনশৈলীর দিক থেকে অনন্যতার দাবিদার। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও অধ্যাপক কে আলী বিশ্বাস করতেন ব্যবসার মাধ্যমে সত্যিকারভাবেই ভাগ্য পরিবর্তন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। কে আলী পাবলিকেশন্স ও কাগুজী মুদ্রায়ণ তিনি গড়ে তুলেছিলেন পি সি রায়কে অনুসরণ করে। আলী পাবলিকেশন্স মূলত তার বইয়ের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। তার পরও অধ্যাপক কে আলীর জীবদ্দশায় এটি ছিল দেশের নেতৃস্থানীয় একটি প্রকাশনা সংস্থা। প্রকাশনা ব্যবসায় তিনি বৈষয়িক জীবনেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। অধ্যাপক কে আলী তার দীর্ঘ জীবনে প্রায় ৫০টির মতো গ্রন্থের রচয়িতা। এর মধ্যে ইসলামের ইতিহাস, মুসলমানদের ইতিহাস, ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাস, পাক-ভারতের ইতিহাস, বাংলাদেশ ও পাক-ভারতের ইতিহাস, মুসলিম সংস্কৃতির ইতিহাস, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, মুসলিম বাংলার ইতিহাস। A Study of Islamic History, History of India Pakistan & Bangladesh, Bangladesh A New Nation ইতিহাসগ্রন্থ অন্যতম। ‘আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কর্ম ও জীবন’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থের লেখক তিনি। ছোটদের জন্য লেখা গল্পগ্রন্থ ‘একটি আরব শিশুর কাহিনী’ অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে। অধ্যাপক কে আলীর সময়নিষ্ঠা ছিল প্রশংসার দাবিদার। সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও তিনি অসামান্য যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রতিটি কাজ পরিকল্পনামাফিক করার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সহকর্মী ও পরিচিতজনদের তিনি সময়নিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বলতেন, ‘সময়ের মূল্য না দিলে ব্যক্তিজীবনে যেমন উন্নতি সম্ভব নয়, তেমন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করা যাবে না।’

অধ্যাপক কে আলী- এই নামে সারা দেশে শিক্ষার্থী ও সুধীজনদের মধ্যে পরিচিতি লাভ করলেও তার পুরো নাম ছিল কাওসার আলী। ১৯৯৯ সালের ৬ আগস্ট ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন দেশের ইতিহাসচর্চার এই প্রাণপুরুষ। অধ্যাপক কে আলী আজ বেঁচে নেই। কিন্তু আজ বাংলাদেশে যারা ইতিহাসচর্চা করছেন তাদের মাঝে তার উপস্থিতি আরও বহুকাল অনুভূত হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

ইমেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর