শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস

অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু

আজ ৫ অক্টোবর ৫৩তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৬৬ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধির এক সভায় প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে ও ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে শিক্ষকদের মর্যাদাবিষয়ক একটি সুপারিশমালা গৃহীত হয়। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন -আইএলও এ সুপারিশমালা অনুসমর্থন করে। সুপারিশমালাটিও মূলত বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য রচিত হয়। উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষকদের বিষয়টি সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পরে ইউনেস্কো ও আইএলও ১৯৭৭ ও ’৯৮ সালে আরও দুটি ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। ফলে সর্বস্তরের শিক্ষকের অধিকার, মর্যাদা ও কর্তৃত্ব সমন্বয়ে ইউনেস্কো-আইএলও একটি অভিন্ন নীতিমালা তৈরি করে। এসব নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ওপর। সুপারিশমালার মূল কথা হচ্ছে, সব দেশের শিক্ষকরা উচ্চতর মর্যাদা ও বিশেষ অধিকার পাবেন। বিনিময়ে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতি তথা দেশের প্রতি একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করবেন। দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য অপরিহার্য জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করবেন। এজন্য শিক্ষকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার অধিকার, শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয় যেমন শিক্ষানীতি, সিলেবাস প্রণয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষকদের অধিকার পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ : বাংলাদেশে শিক্ষার প্রচলন হয়েছিল সমাজের অভিজাত পরিবার ও বিত্তবানদের দ্বারা। তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘পাঠশালাকেন্দ্রিক’ শিক্ষাই এ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।  তখন সমাজের বিত্তবান পরিবারের সদস্যরাই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। সময়ের প্রয়োজনে কালের বিবর্তনে এ দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও রূপান্তর, বিস্তার ঘটেছে। ১৯৪৪ সালের আগ পর্যন্ত এ দেশে স্বল্পসংখ্যক যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য কোনো বেতনব্যবস্থা ছিল না। ’৪৪ সালে গাইবান্ধায় অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী স্কুলের শিক্ষকদের জন্য পাঁচ টাকা বেতন চালু করেন। ষাটের দশকের প্রথম দিকে শিক্ষকদের মাসিক বেতন ২০ টাকা ধার্য করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারই পাকিস্তানি শাসন-শোষণে সৃষ্ট বৈষম্যে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথম শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের আর্থিক সংকটের কথা বিবেচনা করে ধাপে ধাপে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ৯৮% বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে আরও ৭ হাজার এমপিওবহির্ভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা সরকার থেকে কোনো বেতনই পায় না। বর্তমান সরকার ২০১২ সালে ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। এতে ১ লাখ ২ হাজার শিক্ষক সরকারি শিক্ষকের মর্যাদা লাভ করেন। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকের মধ্যে ব্যাপক আর্থিক বৈষম্য রয়েছে। এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলে শতভাগ বেতন পেলেও বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা প্রভৃতি থেকে এখনো বঞ্চিত। তবে শেখ হাসিনা সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যেমন জাতীয় স্কেলে বেসরকারি শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি, বার্ষিক ৫% প্রবৃদ্ধি, বৈশাখী ভাতা, কল্যাণ ও অবসর বোর্ডের জন্য ১ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ গ্রহণ করায় বৈষম্য অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান সরকার গত ১০ বছর শিক্ষা খাতে যে অবদান রেখেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় গভর্নিং কমিটি কিংবা ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে। কমিটিগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, কমিটির ইচ্ছা -অনিচ্ছার ওপর শিক্ষকদের চাকরি নির্ভর করে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানসহ শিক্ষকরা পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, আন্তরিক নিষ্ঠা ও সতাতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেয়ে সব সময় চাকরির আতঙ্কে ভোগেন। বর্তমানে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি লাভ করলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে এখনো পর্যাপ্ত বরাদ্দ সুনিশ্চিত হয়নি। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ ঘোষিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮% এবং সর্বশেষ ডাকারে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীর সভায় আপাতত জিডিপির ৬% বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করলেও এ যাবৎ জিডিপির ২.৩-২.৪%-এর বেশি বরাদ্দ দিতে পারেনি।

১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত সভায় শিক্ষকদের উচ্চতর মর্যাদা ও বিশেষ অধিকারের পাশাপাশি দেশ-জাতির জন্য অপরিহার্য ‘জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ’-এর কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। শিক্ষকরা সেই জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ কতটুকু করতে পারছেন সেই প্রশ্নও এসে যায়। তথাপি শিক্ষকদের অধিকারের পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতা শুধু একটি চাকরি নয়। শিক্ষকরা সুনাগরিক গড়ার কারিগর। এটি এমন একটি পেশা যা সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত। শিক্ষকরাই সব বাধা-বিঘœ দূর করে একটি জাতিকে অন্ধকারে আলোর পথ দেখাতে পারেন। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজসহ বিশ্বের সব শিক্ষকের প্রতি নিরন্তন শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রইল।

 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক

স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ।

ইমেইল :[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর