রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছাদবাগান বিভ্রান্তি ও ডেঙ্গু সচেতনতা

আহসান রনি

ছাদবাগান বিভ্রান্তি ও ডেঙ্গু সচেতনতা

বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস ইজিপ্টি মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও তৈরি হয়েছে কিছু বিভ্রান্তিও। এর কারণ অজ্ঞতা বা গুজব। একটা সময় ছিল যখন মানুষ বাড়ির ছাদে বাগান করত নিতান্তই শখের বশে। ছাদে, বারান্দায় বা বাড়ির ফটকে কয়েকটি সুগন্ধি ও বাহারি ফুল কিংবা পাতাবাহারি গাছ দিয়ে সাজিয়ে বাড়ির সৌন্দর্য আরেকটু বাড়িয়ে তোলার মধ্যেই এই শখ সীমাবদ্ধ রাখতে হতো। কেউ কেউ ব্যক্তিগত আগ্রহে ছাদের কোণে মাচা করে কিংবা চিলেকোঠা ও পানির ট্যাঙ্কের ছাদ ঘেঁষে লাউ, কুমড়া করলার মতো সবজি ফলানোর চেষ্টাও যেমন করতেন পাশাপাশি টবে কিংবা তুলনামূলক বড় আকৃতির পাত্রে মাটি ভরে ছাদে ফলফলাদির চারা রোপণের চেষ্টাও করতেন নানাভাবে। সময়ের বিবর্তনে ছাদে বাগান করার নান্দনিক এ চিন্তাধারায় যুক্ত হতে থাকে আধুনিকা। দুয়েকজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে উন্নত দেশের ছাদবাগানের আদলে নিজের বাড়ির ছাদেও বাগান সৃজনে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু অভিজ্ঞ মালি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকবল এবং এসব কাজে পারদর্শী একটি সমন্বিত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অভাবেও অনেক ছাদবাগান মালিক প্রথমে উদ্যোগী হয়েও এক পর্যায়ে আগ্রহ হারাতে আরম্ভ করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে আমরা একদল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কৃষকসন্তান একত্রিত হয়ে গ্রিন সেভার্স নামে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলি যার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এবং স্বল্প খরচে মানুষের বাড়ির ছাদগুলোতে বিষমুক্ত ফল ও সবজির বাগান করে দেওয়া। বস্তুত তখন থেকেই আমরা ছাদবাগান সম্পর্কে নগরবাসীর গতানুগতিক ধারণাগুলোকে পাল্টে দিয়ে ছাদে একটি পরিকল্পিত ছাদকৃষির দিকে উৎসাহিত করতে শুরু করি এবং পরবর্তীতে শিক্ষিত বেকার তরুণদের ছাদকৃষিতে উৎসাহিত করতে ও ছাদবাগান পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত করতে মালি শব্দটি পরিবর্তন করে গাছের ডাক্তার হিসেবে তাদের পরিচিত করাতে আরম্ভ করি। বিগত নয় বছরে আমরা ঢাকা নগরীতে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক ছাদ ও বারান্দায় আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বাগান সৃজন করতে সক্ষম হয়েছি এবং প্রতিটি বাগান সৃজনের শুরু থেকেই ছাদগুলোর পর্যাপ্ত ভার বহনের সক্ষমতা যাচাই করে এর নকশা প্রণয়ন, বেড প্রস্তুত, ডাম্প প্রুফিং, মাটির মিশ্রণ, পানি ও সেচ ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক উপায়ে সার উৎপাদন ও পরিমিত প্রয়োগ, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে আধুনিক ও টেকসই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে থাকি, এবং পরবর্তীতে এর অধিকাংশ ছাদবাগান আমরা আমাদের অভিজ্ঞ গাছের ডাক্তারদের দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকি। ফলে আমাদের সৃজন করা বাগানগুলো থেকে এখন পর্যন্ত আমরা ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা বিস্তারের কোনো খবরাখবর পাইনি। তবে আপনারা অনেকেই যারা টেলিভিশন, ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অন্যের বাগান দেখে উৎসাহিত হয়ে স্ব উদ্যোগে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে বাগান করা আরম্ভ করে পরে বিপাকে পড়ছেন তাদের প্রতি অনুরোধ রাখছি আপনারা একটি নতুন ছাদবাগান তৈরি করার আগে এর একটি সঠিক পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন করে নিন। কারণ টিভিতে, ইউটিউবে কিংবা ফেসবুকে যে ছাদবাগানগুলো প্রদর্শন করা হয় তা দেখে বিভ্রান্ত না হয়ে বরং আপনার ছাদের আকার, আয়তন, উচ্চতা, ভার বহনের সক্ষমতা, সূর্যের আলো, বাতাসের গতি ও বেগ, সেচের পানির উৎস ও অম্লতা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। ফলে একটি পরিকল্পিত নকশা আপানাকে ছাদের আকৃতি, আলো বাতাসের পর্যাপ্ততা ও ছাদের ভার বহনের সক্ষমতা অনুযায়ী গাছ নির্বাচন, গাছের সংখ্যা নির্ধারণ, উপযুক্ত জায়গায় গাছটি স্থাপন, গাছ থেকে গাছের দূরত্ব নিরূপণসহ আধুনিক পানি সেচ ব্যবস্থা ও টেকসই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে। উল্লেখ্য সম্প্রতি ডেঙ্গু-মশা ছড়ানোর ভয়ে বাড়ি, ছাদ ও বারান্দার টবের গাছ কেটে ফেলা, এমনকি সম্প্রতি জনপ্রিয় হওয়া ছাদবাগান করাও বন্ধ করে দিচ্ছেন শহুরে বাসিন্দারা। আর নার্সারিগুলোতেও গাছ বেচা-বিক্রি কমার তথ্যও মিলছে অহরহ। অবাক করা ঘটনা হলোÑনগর কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু-প্রতিরোধে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করায় মামলা ও জরিমানার আতঙ্কে ভাড়াটিয়াদের জোরপূর্বক ছাদ বা বারান্দায় রাখা টবের গাছ সরিয়ে নিতে বাধ্য করছেন অনেক বাড়িওয়ালা। আবার কৌশলে ছাদবাগানের গাছ উপড়ে ফেলা বা কেটে ফেলার মতো তথ্যও মিলছে। পাশাপাশি ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতেও ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অতি উৎসাহী সদস্যরাও অজ্ঞতাবশত সবুজায়ন ধ্বংসে মেতে উঠেছেন, যা শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য আরেক হুমকি বলে মনে করি। কি করলে বারান্দা বা ছাদবাগান ডেঙ্গু-মশামুক্ত রেখে সবুজায়ন টিকিয়ে রাখা সম্ভব, তা নিয়েই এই লেখা- প্রথমত, সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ করে ছাদ, বারান্দা বা ঘরের ভিতর রাখা কোনো গাছই ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তারে সহায়ক নয়। কারণ জীবিত গাছের টবে কোনোভাবেই বেশিক্ষণ পানি জমে থাকার সুযোগ নেই। এমন টবে পানি দেওয়ার সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যেই মাটি পানি শুষে নিতে পারে। একটি সুস্থ গাছ শিকড়ের সাহায্যে পরবর্তীতে সেই পানি ক্রমান্বয়ে মাটি থেকে গ্রহণ করে নেয়। বৃষ্টি বা অন্য কোনো কারণে টবে মাত্রাতিরিক্ত পানি জমে গেলেও তা টবের তলায় থাকা পানি নিষ্কাশনের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। আর ছিদ্র দিয়ে নিষ্কাশিত পানি বালি কাদা মিশ্রিত থাকে, যা ডেঙ্গু প্রজননে কোনোভাবেই সহায়ক নয়। প্রাকৃতিকভাবে মশা প্রতিরোধে কিছু গাছও আছে। যেমন-পুদিনা, তুলসী, গাঁদা ফুল, রসুন, লেমনগ্রাস, রোজমেরি, লেভেন্ডারের মতো গাছ মশা-প্রতিরোধীর ভূমিকা রাখে। ফলে এসব গাছ ছাদে কিংবা বারান্দায় রাখলেও মশামুক্ত থাকা যাবে। ছাদবাগানের গাছগুলো নিয়মিত যতœ ও পরিচর্যা নেওয়া হয়। প্রতিদিন পানি সেচ, আগাছা পরিষ্কার, নিড়ানো, বালাই দমনসহ এমন নানা বিষয় বাগান মালিক নিজেই বা নিয়োজিত মালি দ্বারা তত্ত্বাবধান করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও টব বা গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকার সুযোগ থাকে না। আর ছাদবাগানের পোকামাকড় দমনে প্রায়ই কীটনাশক স্প্রে করা হয়, যা মশা বা অন্যান্য ক্ষতিকর মাকড়ের বিস্তার রোধ করতে সহায়তা করে। তবে কিছু অসতর্কতার কারণে টব বা গাছের গোড়ায় দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পানি জমে থাকতে পারে। যেমন- প্রতিদিন গাছে পানি দেওয়ার ফলে ক্রমেই টবের মাটির স্তর নিচে নেমে যায়। ফলে বর্ষা মৌসুমে টবের উপরিভাগে অতিরিক্ত পানি জমার সম্ভাবনা থাকে। তবে মাটি দিয়ে সেগুলো পূর্ণ করে দিলেই পানি জমার সুযোগ আর থাকে না। অনেকেই ঘর সাজাতে টবে মাটির পরিবর্তে পানিতেও শোভাবর্ধিত গাছগুলো সাজিয়ে রাখেন। এক্ষেত্রে স্কচটেপ দিয়ে টবের মুখটি আটকে দিলে কোনোভাবেই মশা জন্মানোর সুযোগ থাকবে না। গাছে পানি দেওয়ার সময় পরিমিত হারে পানি সেচ দেওয়া উচিত, যাতে ৩০ মিনিটের মধ্যেই মাটি তা শুষে নিতে পারে। এতে টবের উপরিভাগে পানি জমবে না। এছাড়া টবের উপরিভাগে কোকোডাস্ট বা নারিকেলের খোসা বা কাঠের গুঁড়ো দিলে তা অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারে। ফলে টবে পানি জমতে পারে না। কিছুদিন পরপর টবের তলার পানি নিষ্কাশনের ছিদ্রগুলো পরখ করে নেওয়া উচিত। যদি ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তা আবার সচল করে দেওয়া উচিত। এতে টবের তলানিতে জমে থাকা পানি সহজেই বেরিয়ে যাবে। সম্ভব হলে চারা রোপণের সময়ই টবের নিচে অন্তত তিন থেকে পাঁচটি ছিদ্র করে নিতে পারেন। টবের মাটি প্রস্তুত করার সময়ও কম্পোস্ট, কোকোডাস্ট বা কাঠের গুঁড়ো মিশিয়ে নেওয়া যায়। এতে টবের উপরিভাগের পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হতে পারে। টবে পানি জমে থাকলে শুধু মশাই নয়, গোড়া পচে মারাও যেতে পারে গাছ। আর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা গ্রিন সেভার্স থেকে ছাদকৃষির বিস্তারে বাগানের পরিকল্পনা ও নকশা বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকি। বস্তুত, কে কোন ছাদে কয়টি বাগান করল, কার বাগানে কটি ফল হলো সেটি বিবেচনা না করে আমরা ছাদ মালিকদের তাদের ছাদে একটি পরিকল্পিত বাগান করতে উৎসাহিত করি। কারণ পরিকল্পিত বাগান যেমন নিরাপদ ও টেকসই হয় তেমনি বাগানের ফলনও ভালো হয় এবং গাছের রোগবালাইও তুলনামূলক কম হয়। আর ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী মশাও জন্মাতে পারে না।

                লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, গ্রিন সেভার্স।

সর্বশেষ খবর