সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মিঠামইনে মিঠামন

হানিফ সংকেত

মিঠামইনে মিঠামন

এক সময় টিভি বলতে ছিল শুধু বিটিভি অর্থাৎ বাংলাদেশ টেলিভিশন। তখন টেলিভিশনের যে কোনো শিল্পীকেই দেখামাত্র দর্শকরা চিনে ফেলতেন। শুধু শিল্পীই নয়, বারবার প্রদর্শনের কারণে তখন টেলিভিশন সেটে ব্যবহৃত অনেক উপকরণও দর্শকদের কাছে পরিচিত ছিল। আর এখন অনেক চ্যানেল, অনেক অনুষ্ঠান, সরাসরিসহ নানান অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি। তারপরও অনেক শিল্পীকে দর্শকরা যেমন চেনেন না, তেমনি চেনা শিল্পীকেও অনেকদিন না দেখার কারণে অচেনা মনে হয়। রাস্তায় পরিচিত কেউ হয়তো প্রশ্ন করে বসেন-কি ব্যাপার অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন নাকি? অথচ আগের দিন রাতেই তার নাটক প্রচারিত হয়েছে। আসলে চ্যানেল বা অনুষ্ঠান যতই বাড়ছে, ততই ভয়ঙ্করভাবে কমছে অনুষ্ঠানের মান। ভয়ঙ্কর শব্দটি এ জন্যই ব্যবহার করলাম কারণ বাংলায় ‘ভীষণ’ শব্দটির অর্থ হলো ভয়াল বা ভয়ঙ্কর। কিন্তু ইংরেজি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান এখন ওই বাংলার ‘ভীষণ’ শব্দের মতোই হয়ে যাচ্ছে। যেসব অনুষ্ঠানের মান দেখলে কোন মানদন্ডে এসব অনুষ্ঠান চলে তার মানে অনুমান করাও কঠিন। এরপর আছে রিয়েলিটি শো নামক ব্যবসাবান্ধব অনুষ্ঠান। সে জন্য বলে বাস্তব যখন অবাস্তবতায় কদর্য হয়ে যায় তখন ধৈর্য ধরে সেটা সহ্য করা অনিবার্যভাবেই অসহ্য হয়ে যায়। আজকালকার বাস্তবতা বা রিয়েলিটি শোয়ের অবস্থাও তেমনি। তারপরও শির উঁচু করে বীর বেশে অনেক চ্যানেল এসব চালিয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু চ্যানেলের মালিক নিজেরাই নেমে পড়েছেন অনুষ্ঠান নির্র্মাণে। নানা নামের অনুষ্ঠান করে পর্দা ভরিয়ে তুলছেন। আর আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আত্মপ্রচার করছেন। যা বেশ রসময়। আসলে প্রাইভেট টেলিভিশনগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অনেক কিছুই করতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের দায়িত্ব অনেক। তাই বিটিভিকে তার মূল কথা-শিক্ষা, তথ্য ও বিনোদন মেনে চলতে হয়।

বাণিজ্যিক টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মান যাই হোক, বছর শেষে রয়েছে এদের ১ থেকে ২০/২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন। যা কখনো হাস্যকর, কখনো বিরক্তিকর, কখনোবা বিস্ময়কর। কখনো এসব অনুষ্ঠানকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান কিংবা শীতকালীন পিকনিক মনে হয়। হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই এসে বর-কনেকে হলুদ দেয় আর এখানে এসে সবাই শুভেচ্ছা দেয়। প্রতি বছরই কেক কাটার ছুরি নিয়ে কিছু চেনা মুখের কেকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, একজন আর একজনকে কেক খাইয়ে দেওয়া, মুখে লেপ্টে থাকা কেকের ক্রিম মুছে দেওয়ার জন্য টিস্যু পেপার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা, আর শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে আগত অতিথিদের প্রতি চ্যানেলে একই ধরনের কথা বলা দেখতে দেখতে দর্শকরা বিরক্ত। এসব দেখে কেউ কেউ মজা করে মন্তব্য করেছেন, দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ২/১টি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিদের নাম গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়া উচিত। কারণ সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। যা তারা আনন্দের সঙ্গেই করেন। এবারে ইত্যাদি প্রসঙ্গে আসা যাক। তিন দশক পেরিয়ে চার দশকে চলছে ইত্যাদি। তাই বলে আমরা কিন্তু এই এক, দুই, তিন দশক পূর্তিতে ফূর্তি করে কোনো পূর্তি অনুষ্ঠান করিনি। শুধু ২৫ বছর পূর্তিতে আমরা একটি প্রামাণ্য অনুষ্ঠানের মতো করেছিলাম। যেখানে কোনো শিল্পী বা নাচ-গান ছিল না, ছিল না তথাকথিত আইটেম সং মার্কা নৃত্য-গীত। আসলে পৃথিবীর বড় বড় কোনো চ্যানেলই এই জাতীয় বার্ষিকী পালন করে না। সিএনএন, বিবিসি, আল-জাজিরা এমনকি ভারতের স্টার প্লাস বা সনিও না। কিন্তু আমাদের দেশে কেন যে এটা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ল তা বোধগম্য নয়। এ দেশে যখন কোনো চ্যানেলের জন্ম হয়নি, তখন থেকেই আমরা ইত্যাদিকে স্টুডিওর চার দেয়াল থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেই। শুরু করি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠান ধারণ। আমরা মনে করি শিকড় ছাড়া যেমন গাছ বাঁচে না, তেমনি শিকড় না চিনলে বাঁচে না মানুষের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রথমেই গুরুত্ব দেই ধারণ স্থানের অর্থাৎ সেই জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ওপর। সেই ধারাবাহিকতায়ই এবার আমরা গিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জে। লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতের বিশাল ভান্ডার এই কিশোরগঞ্জ, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ, ঐতিহাসিক ও অনেক কীর্তিমান ব্যক্তিদের জন্মস্থান এ কিশোরগঞ্জ। এ ছাড়াও বাংলাদেশের তিনজন রাষ্ট্রপতির জন্মস্থান এ কিশোরগঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার সমগ্র অঞ্চল এবং তাড়াইল, নিকলী, বাজিতপুর ও ভৈরব উপজেলার আংশিক এলাকা নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। কেবল ভূপ্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণে নয়- অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও এ হাওরের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হাওর মূলত সাগর শব্দের অপভ্রংশ। শুকনো মৌসুমে হাওর মানে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধুলোউড়া মেঠোপথ, রুপোলি নদী। বর্ষায় এই রুপোলি নদীগুলোই ফুঁসে ওঠে। দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে সমগ্র অঞ্চল। কিশোরগঞ্জের অর্থনীতির চালিকাশক্তি অনেকটা হাওরের ওপর নির্ভরশীল। বর্ষা মৌসুমে হাওরে যেমন প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, তেমনি শুকনো মৌসুমে কিশোরগঞ্জের পাট, ধান এবং অন্যান্য অনেক সবজি পাওয়া যায়। যা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়।

এ কিশোরগঞ্জে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ধারণের দুই মাস আগে থেকেই শুরু হয় ধারণ স্থান অনুসন্ধান। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি প্রথম আমরা কিশোরগঞ্জ যাই। ২/১টি হাওর ঘুরতে ঘুরতেই সন্ধ্যা নেমে যায়। ফিরে আসি ঢাকায়। পরবর্তীতে আবারও কিশোরগঞ্জ যাই আগস্টের ২৫ তারিখ। সিদ্ধান্ত নেই, যে করেই হোক একটি স্থান এবার খুঁজে বের করতেই হবে। আর সেটা হতে হবে হাওর অঞ্চল। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানলাম মিঠামইন, ইটনা, অষ্টগ্রাম এসব উপজেলায় রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল এবং এসব স্থানে সেপ্টেম্বর মাসেও পানি থাকে। যাত্রা শুরু করলাম মিঠামইনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্পিডবোটে ওঠার জন্য যখন চামড়াঘাট পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে রাত ৮টা বাজে। ঘাটে পৌঁছে দেখি কীভাবে যেন খবর পেয়ে করিমগঞ্জ থানার ওসি তার দলবল নিয়ে ঘাটে উপস্থিত। বললেন রাতের বেলা হাওরে যাওয়াটা নিরাপদ নয়। অনেক সময় এখানে ছিনতাইকারীরা পর্যটকদের ওপর হামলা করে। তাছাড়া রাতে দিকভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। যে কারণে এসব হাওরে রাতের বেলা নৌকা-ট্রলার-স্পিড বোট চলে না। কিন্তু আমরা নিরুপায়, আমাদের যেতেই হবে। যেহেতু ইত্যাদি প্রচারের একটি নির্দিষ্ট তারিখ আছে। সেই হিসেবে হাতে সময় কম। তাই ধারণ স্থান ঠিক না হলে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা যাবে না, পিছিয়ে যাব। ওসি সাহেব আমাদের দুজন অস্ত্রধারী পুলিশ এবং একজন সাব ইন্সপেক্টর দিলেন। আমরা যাত্রা শুরু করলাম। রাতের বেলা হাওর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হলো স্পিড বোট যেন এগোচ্ছে না। প্রচন্ড ঢেউ। সঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ছাতা ধরার উপায় নেই। প্রচন্ড বাতাসে ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। অগত্যা আর কী করা। রাত সাড়ে ৯টায় গিয়ে পৌঁছলাম মিঠামইনে। আমাদের বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ি এখানেই। মিঠামইনকে দেখে মনে হলো বিরাট সাগরের বুকে ছোট্ট একটি দ্বীপ। অনেকটা সেন্টমার্টিনস দ্বীপের মতো। তবে গোছানো। মিঠামইন থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিভিন্নস্থান দেখলাম কিন্তু ইত্যাদির হাজার হাজার দর্শক বসতে পারার মতো তেমন কোনো হাওরবেষ্টিত স্থান দেখলাম না। রাত তখন সাড়ে ১০টা। ভিতরে টেনশন কাজ করছে। আমাদের আবারও দেড় ঘণ্টা হাওর পাড়ি দিয়ে চামড়াঘাট যেতে হবে। আবার আকাশের অবস্থাও ভালো না। কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ফিরে যাওয়ার সময় পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, যাওয়ার সময় হামিদপল্লীটা দেখে যেতে পারেন। যদিও ওখানে অনেক জঙ্গল। আপনাদের পছন্দ হবে কিনা জানি না। শেষ সম্ভাবনা হিসেবে স্পিড বোটে উঠলাম-চললাম হামিদপল্লী। রাত তখন ১১টা। চারদিকে অথৈ পানি। মাঝখানে দ্বীপের মতো একখ- ভূমি। স্পিড বোট থামিয়ে নামলাম হামিদপল্লীতে। অন্ধকার রাত কেউ একজন বললেন সাবধানে যাবেন। এই ছনের বনে প্রচুর সাপ আছে। শুনে হাঁটার গতি কমে গেল। সঙ্গীরা এখানে অনুষ্ঠান করা অসম্ভব বলে মনে করলেও আমার কেন জানি জায়গাটি অসম্ভব পছন্দ হলো। যদি এই জঙ্গল পরিষ্কার করা যায় তবে এটিই হবে কিশোরগঞ্জে হাওর অঞ্চলে ইত্যাদি করার উপযুক্ত স্থান। কারণ এই স্থানটির চারদিকেই রয়েছে হাওর। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্পিড বোটে উঠলাম, গন্তব্য চামড়াঘাট। কিছুদূর যাওয়ার পরই শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। খোলা স্পিড বোট। রাত তখন ১১:৩০টা। একদিকে রাস্তা হারানোর ভয়, অন্যদিকে ঢেউয়ের দোলা এবং বৃষ্টি, সঙ্গে ক্ষুধার জ্বালা। সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। সঙ্গে আবার ২-৩ জন সঙ্গী সাঁতার জানে না। তারা রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। সব মিলিয়ে বেশ ভয়ঙ্কর একটি পরিস্থিতি। এভাবেই এক ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে রাত প্রায় ১টার দিকে এসে পৌঁছলাম চামড়া ঘাটে। অতঃপর রওনা দিলাম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। পরদিন খবর রটে গেছে আমরা ইত্যাদি করার জন্য হামিদপল্লী বেছে নিয়েছি। যেহেতু মিঠামইনে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ি, তাই সেখানে তার অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক তার সন্তান। তিনি ছাড়াও মহামান্যের ছোট ভাই আবদুল হক স্থানীয় একটি কলেজের অধ্যক্ষ। সম্ভবত তাদের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সচিব এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছেও খবরটি পৌঁছে যায়।

মিঠামইনে ইত্যাদি হবে জেনে তিনিও খুশি হন। এই পুরো ছনের বন পরিষ্কার করে অনুষ্ঠান ধারণের উপযোগী করতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণ। সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় হাওরের মাঝখানে জনবিচ্ছিন্ন একটি অসমতল ছনের বন মুহূর্তেই হয়ে উঠে ইত্যাদি ধারণের জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন স্থান। এ ক্ষেত্রে একজনের নাম না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন মিঠামইন সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরীফ কামাল। যার উদ্যোগে এই হামিদপল্লী গড়ে উঠেছে। তিনি টানা ১৫-২০ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম করে বড় বড় ট্রলারে ভেকু এবং ট্রাক এনে জঙ্গল কেটে অসমতল ভূমিকে সমতল করে ইত্যাদি ধারণ উপযোগী করে তোলেন এই হামিদপল্লীকে। করিৎকর্মী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শরীফ কামালকে দেখে মনে হয়েছে এসব অঞ্চলে উন্নয়নের গতি আনার জন্য এমনি কর্মঠ চেয়ারম্যান আরও প্রয়োজন। তার কাছ থেকে জানলাম হামিদপল্লীর ইতিহাস।

২০১৫ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বর্তমানে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, খরস্রোতা ঘোড়াউত্রা নদীর ভাঙন থেকে মিঠামইন থানাসহ আরও কিছু এলাকা রক্ষার জন্য নদীর গতিপথ সোজা করতে কয়েকটি স্থানে নদী খননের ব্যবস্থা করেন। খননকৃত মাটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির পরামর্শে একটি স্থানে স্তূপ করে একটি গ্রাম তৈরি করা হয়। যেখানে পুনর্বাসন করা হয় নদী ভাঙনে নিঃস্ব দরিদ্র মানুষদের। মহামান্য রাষ্ট্রপতির নামেই স্থানটি নামকরণ করা হয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদপল্লী।

পরিষ্কারের পর নির্দিষ্ট দিনে শুরু হয় ধারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন। পল্লী বিদ্যুৎকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতায় হাওরের ওপর দিয়ে দীর্ঘপথ পিলার বসিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। তারপর নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা থেকে অনুষ্ঠানের লাইট, সেট, সাউন্ডসহ নানান উপকরণ নিয়ে কয়েকটি ট্রাক কিশোরগঞ্জ হয়ে ২ ঘণ্টার হাওর পাড়ি দিয়ে হামিদপল্লীতে আসে। তারপর শুরু হয় মঞ্চ নির্মাণ। যেহেতু নৌকা ছাড়া এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে যাওয়ার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই, তাই দর্শক কীভাবে আসবে মাঝে মাঝে সেই চিন্তাটা পেয়ে বসত। তবে সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে ধারণের দিন সকাল থেকেই কিশোরগঞ্জ শহর, করিমগঞ্জ, ইটনা, অষ্টগ্রাম, ভৈরব, নিকলী, কটিয়াদী, হোসেনপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত নৌকা-ট্রলারে করে হাজার হাজার মানুষ আসতে থাকে হামিদপল্লীতে। ইত্যাদির ধারণ উপলক্ষে কিশোরগঞ্জে ছিল উৎসবের আমেজ। তাই তো স্থানীয় সংসদ সদস্য অনেকটা আবেগাপ্লুত কণ্ঠেই বললেন, ‘আজ হাওরে উৎসবের রব পড়েছে। এখানে ইত্যাদি হবে।’ হাওরের মাঝখানে ছোট্ট এই পল্লীটির চারদিকে হাজার হাজার নৌকা-ট্রলারের সারি এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল। এ যেন হাওরের বুকে নৌকার মেলা। বিকালের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় অনুষ্ঠানস্থল। হাওরের মাঝখানে এ যেন জনসমুদ্র। এত দুর্গম অঞ্চলে অনুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও অনুষ্ঠানস্থলে লক্ষাধিক দর্শক সমাগম হয়েছিল। এবারের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে হাওর অঞ্চলে বারবার যাওয়া-আসা এবং থাকার কারণে কিছু উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি হাওরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা এই মানুষগুলোর মধ্যে রয়েছে বুকভরা আন্তরিকতা। এই হাওরে প্রকৃতি আছে, আছে শৈল্পিক রূপ। বিদেশি গান নয়- আছে ভাটির গান, মাটির গান। যা শুনলে মন জুড়িয়ে যায়। শহরের মতো জনসংখ্যার চাপ নেই, আছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানে সবই ভেজালমুক্ত তাজা খাবার। ভাতের স্বাদই আলাদা। কারণ হাওরে উজানে পলিমাটি আসে। ওই মাটিতে চাষ করা যে কোনো ফসলই ১০০% খাঁটি। বিষ দিতে হয় না। ওই মাটির ঘাস এবং অন্যান্য খাবার খায় ছাগল, হাঁস-মুরগি। তাই ওই এলাকার মাছ, মাংস, দুধ সব খাঁটি এবং অসম্ভব স্বাদের।

দেশের অনেক স্থানে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলতে শুনেছি। সামনে কিছু না বললেও পেছনে দুর্নাম করার লোকও দেখেছি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির এই মিঠামইন এলাকাটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ মিঠামইনের প্রতিটি মানুষই যেন তার পরিবারের সদস্য। তাদের কাছে তিনি একজন সাদামাটা মনের সহজ-সরল-নির্দোষ মানুষ। তার অন্তরজুড়ে মিঠামইন আর মিঠামইনের মানুষ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থানে গিয়েও যার ব্যক্তিত্বের এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এবারের ইত্যাদির জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। স্বল্প সময়ের দেখা আর কথা বলার সুযোগে মনে হয়েছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই মিঠামইনের একজন মিঠামনের মানুষ। যাকে সবাই ভালোবাসেন।

 লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর