বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব

অধ্যক্ষ এ কে এম ফরিদউদ্দিন খান

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় আমার বয়স আট-নয় বছর। সবে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু। আমাদের সময়ে একটু বয়স হওয়ার পরই ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো হতো। বয়স কম হলেও নির্বাচনের মিছিল-মিটিংয়ের কথা মনে আছে। ওই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক নৌকা আর মুসলিম লীগের হারিকেন। চারদিকে নৌকার জোয়ার। দেবিদ্বার নির্বাচনী এলাকায় যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। মিছিলে স্লোগান হতো- ‘মোজাফফরকে দিলে ভোট/শান্তি পাবে দেশের লোক। মফিজ মিয়াকে দিলে ভোট/পাইবে একটা ছিঁড়া কোট। মফিজ উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী, মুসলিম লীগের প্রার্থী। নির্বাচনে মোজাফফর আহমদ অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমার বাবার বয়সী। ছোটবেলায় বাবার কাছে মোজাফফর আহমদ সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি।

১৯৬৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ি। কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে অনেক বড় বড় নেতার বক্তৃতা শুনেছি। তখন পাকিস্তান আমল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক নেতা বক্তৃতা করেছেন এই টাউন হল ময়দানে। তার মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সীমান্ত শার্দূল গাফফার খানের ছেলে ওয়ালি খান, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, সবুর খান, আজগর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রমুখ।

১৯৬৮ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পড়ি। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। রেসকোর্সের একটি মেসে থাকতাম আমরা নয়জন। আমাদের মেসের কাছেই ছিল ‘ইলাইট রেস্ট হাউস’, অধ্যাপক মোজাফফর কুমিল্লায় এলে এ রেস্ট হাউসে থাকতেন। একদিন বিকালে আমাদের খবর দেওয়া হলো ওই রেস্ট হাউসে মোজাফফর সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন তখন পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি। রাত ৮টার দিকে আমরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। আমাদের বসতে দেওয়া হলো। একটু পরে অধ্যাপক সাহেব এলেন এবং বসলেন, এক এক জন করে আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। আমার পরিচয় জানার পর অধ্যাপক সাহেব আমাকে লক্ষ্য করে একটি গল্প বলেছিলেন, যা আমি ভুলতে পারিনি। তিনি বললেন, ‘আমরা যখন ছোট তখন আমাদের বাড়ির লোকেরা তোমাদের বাড়িতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, ওই অনুষ্ঠানে খাবারের পরে পায়েস দেওয়া হয়েছিল এবং পায়েসে কিশমিশ ছিল। আমাদের বাড়ির লোকেরা এর আগে কখনো কিশমিশ খায়নি। তারা বাড়ি এসে গল্প করেছিল, খান বাড়িতে খাবারের সঙ্গে কামাইল্লার গোটা দিয়েছে।’ তিনি আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করলেন আবুল হাসেম খান তোমার কী হন? আমি বললাম চাচা। তিনি বললেন, হাসেম খান আমার ভাগ্নিজামাই। তিনি আমাকে আরও বললেন, তুমি কুলীন বাড়ির ছেলে। অধ্যাপক সাহেবের সেই গল্প এখনো আমার মনে আছে।

১৯৭৩ সাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মুরাদনগর থানার পাঁচটি ইউনিয়ন ও দেবিদ্বার থানা নিয়ে একটি নির্বাচনী এলাকা। ওই নির্বাচনী এলাকায় কুঁড়েঘর মার্কা নিয়ে মোজাফফর আহমদ প্রার্থী এবং নৌকা প্রতীকে ক্যাপ্টেন সুজাত আলী। সম্ভবত ৭ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনের হাঁকডাক যখন শুরু হয় তখন একদিন সকালে দেখি আমাদের ঘরের দেয়ালে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ছবিসহ একটি বড় পোস্টার লাগানো। ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আমার এক মামা আমাকে ও পাশের গ্রামের খালেক ভাইকে এলাহাবাদ মোজাফফর আহমদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে ন্যাপের অনেক নেতা-কর্মী উপস্থিত। নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হলো। তারপর দক্ষিণ মুরাদনগরের পাঁচটি ইউনিয়নের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো খালেক ভাই ও আমাকে। মোজাফফর আহমদকে বিজয়ী করার জন্য অনেক খেটেছিলাম। মিটিং-মিছিল করেছি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়েছি। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে পাঁচ ইউনিয়নের চূড়ান্ত মিছিলে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগের মিছিলে আমাদের চেয়ে বেশি লোক হয়েছিল। মিটিংয়ে মোজাফফর আহমদ ও মতিয়া চৌধুরী বক্তৃতা করতেন। মিছিলে আমরা স্লোগান দিতাম ‘গোলটেবিলের মোজাফফর/মার্কা তার কুঁড়েঘর, ন্যাপ নেতা মোজাফফর/মার্কা তার কুঁড়েঘর’। আর আওয়ামী লীগের মিছিলে স্লোগান হতোÑ ‘মোজাফফরের কুঁড়েঘর/ভাইঙা-চুইরা নায়ে ভর’। আরও বলতÑ ‘তোরা সব ইন্না লিল্লাহ পড়/ছনের ঘরে মইরা রইছে বীর মোজাফফর’ ইত্যাদি। নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে মোজাফফর আহমদ হেরে গিয়েছিলেন।

 

১৯৭৯ সাল। মোজাফফর আহমদ আবারও দেবিদ্বার থেকে পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন। ভিআইপি পাস নিয়ে আমি মাঝেমধ্যে পার্লামেন্ট অধিবেশন দেখতে যেতাম। একদিন পার্লামেন্টে ‘ফরেন পলিসি’র ওপর আলোচনা হচ্ছিল। মুসলিম লীগের অ্যাডভোকেট মতিন অধ্যাপক মোজাফফরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি আমার বন্ধু মোজাফফরকে কিছু বলব না। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমার কিছু কথা আছে, তবে আমার বন্ধু রাশিয়ায় বৃষ্টি হলে বাংলাদেশ থেকে ছাতা ধরে।’ মিস্টার মতিন খুব উচ্চৈঃস্বরে কথাগুলো বলছিলেন। সামনের সিট থেকে মোজাফফর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে মতিন! তুই আস্তে কথা বল, তোর কথা মস্কো থেকে শোনা যাবে।’ মাগরিবের নামাজের বিরতির সময় অধ্যাপক মোজাফফর আর অ্যাডভোকেট মতিন আন্তরিকতার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন।

১৯৭৯ সালে একদিন বিকালে ধানমন্ডিস্থ হকার্স মার্কেটের অফিসে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। এদিন তিনি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেন। আমি বললাম, ‘স্যার! আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করুন।’ তিনি বললেন, ‘আপনি এখন শিক্ষক সুতরাং আপনাকে আপনি বলেই সম্বোধন করব।’

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কাকরাইলের বাসায় অনেকবার গিয়েছি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের সময় যখন তার বাসায় যাতায়াত করতাম তখন তার একমাত্র মেয়ে আইভি আহমদ সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। মিসেস আমেনা আহমদের সঙ্গেও আমার পরিচয় ছিল। তিনি ’৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ প্রয়োজনে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মোজাফফর আহমদের গ্রামের বাড়িতে কয়েকবার গিয়েছি। গ্রামের বাড়িতে একটি কুঁড়েঘর ছিল। এ ঘরের সামনে একটি বড় মাঠ। যে মাঠে মোজাফফর আহমদ সভা-সমাবেশ করতেন। সেখানে অনেক গুণীজন অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। যারা উপস্থিত থাকতেন তার কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছিÑ পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, কবি সুফিয়া কামাল, প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমান প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর