বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চিকিৎসকদের নিয়োগ পদ্ধতি

জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী

চিকিৎসকদের নিয়োগ পদ্ধতি

বর্তমানে সব চিকিৎসকের নিয়োগ কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে হয়। ২০% অনধিক ভাগ্যবান তদবির ও আর্থিক বিনিয়োগসাপেক্ষে সরাসরি মেডিকেল কলেজগুলোয় ট্রেনিং পোস্টের বিপরীতে নিয়োগ পান। বাকিরা ইউনিয়ন, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ পান। নির্বাচিত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চিকিৎসকদের নিয়োগ ও তদারকিতে কোনো ভূমিকা নেই। ফলে ঢাকাস্থ মনিবদের খুশি করে নবীন-প্রবীণ চিকিৎসকরা কর্মস্থলে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন-ভাতা তুলতে পারেন। এর অধিকাংশই প্রভাবশালী আমলা, ব্যবসায়ী ও বিত্তবানের সন্তান-সন্ততি। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন অর্জিত হলে মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে তাদের অবস্থান  পাকাপোক্ত হয়ে যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর আবেদন অগ্রাহ্য করে তারা প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিসের পরিবর্তে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চুটিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যাপৃত হন। স্বাস্থ্য বিভাগে চিকিৎসকদের উন্নতির স্তর অত্যন্ত সীমিত। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে একজন তরুণ চিকিৎসক সহকারী সার্জন হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অধিকাংশের কর্মজীবনের অবসান ঘটে সহকারী সার্জন হিসেবেই। ১০% অনধিক মেডিকেল অফিসার জেলা সিভিল সার্জন পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন জীবনের সায়াহ্নে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের শীর্ষ পদগুলো বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তাদের দখলে। এটা ক্ষোভের বড় কারণ।

উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং চিকিৎসকদের উজ্জীবিত করার নিমিত্ত বিসিএস (মেডিকেল)-এর পরিবর্তে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো বাংলাদেশ মেডিকেল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব সমন্বয়ে প্রতি জেলায় স্বশাসিত জাতীয় স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ফলে চিকিৎসকরা নিজের পছন্দমতো কর্মস্থল বেছে নিতে পারবেন। বাসস্থান, ছেলেমেয়ের শিক্ষা, কাজের অনুকূল পরিবেশ ও উচ্চতর গ্রেডে কর্মসংস্থান বিবেচনায় চিকিৎসকরা একই স্থানে কিংবা কয়েক বছর পরপর কর্মস্থল বদলাতে পারবেন। জনপ্রশাসন বিভাগ নয়, চিকিৎসক নিজেই হবেন নিজের কর্মের নিয়ামক। জেলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সব চিকিৎসকের চাকরির নিরাপত্তা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে চিকিৎসকদের উন্নতির ন্যূনতম তিনটি স্তর ও উপজেলা পর্যায়ে চারটি স্তর সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। কেন্দ্রীয় সরকার জেলা স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করবে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের পরিচালকের পদমর্যাদা হবে ডেপুটি সিভিল সার্জনের, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিচালকের পদমর্যাদা হবে অতিরিক্ত সিভিল সার্জনের (Additional Civil Surgeon) সমতুল্য। ডেপুটি সিভিল সার্জন পদমর্যাদায় ডেপুটি সেক্রেটারি এবং অতিরিক্ত সিভিল সার্জন জয়েন্ট সেক্রেটারি সমতুল্য হবেন এবং সে মোতাবেক তাদের সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

বর্ধিত ইন্টার্নশিপ প্রসঙ্গে : বর্তমানে নবীন চিকিৎসকদের চিকিৎসাসংক্রান্ত নিবন্ধন পাওয়ার জন্য এক বছরের বাধ্যতামূলত ইন্টার্নশিপ চালু আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ, জাতি ও চিকিৎসকদের স্বার্থে ইন্টার্নশিপ বাড়িয়ে দুই বছর করার লক্ষ্যে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। সদ্য পাস নবীন চিকিৎসকরা প্রথম বছর নিজ নিজ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিবিড় প্রশিক্ষণ নেবেন। দ্বিতীয় বছর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে (UHFWC) সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থান করে স্থানীয় জনসাধারণকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে জ্ঞানার্জন করবেন। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

ভুল কাজ হবে : ইন্টার্নদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠাতে হবে, উপজেলায় নয়। তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো ভুল কাজ হবে। দেশে প্রায় ৫০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। বর্তমানে প্রতিটিতে ১০ জনের বেশি চিকিৎসক আছেন; যার অনেকে অনুপস্থিত থাকেন। প্রতি উপজেলায় ২০ জন ইন্টার্নশিপ পাঠালে নিয়মিত চিকিৎসকরা আরও বেশি অনুপস্থিত হবেন, সেবা বা প্রশিক্ষণ কোনোটাই হবে না।

লাভবান হবেন তরুণ চিকিৎসকরা : বর্ধিত ইন্টার্নশিপের ফলে নবীন চিকিৎসকরা সবচেয়ে লাভবান হবেন। বর্ধিত ইন্টার্নশিপ প্রকৃতপক্ষে এক বছর মেয়াদি চাকরিতুল্য, এক বছরের পূর্ণ বেতন পাবেন। দুই বছর ইন্টার্নশিপ শেষ হলে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে তাদের পূর্ণ নিবন্ধন হবে। এই সময়ে প্রকৃতির নিসর্গ পরিবেশে অবস্থান করে তরুণ চিকিৎসকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশোনা করে উচ্চতর ডিগ্রির প্রাথমিক ধাপে পরীক্ষায় প্রস্তুতি নিতে পারবেন।

নবীন চিকিৎসকরা সার্বক্ষণিক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অবস্থান করে স্থানীয় জনসাধারণকে সেবা দেবেন। ভবিষ্যতে বিভিন্ন মেডিকেল, ডেন্টাল, নার্সিং ও ফিজিওথেরাপির শিক্ষার্থীরা ইউনিয়ন ও উপজেলায় গেলে তাদের ক্লাস নেবেন। কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক পরিচর্যা কর্মীদের সুপারভাইজ করবেন ও রেফার করা রোগীদের চিকিৎসা দেবেন। বর্ধিত ইন্টার্নশিপ কার্যকর হলে এ বছরই অতিরিক্ত ১০ হাজার  নিয়মিত মেডিকেল অফিসারের পদে নিয়োগ ও বিভিন্ন কাজের জন্য প্রণোদনা ভাতা (Incentive) পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অদূর ভবিষ্যতে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাইমারি বিশেষজ্ঞ পদ সৃষ্টির সমধিক সম্ভাবনা আছে। সর্বত্র চিকিৎসকরা নন্দিত হবেন। এ সুযোগ তরুণ চিকিৎসকদের হেলায় হারানো উচিত হবে না। ১৯৯০ সালে নবীন চিকিৎসকরা কিছু প্রবীণ চিকিৎসকের চক্রান্তে প্রস্তাবিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, প্রায় সব দেশে চিকিৎসকরা দূরদৃষ্টির অভাবে শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনকে ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন।

জনগণ উপকৃত হবে : একটি ইউনিয়নে বর্তমানে ৩০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ বাস করে। আগামী ২০ বছরে ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ৭০ হাজার অতিক্রম করবে। বর্ধিত ইন্টার্নশিপের ফলে ইউনিয়নের জনসাধারণ নিয়মিত দুজন মেডিকেল অফিসারের অতিরিক্ত দুজন নিবেদিত আগ্রহী নবীন ইন্টার্ন চিকিৎসকের পরামর্শ ও সার্বক্ষণিক সেবা পাবেন। বয়োবৃদ্ধদের সেবা ও স্কুল স্বাস্থ্য কার্যক্রম চালু হবে, স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মীদের স্বাস্থ্য সুবিধা ও পরিবেশ উন্নত হবে, অতিদরিদ্র ও দরিদ্র পরিবার বিনামূল্যে পরামর্শ ও ওষুধ পাবে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা নির্ধারিত পরামর্শ ফি ও ওষুধের মূল্য দেবেন। অদূর ভবিষ্যতে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট হাসপাতাল ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সরকারের করণীয় : বর্ধিত ইন্টার্নশিপ একটি জনহিতকর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাহসের সঙ্গে প্রজ্ঞাপনটিকে আইনে পরিণত করুন এবং নিম্নোল্লিখিত সংস্কারগুলো ছয় মাসের মধ্যে কার্যকরের ব্যবস্থা নিন।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র আছে। অধিকাংশই দোতলা বিল্ডিং, প্রায় ১ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত, ৮ থেকে ১২টি রুম আছে, ২-৩টি পারিবারিক বাসস্থান আছে। অধিকাংশ সেন্টারে সুপেয় পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে, তবে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হওয়ায় অনেকটির অবস্থা সংকীর্ণ। বাউন্ডারি ওয়াল না থাকায় নিরাপত্তার শঙ্কা রয়েছে।

১. জরুরি ভিত্তিতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি মেডিকেল অফিসার ও ইন্টার্নদের ২ হাজার বর্গফুট বাসস্থান নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিন।

২. অনধিক ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে নিম্নলিখিত চিকিৎসাসামগ্রী ও ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি প্রতি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে দিলে নবীন ইন্টার্নরা আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় জনগণকে উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে উৎসাহিত হবেন।

i. চিকিৎসাসামগ্রীগুলো হচ্ছেÑ রক্তচাপ মাপার বক্স, চক্ষু, নাক-কান-গলা পরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেট, নবজাতক ও শিশুদের শ্বাসকষ্ট নিরসনের জন্য অ্যাম্বুব্যাগ, নেবুলাইজার, ফ্লোমিটারসমেত অক্সিজেন সিলিন্ডার, সাকসন মেশিন, পলস্ অক্সিমিটার, গ্লুকোমিটার, গর্ভবতীদের অন্তস্থ শিশুর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য ফিটাল মনিটর, হৃদরোগ নির্ণয়ের জন্য ইসিজি, কার্ডিয়াক স্টেথোসকোপ, কার্ডিয়াক মনিটর, ডিফিবরিলেটর, সিরিঞ্জ পাম্প, মাইনর সার্জারির যন্ত্রপাতি ও ছোট এনেসথেসিয়া মেশিন এবং বয়োবৃদ্ধ ও দুর্ঘটনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য কয়েকটি ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতি।

ii. ল্যাবরেটরিতে রক্ত পরিসঞ্চালন সুবিধাসহ কয়েকটি যন্ত্রপাতি যথাÑ ছোট রেফ্রিজারেটর, মাইক্রোসকোপ, কলোরোমিটার, সেন্টিফিউজ, হেমোসাইটোমিটার, হিমোগ্লোবিনোমিটার, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার ও পর্যাপ্ত গ্লাসওয়ার দেওয়া হলে ৫০ রকমের রোগ নির্ণয় করা যাবে।

৩. আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রতি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে একটি ২০/২৫ শয্যার স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট হাসপাতাল নির্মাণ এবং অন্যূন পাঁচজন চিকিৎসক ও কয়েকজন ফার্মাসিস্ট, সিনিয়র নার্স, ল্যাবপ্রধান, ফিজিওথেরাপিস্ট প্রভৃতি ব্যক্তির জন্য ৫০০ থেকে ৮০০ বর্গফুটের বাসস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অতিরিক্ত ২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন হবে।

৪. ছাত্রদের অধ্যাপনার জন্য ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার চিকিৎসকদের যোগ্যতানুসারে সহপ্রভাষক, প্রভাষক, সিনিয়র প্রভাষক ও সহঅধ্যাপকের পদবি ও ভাতা দিন। বিনা ভাড়ায় বাসস্থান, গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ঋণ, তদারকি ও শিক্ষকতার জন্য প্রণোদনা, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য অতিরিক্ত ভাতা, প্রান্তিক জেলা ভাতা (Periphral Allowance) প্রভৃতি দেওয়া হলে চিকিৎসকরা মফস্বলে থাকতে উৎসাহী হবেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রণোদনা (Incentive) হতে পারে যদি আইন করা হয় যে দুই বছর মফস্বলে কাজ না করলে কেউ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। বর্ধিত ইন্টার্নশিপ নবীন চিকিৎসকদের জন্য উন্নতির সোপান সৃষ্টি করবে। জনগণ পাবে ন্যূনতম খরচে আধুনিক চিকিৎসাসুবিধা। সাধারণ মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণ সহজেই সম্ভব। প্রমাণ হবে- দেশ কার? সাধারণ মানুষের না লুটেরা ধনীদের।

জনপ্রতি মাত্র ৫০০ টাকা বিনিয়োগে প্রতি ইউনিয়নে সৃষ্টি হবে আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভিত্তি। এই বিনিয়োগ হবে জনস্বার্থে প্রধানমন্ত্রীার সদিচ্ছার প্রমাণ।

                লেখক : গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর