শিরোনাম
শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

লিবার্টি দ্বীপ ও ডালাসে

আতাউর রহমান

লিবার্টি দ্বীপ ও ডালাসে

গল্প আছে, আমাদের দেশের একটি বাচ্চা মেয়ে স্কুলের পরীক্ষার খাতায় ওয়াশিংটন ডিসির পরিবর্তে নিউইয়র্ককে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী লিখে দিয়ে এসে রাতভর এই প্রার্থনা করে কাটিয়ে দিয়েছিল যে, ‘হে আল্লাহ! নিউইয়র্ককে আমেরিকার রাজধানী বানিয়ে দাও।’ বাস্তবিক, ওয়াশিংটন ডিসি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও জাতিসংঘের সদর দফতর ও সর্ববৃহৎ শহর হওয়া ইত্যাদি কারণে নিউইয়র্ক আমেরিকার সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নগরী।

ভাবতে অবাক লাগে, সপ্তদশ শতাব্দীতে ওলন্দাজ অভিবাসীরা মাত্র ২৪ ডলার মূল্যের জিনিসপত্রের বিনিময়ে জায়গাটি রেড ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে কিনে এর নামকরণ করেন নিউ আমস্টারডাম। অতঃপর সেই শতাব্দীতেই ওটা ইংরেজদের দখলে গেলে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নিউইয়র্ক; এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ শেষে পটোম্যাক নদী-তীরবর্তী বর্তমান রাজধানীর স্থানটিকে নির্বাচনপূর্বক প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের নামানুসারে নামকরণের আগে প্রায় সাত বছর নিউইয়র্কই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। প্রায় ১ কোটি নাগরিক অধ্যুষিত বর্তমান নিউইয়র্ক নগরী, যেটা ম্যানহাটান, ব্রনজ, ব্রুকলিন, কুইনস ও লং আইল্যান্ড শীর্ষক পাঁচটি বরোতে বিভক্ত, সেটার দর্শনীয় দিক হচ্ছে- ম্যানহাটানস্থ জাতিসংঘের ৩৯ তলাবিশিষ্ট বিল্ডিং ছাড়াও অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংসহ অসংখ্য গগনচুম্বী অট্টালিকা, চায়না টাউন ও লিটল ইতালির স্বাদ ও গন্ধ, জ্যামাইকা ও জ্যাকসন-হাইটসের ভারতীয় ও বাংলাদেশি বিপণিবিতান, টাইমস স্কয়ারের আলোকসজ্জা ইত্যাদি। আর ৯/১১-এর পর ধ্বংসপ্রাপ্ত ১১০ তলাবিশিষ্ট ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জায়গায় বর্তমানে যে ফ্রিডম টাওয়ারটি নির্মিত হয়েছে, সেটারই বা পর্যটন-আকর্ষণ কম কোথায়?

সে যাই হোক। পৃথিবীর প্রতিটি বৃহৎ নগরীর নিজস্ব একটি আইকন তথা প্রতীক থাকে। লন্ডনের যেমন বিগ-বেন ঘড়ি, প্যারিসের যেমন আইফেল টাওয়ার, সিডনির যেমন অপেরা হাউস, কায়রোর যেমন পিরামিড, মক্কার যেমন কাবাঘর। তদ্রƒপ নিউইয়র্কের আইকন হচ্ছে একটি ব্রোঞ্জমূর্তি, যেটাকে বলা হয় স্ট্যাচু অব লিবার্টি তথা স্বাধীনতার শিলামূর্তি এবং যেটা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার শতবার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রান্সের জনগণ ভালোবাসা ও সহমর্মিতার নিদর্শনস্বরূপ ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। নিউইয়র্ক পোতাশ্রয়ে অবস্থিত লিবার্টি নামক যে ক্ষুদ্র দ্বীপে এটি স্থাপিত সেটি নিউইয়র্ক স্টেটেরই অংশবিশেষ। প্রাচীন রোমের পৌরাণিক কাহিনিতে দাসপ্রথা ও উৎপীড়ন থেকে মুক্তিদানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম ছিল লিবার্টি। যার মুখের আদলেই নাকি মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে। আর মূর্তিটির মাথায় যে সাতটি গজাল পরিলক্ষিত হয়, সেগুলো নাকি প্রতিনিধিত্ব করে সাত সমুদ্র ও সাত মহাদেশের। অধিকন্তু দেবীর ডান হাতে রক্ষিত মশালের মানে হচ্ছে ‘এনলাইটেনমেন্ট’ তথা আলোকিতকরণ; আর বাঁ-হাতে রক্ষিত ক্ষুদ্র ফলক দ্বারা নাকি বোঝানো হচ্ছে ‘জ্ঞান’ আর এটিতে রোমান অক্ষরে লেখা আছে আমেরিকান জাতির জন্ম-তারিখ-৪ জুলাই, ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দ। সর্বোপরি শিলামূর্তিটি এমন কৌশলে তৈরি যে, বাতাস ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে প্রবাহিত হলে ওটা নাকি ৩ ইঞ্চি ও মশালটি ৫ ইঞ্চি দোল খায়। কী অপূর্ব মানুষের বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী শক্তি!

প্রিয় পাঠক! এসব তথ্য কিছুই জানা হতো না, যদি না আমি ২০০০ সালে দ্বিতীয় দফায় সস্ত্রীক আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শন করতে যেতাম। পয়লা দফায় দর্শন করা হয়নি সময়স্বল্পতার কারণে। তা ছাড়া সেটা ছিল শীতকাল, আর শীতকালে লিবার্টি দ্বীপে যাওয়ার ফেরি বন্ধ থাকে। এবারে ফেরিযোগে দ্বীপটিতে পৌঁছে অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে রৌদ্রস্নাত দিবালোকে শুধু স্ট্যাচুই দেখা হলো না, পুরো দ্বীপটাই ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। স্মারক আলোকচিত্রও তোলা হলো, আর মৌসুমী ভৌমিকের জনপ্রিয় একটি গানের কলি অনুসারে, ‘ডানা মেলা গাঙচিলেও চোখ রাখা হলো’। অভূতপূর্ব এই অভিজ্ঞতা বর্ণনার অতীত।

এবারে চলে আসি আট বছর পরের তৃতীয় অভিযাত্রায় ডালাস ভ্রমণের বর্ণনায়। আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যে অবস্থিত ডালাস জ্বালানি তেলের খনি, গগনচুম্বী অট্টালিকা আর কাউবয়দের জন্য বিখ্যাত। মনে পড়ে, আশির দশকে ডালাস শহরের পটভূমিকায় রচিত ও টিভিতে প্রদর্শিত ড্রামা সিরিয়াল ‘ডালাস’ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ভক্ত বানানো ও ডালাসের এক অখ্যাত র‌্যাঞ্চ তথা খামারবাড়িকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছিল। তবে তার আগে ১৯৬৩ সালে আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে ডালাসে সরকারি সফরকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে লি হার্ভে ওসওয়াল্ড নামের জনৈক আততায়ী গুলি করে হত্যা করায় সারা দুনিয়ায় ডালাসের নাম ছড়িয়ে পড়ে ও জায়গাটির ট্যুরিস্ট আকর্ষণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি ও আমার সহপাঠীরা সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষ ইংলিশ অনার্সের শিক্ষার্থী এবং আমাদের আমেরিকান সাহিত্য পড়াতেন এক কৃষ্ণাঙ্গী আমেরিকান লেডি প্রফেসর। হত্যাকান্ডের পরদিন ক্লাসে এসে তিনি কিছুই পড়াতে পারলেন না, কেবলই কাঁদতে থাকলেন। আর উইকিপিডিয়া অনুসারে প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিন শতকরা ৫৪ জন আমেরিকান তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তৎপরবর্তী দিনগুলোয় কেউবা কেঁদেছে, কেউবা চোখের ঘুম হারিয়েছে, কেউবা অগ্নিমান্দ্যতায় ভুগেছেন, আর কেউ কেউ বমি বমি ভাব, স্নায়বিক দুর্বলতা এবং ক্রোধেরও শিকার হয়েছেন। আবার সবাই স্মরণ করতে সক্ষম- হত্যাকা-টি যখন রেডিও-টিভিতে ঘোষিত হয় তখন কে, কোথায়, কী অবস্থায় ছিলেন।

তখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া অতটা শক্তিশালী ছিল না। তাই ওয়াশিংটন ডিসির আরলিংটন জাতীয় কবরস্থানে যখন নিহত প্রেসিডেন্ট কেনেডির লাশ সমাহিত করা হয়, তখন সংবাদ সংস্থা এএফপির ফটোসাংবাদিকের কল্যাণে কালো পোশাক পরিহিত শোকাভিভূত মিসেস জ্যাকুলিন কেনেডির পাশে দন্ডায়মান তার শিশুপুত্রের স্যালুট প্রদানরত আলোকচিত্র দুনিয়ার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে সেটা সারা দুনিয়ার সমগ্র সংবেদনশীল মানুষকে স্তম্ভিত ও শোকাভিভূত করে ফেলে। দুর্ভাগ্যবশত সেই শিশুপুত্র কেনেডি জুনিয়র পরে যুবা বয়সে স্বয়ং বিমান চালিয়ে মার্থাস ভাইনঅ্যায়ার্ড নামক বিনোদন-কেন্দ্রে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে গিয়ে জীবনসঙ্গিনী ও তদীয় ভগ্নিসহ সাগরের অতলে তলিয়ে যান। বহুদিন, বহুমাস আর বহু বিবর্ণ বিস্মৃত বছর পরে আরলিংটন কবরস্থান দেখতে গিয়ে আমি যখন সারিবদ্ধভাবে রাখা প্রেসিডেন্ট কেনেডি, মিসেস জ্যাকুলিন ওনাসিস কেনেডি (নামফলকে ওভাবেই লেখা) ও কেনেডি জুনিয়রের কবরের পাশে দাঁড়ালাম, তখন ‘রুটস’ উপন্যাসের প্রখ্যাত লেখক আলেক্স হেয়লির ভাষায় একটি বোবাকান্না আমার হাঁটুর কাছাকাছি কোথাও আঘাত করে ঊর্ধ্বপানে ধাবিত হলো এবং দুই হাত দ্বারা সবেগে মুখটাকে ঢেকে আমি অনুচ্চ কণ্ঠে আর্তচিৎকার করে উঠলাম।

প্রেসিডেন্ট কেনেডি আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় গুটিকয় বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির অন্যতম। তাই অস্টিনে অবস্থানকালে আত্মজ যখন জনক-জননীকে গাড়িতে করে ডালাসে কেনেডি যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সেস্থান এবং পাশের পুরনো কাউন্টি কোর্ট হাউসের সন্নিকটে নির্মিত জেএফকে স্মৃতিসৌধে নিয়ে গেল, তখন আমার তাৎক্ষণিকভাবে মনে পড়ে গিয়েছিল তার অভিষেক ভাষণের সেই বিখ্যাত উক্তিটি : ‘আসক নট হোয়াট ইওর কান্ট্রি ক্যান ডু ফর ইউ, আসক হোয়াট ইউ ক্যান ডু ফর ইওর কান্ট্রি- জিজ্ঞাসা কোরো না তোমার দেশ তোমার জন্য কী করতে পারে জিজ্ঞাসা কর তুমি তোমার দেশের জন্য কী করতে পারো।’ আর কেনেডি স্মৃতিসৌধের স্থপতি সম্মুখস্থ স্ট্যান্ডে যে কথাটি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তাও আমার মনে খুব ধরাতে নোটবুকে নিয়ে এসেছিলাম : এ প্লেইস অব কোয়ায়েট রিফিউজ, এন এনক্লোউজড প্লেইস অব থট অ্যান্ড কনটেমপ্রেশন সেপারেইটেড ফ্রম দ্য সিটি অ্যারাউন্ড, বাট নিয়ার দ্য স্কাই অ্যান্ড আর্থ- একটি নিরিবিলি আশ্রয়স্থল, পারিপার্শি¦ক নগর থেকে আলাদা একটি পরিবেষ্টিত ভাবনা ও ধ্যানের স্থান, কিন্তু আকাশ ও পৃথিবীর কাছাকাছি। সত্যি বলতে কি, মনে মনে স্থপতি ফিলিপ জনসনকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারা গেল না।

শেষ করছি আমেরিকান এক বুড়ো ও এক বুড়ির রম্যগল্প দিয়ে : বুড়ো বিপত্নীক ও বুড়ি বিধবা : তারা নিয়মিত ডেটিং করে আসছেন। একদিন সন্ধ্যায় বুড়ো প্রথানুযায়ী বুড়ির সামনে হাঁটু গেড়ে ডান হাতের দ্বারা একটি লাল গোলাপ ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বুড়িকে বললেন, ‘উইল ইউ মেরি মি- তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’ বুড়ি ঝটপট জবাব দিলেন, ইয়েস। বুড়ো যৎপরোনাস্তি খুশি হয়ে বুড়িকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরলেন এবং সে রাতে ভালো ঘুমও হলো। কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিলেন না বুড়ি তার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন কিনা। বয়স হওয়ায় তার স্মৃতিশক্তি অনেকটাই লোপ পেয়েছে, চোখেও ভালো দেখতে পান না, তাই ড্রাইভিং করতে অসুবিধা হয়। অথচ বুড়ি এখনো ভালো ড্রাইভিং করেন, যে কারণে বুড়িকে বিয়ে করতে এতটা উৎসাহী। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর তিনি বুড়িকে টেলিফোন করে বললেন, ব্যাপারটা খুবই বিব্রতকর। কিন্তু আমি কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিনে, আমার গতকালের প্রস্তাবে তোমার জবাব কী ছিল?

‘তুমি আমাকে বাঁচালে’, বুড়ি প্রত্যুত্তরে বলতে পারলেন, ‘আমার মনে পড়ছিল, আমি গতকাল এক ব্যক্তির বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলেছি; কিন্তু ব্যক্তিটি কে, সেটা স্মরণ করতে পারছিলাম না। তুমি টেলিফোন করতেই আমার মনে পড়েছে। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ হা-হা-হা।

 

লেখক : রম্যসাহিত্যিক। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর