বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সংকটের মুখে পোশাকশিল্প

মাহমুদুর রহমান সুমন

সংকটের মুখে পোশাকশিল্প

মারাত্মক বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প। বিদেশে পাঠানো চালান ফেরত আসছে। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। বেকার হয়ে পড়ছে শত শত শ্রমিক। জীবিকা হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে তারা। পথে বসছে অগুনতি পরিবার। ভয়ঙ্কর তথ্য : মাত্র ১৮ দিনে ২২টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও ৩০টি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ হিসাব খোদ মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। অনেক উদ্যোক্তা সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব থেকে ধার-দেনা করে বা ব্যাংক থেকে উচ্চসুদের ঋণে অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটি কারখানা গড়ে তোলেন কিন্তু লোকসানের মুখে পথে বসছেন।

কেন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এসব কারখানা? শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো দিতে না পারা, বিশ্ববাজারে কঠিন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে অগত্যা হার মানতে হচ্ছে। বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক জানিয়েছেন, দেশে আন্তর্জাতিক মানের কারখানা গড়ে উঠেছে। তার পরও বিশ্বে বিদ্যমান অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না অনেকে। আমরা বলেছি, বেতন-ভাতা দিতে না পারলে কারখানা যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো শ্রমিককে যেন অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে না হয়।

তৈরি পোশাকশিল্প খাতে এই অস্থির যে অবস্থা তাতে উৎকণ্ঠিত পর্যবেক্ষক মহল। আমরা নিকট-অতীতে দেখেছি পাটকল শ্রমিকরাও বেতন-ভাতাবঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছে। বিক্ষোভ আন্দোলনে ব্যাপৃত হতে হয়েছে তাদের। বহুমুখী সমস্যার ছোবল, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অদূরদর্শিতা ইত্যাদি বহু কারণে ওই খাতটিতে ধস নেমেছে। সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গার্মেন্ট খাতে অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি আমরা। সবাই জানেন, দেশের প্রধানতম রপ্তানি খাত হলো তৈরি পোশাকশিল্প। পুরোটাই বেসরকারি  উদ্যোগ ও  প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে এই খাত। আলাদা কোনো মন্ত্রণালয় নেই দেখভাল করার। দেশ-বিদেশের বহু বাধাবিঘ্ন, প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র পার হয়ে তৈরি পোশাকশিল্প খাত আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সেই আশা ও স্বপ্ন-স্বস্তির আকাশে ভর করেছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। কত ধরনের বাধা-বিপত্তি যে পার হতে হয়েছে হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি, গুজব রটানো, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কারখানা পুড়িয়ে দেওয়ার মতো মর্মান্তিক ও ন্যক্কারজনক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেসব উপেক্ষা করে খাতটি এগিয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বে চীনের পরই আমাদের স্থান এ খাতে। অনভিপ্রেত জটিল বাধা-বিপত্তি যেভাবে ডালপালা ছড়াচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এ খাত কতখানি ধৈর্য নিয়ে এগোতে পারবে, সে ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সম্প্রসারণ তো দুরস্ত, বর্তমান অবস্থানই ধরে রাখা সম্ভবপর হবে কিনা তাও এ মুহূর্তে বিরাট ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।

উৎকণ্ঠা-অনিশ্চয়তা কেন ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে? ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম ভারত, শ্রীলঙ্কা তাদের অগ্রযাত্রা জোরদার করেছে। নতুন নতুন বাজার ধরছে তারা। বাংলাদেশে যে একের পর এক কারখানায় লাল বাতি জ্বলছে, তার কোনো দায়দায়িত্ব কি সরকারের নেই? সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই রুগ্ন শিল্পকে বাঁচাতে হবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই। বিলম্বিত উদ্যোগ কোনো সুফল বয়ে আনবে না। এই চ্যালেঞ্জ যথাযথ বাস্তবতা ও সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে  না পারলে এর কুপ্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। আমরা জানি, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। বড় ক্ষতি হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া দরকার। সংকট উত্তরণের জন্য সমন্বিত সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মাথাব্যথা হলে ওষুধ দিতে হবে। মাথা কেটে ফেলার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। সেটা সমীচীন যেমন নয়, অভিপ্রেতও নয়। তৈরি পোশাক খাতে যে সময়ে এমন অশনিসংকেত, সে সময়ে আরও একটি নেতিবাচক খবর হতাশা আরও বৃদ্ধি করল। কী সে খবর? দেশে বড় ও মাঝারি ধরনের শিল্পকারখানার সংখ্যা কমে আসছে। অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসা পাল্টে ফেলছেন। অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করছেন তারা। প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বা অটোমেশনের অনিবার্য প্রভাব পড়ছে এই খাতে। শ্রমিকসংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে ক্রমে। ফলত শিল্পকারখানার আকার-পরিধির সম্প্রসারণ ঘটার পরিবর্তে সংকুচিত হয়ে আসছে ক্রমে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত ছয় বছরে দেশে বড় আকারের শিল্পকারখানা ৬০৮টি কমে গেছে। এ সময় পরিধিতে মাঝারি আকারের শিল্পকারখানা এক টানে নেমে এসেছে অর্ধেকে। মোট দেশজ উৎপাদন খাতের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হিসাব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এর ফলে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় ও মাঝারি ধরনের শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থানও সে রকমটি হতে দেখা যাচ্ছে না। এও অতীব উৎকণ্ঠার বিষয়। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ সূত্রের খবর, তৈরি পোশাকের উৎপাদন ব্যয় প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে এ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর বিপরীতে বিক্রয়মূল্য কিন্তু বাড়ছে না। এই সময়ে প্রধান রপ্তানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের দরপতন ঘটেছে। দরপতন  একেবারে সামান্য নয়, ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতনের অঙ্ক ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ বিপদ থেকে পোশাকশিল্পের সুরক্ষায় প্রণোদনা বাড়ানোর কথা ভাবতে হবে। পোশাকশিল্পের জন্য করসুবিধা দেওয়ার কথাও ভাবা দরকার।

                লেখক : কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর