শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

উন্মোচিত হলো ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের অপার সম্ভাবনা

শাইখ সিরাজ

উন্মোচিত হলো ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের অপার সম্ভাবনা

পাট, মহিষ ও ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচনের পর ছাগল নিয়ে গবেষণায় সাফল্য পেয়েছেন আমাদের গবেষকরা। বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের কালো ছাগল বা ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন চট্টগ্রামের একদল গবেষক। গবেষক দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এম এ এম জুনায়েদ ছিদ্দিকী। তার সঙ্গে আছেন চট্টগ্রামেরই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন গবেষক। এর আগে গত বছর এ বিষয়ের ওপর গবেষণা করে সফলতা পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বজলুর রহমান মোল্লা। গর্ব করার মতো আমাদের প্রাণিসম্পদের নিজস্ব জাত ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট’। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সামগ্রিক বিবেচনায় এই ছাগলের এ জাতকে বিশ্বসেরা বলা হয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একাংশে ছাগলের প্রাচীন এক জাত। সত্যিকার অর্থে প্রাণিসম্পদ খাতের গবেষণায় আমাদের উল্লেখযোগ্য তেমন সাফল্য নেই। আমাদের নিজস্ব জাতের উন্নয়ন কিংবা নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ৪৮ বছরে তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পরিনি। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট জাতের ছাগলের জীবনবিন্যাস উন্মোচনের মধ্য দিয়ে গবেষণার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন বলা যায়।  ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবনবিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েনসিংয়ের বিষয়টি প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা BMC Research Notes-এ প্রকাশিত হয়েছে। ‘জিনোম’ হলো একটি জীবে বিদ্যমান সব জিনসহ ডিএনএর সম্পূর্ণ সেট, যা ওই জীবের উৎপত্তি, বেঁচে থাকা এবং বংশগতি রক্ষার জন্য অপরিহার্য। জিনোমে লুকিয়ে থাকে জীবনের অজানা সব রহস্য অর্থাৎ একটি জীবের উদ্ভব বা বিবর্তন হলো কীভাবে, কীই বা তার পরিচয়, তার বৈশিষ্ট্য কী, কীভাবে সে বেড়ে উঠেছে আর বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশেই বা নিজেকে খাপ খাওয়ায় কীভাবে এবং সর্বোপরি বংশপরম্পরায় সে নিজেকে কীভাবে টিকিয়ে রাখে। যে কোনো জীবের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কার্যক্রমই নিয়ন্ত্রিত হয় তার জিনোম বা কিছু ক্রোমোজোম বা অনেক অনেক জিনের দ্বারা। তার মানে বোঝা যায়, ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জীবনবিন্যাস উন্মোচনের মধ্য দিয়ে ছাগলের এ প্রজাতি নিয়ে আমাদের অনেক বড় স্বপ্নের ক্ষেত্র তৈরি হলো।

এ বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজির হই। গবেষকদের কাছ থেকে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট জাতের ছাগলের জীবনবিন্যাস উন্মোচনের বিস্তারিত জানতে। কথা হয় ড. জুনায়েদ ছিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমাদের দেশে জিনোম বা জীবনরহস্য ও বিন্যাস গবেষষণার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সংকট ছিল। বিশেষ করে কম্পিউটার বিজ্ঞানে জীববিদ্যার ডাটা ও তথ্যের সম্পর্ক ছিল না। এখন এসব সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি আমরা।’ তিনি বলেন, ‘জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে এ জাতের ছাগলের দুর্বল বৈশিষ্ট্যগুলো বের করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতটিকে আরও উন্নত করা সম্ভব হবে। এ গবেষণার ফলে ছাগলের মাংসের মানোন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধির মতো প্রয়োজনীয় তথ্য উন্মোচিত হয়েছে।’

ড. জুনায়েদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এর ফলে সাধারণ কৃষক বা খামারি কীভাবে উপকার পাবে? তিনি জানালেন, ‘জিনোম সিকোয়েনসিংয়ের পর আমরা এখন গবেষণা করব জাতটির উন্নয়নে। সম্ভব হবে নতুন জাত উদ্ভাবনের। এর ফলে আমরা যে জাতটি উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছি তা সফল হলে দেশের ছাগলের উৎপাদন বাড়বে, সার্বিকভাবে তা দারিদ্র্য বিমোচনে আরও ভূমিকা রাখবে।’

অধ্যাপক জুনায়েদ ছিদ্দিকী আরও জানান, কালো ছাগলের নতুন জাত উদ্ভাবনের গবেষণায় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দুটি সংস্থা ইতিমধ্যে অর্থায়নের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।

দেশে বিভিন্ন সময়ে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল নিয়ে নানামুখী উদ্যোগ ও প্রকল্প কাজ করেছে। কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে কাজগুলো আর সেভাবে অগ্রসর হয় না। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, ছাগলের জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এর দুর্বল বৈশিষ্ট্যগুলো দূর করে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আরও উন্নয়ন করা যাবে; যা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ছাগলের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় অর্থনীতিতে ছাগলের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ছাগল পালনের মাধমে স্বাবলম্বী হচ্ছে। সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ মানুষ এই ছাগল পালন করলেও অতিলাভের আশায় অন্য জাতের ছাগলের সঙ্গে এর সংকরায়ণও খুব একটা করে না। ফলে বিশ্বের হাতে গোনা যে চার থেকে পাঁচটি ছাগলের জাত এখনো সংকরায়ণ হয়নি, স্বতন্ত্র জাত হিসেবে টিকে আছে, তার অন্যতম এই ব্ল্যাক বেঙ্গল। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এ জাতটি টিকিয়ে রেখেছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। এখন এই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের যে সীমাবদ্ধতাগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়ে দ্বিতীয় ধাপে নানামুখী কাজ শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে, এ মুহূর্তে দেশে আড়াই কোটির বেশি ছাগল রয়েছে। এর ৯৫ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। দেশের প্রায় ১ কোটি লোক ছাগল পালন করে। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটা একটা রেকর্ড। বাংলাদেশের এই ছাগলের নবজাতকের মৃত্যুহার কম। খুব দ্রুত প্রজননক্ষম হয় বলে এ জাতের মাদি ছাগল বছরে দুবার গর্ভধারণ করতে পারে এবং প্রতিবারে ৩ থেকে ৪টি বাচ্চা প্রসব করে। তা ছাড়া কম সময়ে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে বলে এ জাতের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। তাই অন্য জাতগুলোর তুলনায় এ জাতের ছাগলের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

সারা পৃথিবীর কৃষি উন্নয়ন প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি বার বার লক্ষ্য করেছি তা হলো, সব বড় বড় উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দুই হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণা সাফল্যই জনসাধারণ ভোগ করে। যদিও আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক চিত্র নেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সরকারি গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের বড় এক ঘাটতি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ জানিয়েছেন, ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জীবনবিন্যাস উন্মোচনের এ সাফল্যকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় যে কোনো বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে বড় আকারে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। একইভাবে জনগণের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়, এর মধ্য দিয়ে মানুষ কীভাবে উপকৃত হতে পারবে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একাডেমিক গবেষণাগুলো শিক্ষার্থীর ডিগ্রি অর্জন কিংবা আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হলেই তার আবেদনটি চাপা পড়ে যায়। কিন্তু গবেষণার উদ্দেশ্যই গণমানুষের কল্যাণসাধন। বিশ্বখ্যাত ছাগলের জাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জীবনরহস্যের সাফল্যজনক গবেষণার জন্য ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। আশা করি, এ সাফল্যের ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিতে সব মহল থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর