শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নৈতিকতার দৃষ্টান্ত আছে আমাদেরও

আতাউর রহমান

কত মন খারাপ করা খবর চারদিকে। এর মাঝে মন ভালো করার খবরও নিছক কম নয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে ছোট্ট একটি খবর হয়তো অনেকেরই নজরে এসেছে- ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে সম্প্রতি ‘কালচার অ্যান্ড সোসাইটিজ অব আফ্রিকা’ নামে বইটি ফেরত দিয়েছেন ৬০ বছর পর! লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ সপ্তাহে দেড় পাউন্ড করে মোট ৪ হাজার ৭০০ পাউন্ড জরিমানা তো মওকুফ করেছেনই, সঙ্গে এক টুইটে সেই খবরটা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কিছুটা প্রশংসাও করেছেন এই বলে- ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’। খবরটা পড়তেই মনে পড়ে গেল দুই বছর আগে শোনা একটা ঘটনা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ছিল দেশের অন্যতম বনেদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যশোর জিলা স্কুলের ১৮০ বছর পূর্তি উৎসব। তাতে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক জানালেন এমনই একটি খবর। তা হলো- স্কুলেরই সাবেক একজন কৃতী শিক্ষার্থী স্কুল লাইব্রেরিতে একটি বই ফেরত দিয়েছেন ৬৪ বছর পর! খবরটা দারুণ উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাবেক ও বর্তমান কয়েক হাজার শিক্ষার্থীকে। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে দ্বারস্থ হই সেই সাবেক শিক্ষার্থীর। তিনি ড. এম শমসের আলী। শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, লেখক ও টিভিব্যক্তিত্ব। নিভৃতচারী এই মানুষটি এই ব্যাপারটা নিয়ে স্কুল চৌহদ্দির বাইরে নিজে থেকে কারও সঙ্গে কখনো আলাপ করেননি। ফলে ঘটনাটা রয়ে গেছে অগোচরেই, এমনকি তার পরিচিত পরিম-লেও। যশোর জিলা স্কুল লাইব্রেরি থেকে বইটি ইস্যু করা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। শমসের আলী তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। উল্লিখিত বইটি ছিল উনিশ শতকের ইংরেজ ভাষাবিদ উইলিয়াম ম্যাকমর্ডিই প্রণীত ‘ইংলিশ ইডিয়মস অ্যান্ড হাউ টু ইউজ দেম’। বইটি তার এতই পছন্দ ছিল যে তাতে রীতিমতো বুঁদ হয়ে রইলেন গোটা শিক্ষাজীবন। বইয়ের মালিক যে যশোর জিলা স্কুল লাইব্রেরি, সে কথা মনে আছে বটে কিন্তু সময় করে স্কুলে গিয়ে নিজ হাতে ফেরত দেবেন ভাবতে ভাবতেই গড়িয়ে গেছে কয়েক দশক। এর মধ্যে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখান থেকে পদার্থবিজ্ঞানে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর শেষ করে কমনওয়েলথ                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                          

বৃত্তি নিয়ে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করলেন। তারপর আণবিক শক্তি কমিশনে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন এবং পরে গবেষণাসূত্রে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ প্রফেসর ড. আবদুস সালামের সঙ্গে ইতালির ত্রিয়েস্তেতে সুদীর্ঘ প্রবাসজীবন।

একদিন হঠাৎ খেয়াল হলো, বইটি আর তার জিম্মায় নেই! ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে দেখতে দিয়েছিলেন বইটি, যাতে শিক্ষার্থীদের কিছু উপকার হয়। কিন্তু উচ্চতর পড়াশোনাসূত্রে সেই শিক্ষকের বিদেশগমন এবং ঢাকাস্থ বাড়ি বদল, অতঃপর বইখানা লাপাত্তা। ড. আলীর মাথায় হাত! এখন কী হবে! বইটি নিজের হাতে ফেরত দিতে না পারলে জীবনের বাকিটা সময় ভুগতে হবে বিবেকের দংশনে। অতএব খোঁজ খোঁজ খোঁজ। খুঁজতে শুরু করার পর থেকে খুঁজে পাওয়া অবধি যা কিছু হলো, সে-ও এক রোমাঞ্চকর উপাখ্যান। অনুসন্ধান শুরু হলো। বইটির যে সংস্করণটি তিনি স্কুল লাইব্রেরি থেকে ধার করেছিলেন সেটির প্রকাশকাল ছিল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ। তৎকালীন বোম্বে থেকে প্রকাশিত এবং নর্থ আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্ট থেকে মুদ্রিত। বইটির দাম ছিল আড়াই রুপি। ড. শমসের আলী নিজে খুঁজছেন। একে ওকে জিজ্ঞাসা করছেন। প্রবাসে তার ছাত্র-পরিচিত যারা রয়েছেন, তাদের কারও কারও সাহায্য চেয়েছেন, তারাও খুঁজে ফিরছেন বইখানা। হন্যে হয়ে চষা হয়ে গেছে দেশ-বিদেশের নতুনপুরান বহু বইয়ের দোকান। সেমিনার-কনফারেন্সে যখনই কোথাও গেছেন, ঢুঁ মারছেন পুরনো বইয়ের দোকান কিংবা খ্যাতনামা লাইব্রেরিগুলোয়। কেবল ভারতেরই একাধিক রাজ্যে বিভিন্ন সময় তিনি ধরনা দিয়েছেন বহু দোকানে, লাইব্রেরিতে। কেউ একটু আশা দিয়েছেন তো কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে কোনো দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দোকানই হয়তো খোলেনি তখনো। আজ পাটনার খোদাবক্স লাইব্রেরিতে যাচ্ছেন তো দুই দিন পর আসামের কোনো লাইব্রেরিতে। বইটা কোথাও কোথাও পাওয়া যায়ও বটে কিন্তু কোনোটা ১৯০৫ সালে প্রকাশিত, কোনোটা ১৯২৭ সালে, কোনোটা একেবারেই সাম্প্রতিক সংস্করণ। তার যে চাই সেই ১৮৯০ সালে প্রকাশিত সংস্করণটি!

কিন্তু ওই যে জ্ঞানীরা বলেন, যে চায় সে পায়। তা-ই সত্য হলো আবারও। এর মধ্যে ভারতে অনুষ্ঠিত একটি কনফারেন্সে একদিন পরিচয় হয় সে-দেশের শিক্ষা বিভাগের একজন কর্তাব্যক্তি কে পি ঘোষের সঙ্গে, এই বাঙালি ভদ্রলোক আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধও করেছেন। তার পরামর্শে তার সঙ্গেই একদিন খোঁজ নিতে চললেন কলকাতার আলিপুরস্থ শতাব্দীপ্রাচীন গ্রন্থাগার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। মিলল অবশেষে! খুব যত্নে একটা ফোল্ডারে মোড়ানো, একটু এদিকওদিক হলেই যে ছিঁড়ে কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। খুলে দেখা গেল সেই একই প্রচ্ছদ, সেই একই বই। প্রকাশকাল ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ। বইয়ের ভূমিকায় ম্যাকমর্ডিই সাহেবের কয়েকটা কথা এই এত বছর পরও একেবারে ঝাড়া মুখস্থ ড. শমসের আলীর। মিলিয়ে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন- হ্যাঁ, সেটাও আছে বৈকি। অনুমতি নিয়ে ফটোকপি করে নিলেন দ্রুত। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষই করে দিল কাজটা, ভিনদেশি বলে মূল্য দিতে হলো প্রায় আড়াই হাজার রুপি! তাতে কী, পাওয়া যে গেল সেটাই বড় কথা। এই অশীতিপর বয়সেও দারুণ কর্মচঞ্চল ড. শমসের আলী বলছিলেন, ‘৬৪ বছর পর বইটা ফেরত দিতে পেরে মনে হচ্ছিল বিবেকের দায় থেকে মুক্তি পেলাম। না হলে একটা ভীষণ যন্ত্রণা আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হতো।’

লেখক : চিকিৎসক

 

সর্বশেষ খবর