সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

টনক নড়াতে টনিক

হানিফ সংকেত

টনক নড়াতে টনিক

আমাদের জীবনে ঝামেলার শেষ নেই। সবখানেই যেন ওত পেতে আছে ঝামেলা। কিছু খেতে ঝামেলা-কিছু পেতে ঝামেলা-আবার কোথাও যেতে ঝামেলা। এই ঝামেলা কখনো কারণে, কখনো অকারণে আসে। সেই কারণ বা অকারণ নির্ধারণ বা ধারণ করতে আমরা সাধারণ বা অসাধারণ নানান পথ অবলম্বন করি। কিন্তু কোন পথ-পথ, কোনটা বিপথ-কোথায় আপদ-কোথায় বিপদ এটা নির্ধারণ করতে  গিয়েও কিন্তু আবার দেখা পাওয়া যায় সেই ঝামেলার।  আইনশৃঙ্খলা, নিয়ম-কানুন, নিশ্চিন্ত-নিরাপত্তা এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষকে উদ্বেগমুক্ত করা কঠিন। যদিও নিয়ম মানার শপথ করেও কজন বিপথে বা কুপথে না গিয়ে সুপথে যাবেন তা শপথ করে বলাও কঠিন। এর কারণ আমাদের টনক বা হুঁশজ্ঞান দিন দিন লোপ পাচ্ছে। শুদ্ধভাবে বললে দিন যতই যাচ্ছে আমাদের চৈতন্যোদয় নয় বরং চৈতন্যোক্ষয় হচ্ছে। যখনই কেনো কিছু ঘটে, ঘটনা যখন দুর্ঘটনায় পরিণত হয়, তখনই আমাদের টনক বাবাজি নড়ে ওঠে। অর্থাৎ ধাক্কা না খেলে হুঁশ হয় না। তবে টনক নড়ানো কিন্তু সহজ কাজ নয়। এই নড়ার সঙ্গে সততা, সদিচ্ছা, সর্বোপরি বিবেকের প্রশ্ন জড়িত। কারণ এই মানুষের মধ্যেই মান এবং হুঁশ বিসর্জন দেওয়া মানুষের অভাব নেই। এদের মধ্যেই কেউ কেউ অন্যের আস্থা অর্জনের জন্য নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে চাটুকার নাম ধারণ করে। নির্দেশ না পেলে কোনো টনিকই এদের টনক নড়ায় না।

ঘটনার আকস্মিকতায় আজকাল রাশিফলও বাসিফল হয়ে যায়। ভাগ্যচক্র সরল না বক্র, তা রাশিফলে নয় বরং কর্মফলের মর্মগুণেই নির্ধারিত হয়। কারণ কখন যে কোন ঘটনা ঘটবে তা কেউ জানে না, কিংবা কল্পনাও করতে পারে না। গণমাধ্যম অগণিত হতে হতে যখন কল্পনার সীমা ছাড়ায় তখন তার অবস্থা কেমন দাঁড়ায় তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এখানেও আগে টনক নড়তে দেখা যায় না। যখন অঘটন ঘটে যায়, তখন খুব তাড়াতাড়ি-কাঁড়িকাঁড়ি-সরাসরি সংবাদ দেখা যায়। দুর্ঘটনা ঘটলেই যেন সবার টনক নড়ে ওঠে। চলে দর্শন-পরিদর্শন, টকশোতে ফোটে কথার খৈ। এর দোষ, ওর দোষ, কথায় কথায় যত দোষ ওই নন্দঘোষ। অর্থাৎ নন্দবাবুকে দোষ দিতে পারলেই যেন আমাদের আনন্দ। যখন-যেখানে-যাকে-যেভাবে-যা বলে পারি দোষারোপ করতে থাকি। সে ঘরেই হোক আর বাইরেই হোক। এরপর নানা স্থানে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা, অবশেষে তদন্ত কমিটি। যে কমিটির রিপোর্ট অনেকটা আলাদিনের চেরাগের মতো। যা অধিকাংশ সময়ই আলোর মুখ দেখে না, দেখলেও তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখে না। সুতরাং এই জাতীয় রিপোর্টের ওপর ভরসা না করে ফর্সা মন নিয়ে কাজ করে যাওয়াই ভালো। রিপোর্ট যাই হোক, সময়মতো টনক না নড়ার কারণে হারানো জীবনগুলো আর ফিরে আসে না। ঝরে যাওয়া জীবনের প্রতি মানুষের দুঃখ, শোক কমানো এবং দমানোর জন্য নানান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়। যেমন-কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই ভবনের মালিক, বাসের মালিক, লঞ্চের মালিক, রাসায়নিক গোডাউনের মালিক, গার্মেন্টের মালিক সবার খোঁজ নেওয়া শুরু হয়। এই টনক নড়ার পরেই বের হয় ভবনটি অবৈধ, নকশা ঠিক নেই, ৬ তলা করা হয়েছে ৯ তলা কিংবা ৯ তলা ভবন করা হয়েছে ১৮ তলা, সুউচ্চ ভবন কিন্তু কোনো অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। দেখে মনে হয় এতদিন সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন হঠাৎ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন। অথচ সবার চোখের সামনেই এসব ভবন তৈরি হয়। কিন্তু যারা দেখার কথা তারা যেন কেউ দেখেও দেখে না। রাস্তার কথাই ধরা যাক। রাস্তায় যখন অ্যাকসিডেন্ট হয়, জীবনের ক্ষতি হয়, মানুষের হাত-পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন শোনা যায় নানান টনক নড়ানো কথা। গাড়ির ফিটনেস নেই, হেলপার হেল্প করার বদলে সেলফ ড্রাইভিং করছিল। আবার এসব ড্রাইভারের ড্রাইভিংয়ের সেন্স না থাকলেও লাইসেন্স থাকে। সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে যাত্রীদের সেন্স না থাকারই কথা। তারপরও প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ গাড়িতে চড়ে, দুর্ঘটনায়ও পড়ে এবং অবশেষে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যায়। অথচ এসব দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ থাকলেও সেই মানুষের টনক নেই। অনেক বড় বড় হাসপাতালেও একই অবস্থা। ভুল চিকিৎসা, ভুল পরীক্ষার কারণে রোগী মারা গেলে পুরো হাসপাতালে শুরু হয় লঙ্কাকা, ভাঙচুর। অনেক হাসপাতালে রোগী মারা যাওয়ার পরেও লাইফ সাপোর্টের পাইপ সরে না। তাই অনেকে এই সাপোর্টকে লাইফ সাপোর্ট না বলে হাসপাতালের বিল সাপোর্টও বলে। কারণ যতক্ষণ বুঝিয়ে শুনিয়ে এই সাপোর্ট রাখা যায় বিলের চাকা ততই সামনে এগোয়। এসব জটিলতায় যখন হাসপাতালে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়, তখনই সবার টনক নড়ে ওঠে। শোনা যায় নানান কথা। ক্লিনিকের লাইসেন্স নেই, ডাক্তারের সার্টিফিকেট নেই, প্যাথলজি অবৈধ, পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিক নেই, ওষুধেরও মেয়াদ নেই। অথচ এসব দেখার জন্যও লোক আছে। কিন্তু সমস্যা একই, লোক আছে কিন্তু টনক নেই।

ইদানীং আবার শুরু হয়েছে সেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। গাড়িতে-বাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। অথচ দুর্ঘটনা ঘটার পর জানা গেল মেয়াদ ছিল না। অর্থাৎ সিলিন্ডারের মেয়াদ নিয়েও আমাদের টনক নেই।

ভূমিকম্পের কথাই ধরা যাক। একটুখানি ঝাঁকুনি হলেই টিভি স্টুডিওর টকশো থেকেও অনেককে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। স্বাভাবিক, জানের মায়া কার না আছে। পরদিন থেকেই শুরু হয় রিপোর্ট আর রিপোর্ট। টিভিতে, অনলাইনে, পত্রিকায় নানান ধরনের রিপোর্ট, মধ্যরাতে টকশো। কত স্কেলে ভূমিকম্প হলে কত লোক মারা যাবে, কয়টা বাড়ি ধ্বংস হবে, ধ্বংসস্তূপ থেকে কীভাবে লাশ বের করা হবে, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের আবর্জনা কীভাবে সরাবে, যন্ত্রপাতি কোথায় পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার বস্তিতে আগুন লাগলে কথা তৈরি হয়েই থাকে- অবৈধ বস্তি, অবৈধ গ্যাস, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ - সুতরাং দুর্ঘটনা তো ঘটবেই। কিন্তু সবার চোখের সামনেই এত অবৈধ কাজ বৈধভাবে হচ্ছে কী করে? কথা সেই একটাইÑদায়িত্বপ্রাপ্তদের টনক নেই। যদি কোনো অঘটন ঘটে তখন এই টনকই দ্রুতবেগে চলে আসে। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা, অনুবীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ।

শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণ, সর্বোপরি নারী নির্যাতন- পত্রপত্রিকা খুললে এসব সংবাদ চোখে পড়বেই। এগুলো যেন আমরা অনেকটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছি। পত্রিকা বা টিভিতে ২/১টি রিপোর্টেই যেন এর সমাপ্তি। এসব নিয়েও কারও টনক নড়তে দেখি না। আমরা জানি স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, তাই ভুল করেও কথাটি ভুলে গেলে শরীরের মূলে কুঠারাঘাত হয়। তাই স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম মেনে না চললে নানান রোগ জটিলতায় ভুগতে হয়। তাই সময় থাকতে স্বাস্থ্য রক্ষায়ও টনক প্রয়োজন। আমাদের টনক নড়লেও কর্তৃপক্ষের টনক কি নড়ছে? জীবন রক্ষাকারী ওষুধে জীবননাশের উপাদান দেখছি কিন্তু কেউ কিছু বলছি না। বাজারে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে সয়লাব, মাঝে মাঝে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিন্তু থামছে না। অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে, দেখার লোক আছে কিন্তু দেখছে না, যাদের বলার তারাও কিছু বলছে না। জীবন রক্ষার প্রয়োজনে এসবের স্থায়ী সমাধানের জন্য মাঝে মাঝে নয়, প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন আগাম টনক।

প্রতিবছরই বর্ষাকালে পাহাড় ধসে অনেক মানুষ মারা যায়। আমরা জানি বর্ষায় পাহাড়ে এ অবস্থা হবে তারপরও আগে থেকে কোনো ব্যবস্থা নেই। মাঝে মাঝে মাইকে পাবলিসিটির কথা শোনা যায়, তবে টনক নড়ানোর মতো টনিক নেই তাই দুর্ঘটনা ঘটছেই।

প্রতি বছর ভারি বর্ষায় জলাবদ্ধতা। নৌকা আর বাস একসঙ্গে চলতে দেখা যায় রাস্তায়। কিন্তু পরবর্তী বছর যাতে এটা না হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার দুরবস্থার কারণে এই জলজটে নগরবাসীর দুঃসহ ভোগান্তি আছেই। অর্থাৎ ঘটনা যখন দুর্ঘটনায় পরিণত হয়, তখন সবার টনক নড়ে। তখনই কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যা দেখে অনেকেই আক্ষেপ করেনÑএ কী হচ্ছে? কারণ এর মধ্যে অনেক পদক্ষেপই সুদূরপ্রসারী নয়, লোক দেখানো। তাই সবসময় এদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদেরও সাবধানী হতে হবে। কারণ, ‘সাবধানের যেমন মার নেই, তেমনি সাবধানীরও হার নেই’।

বিদেশ থেকে ফিরেছেন লাগেজ নিয়ে ট্রলিতে তুলছেন হঠাৎ দেখলেন লাগেজ কাটা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সন্তানের জন্য শখ করে কেনা জিনিসটি আছে তো? এই শঙ্কা নিয়েই বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছলেন। বাড়ি গিয়ে জিনিসটি পেলে ভালো কথা, না পেলে মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার, আমরা কবে মানুষ হব? আমাদের এসব কাজেকর্মে মনে হয় মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি।

সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই এখন সবার আগে সর্বশেষ খবর পৌঁছে দেওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সে জন্যই বলে, মিথ্যে বলিবেন না-মিথ্যে পথে চলিবেন না-মিথ্যা কথায় গলিবেন না। কারণ মিথ্যে দিয়ে আর যাই হোক সত্যকে ঢাকা যায় না। দেশের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি-অপরাধ-সন্ত্রাস যারা দেখবেন এবং প্রতিরোধ করবেন তাদেরই অনেকে আজ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। জড়িত ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে। আসলে সরকারের নীতি এবং রীতি মোতাবেক অফিস কর্তা স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে অফিসে নিয়ম মতোই কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি নিজেই যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তখন শত বললেও তার টনক কখনো নড়বে না। তাই এসব সত্যকে সত্যিকারভাবে তুলে ধরাটাও টনকের টনিক হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইউনিভার্সিটির র‌্যাগিংয়ের কথাই ধরা যাক। র‌্যাগিং হয় সেটা আমরা সবাই জানতাম। অনেক লেখালেখিও হয়েছে এসব নিয়ে। তারপরও সবাই নীরব। গত ১২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাই কোর্টের রায় বাস্তবায়ন ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক একটি কর্মশালার প্রধান অতিথির ভাষণে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছেন, ‘ইউনিভার্সিটিতে র‌্যাগিংয়ের বিষয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু আমরা নীরব, প্রশাসন নীরব, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীরব। যেই আবরার মারা গেল, যখন প্রধানমন্ত্রী বললেন এটার বিচার হতে হবে তখন সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাহলে ইউনিভার্সিটি প্রশাসন আগে দেখেনি কেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাসিনো বাংলাদেশে অনেক বছর ধরে আছে কিন্তু সাংবাদিকরা পেরেছেন রিপোর্ট করতে এটা নিয়ে? পারেননি। যখন প্রধানমন্ত্রী বললেন ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব, তখনই সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন রিপোর্ট করার জন্য। কার কত শত কোটি টাকা আছে।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ অক্টোবর-২০১৯)।

অর্থাৎ যেই টনক আগে নড়ার কথা তা নড়ল ঘটনাটা দুর্ঘটনায় পরিণত হওয়ার পর। আর তখন থেকেই এই ক্যাসিনো সম্পর্কে বেশ অ™ভুত অভুত খবর জানা গেল। ঢাকায় নাকি ৬০টির মতো ক্যাসিনো আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ক্যাসিনো তো রাতারাতি গজিয়ে ওঠেনি। তাই সচেতন মহলের প্রশ্ন, পুলিশ কী করেছে? তারা কি জানত না? জানলে টনক নড়েনি কেন? এত এত পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা কী করেছে? যারা সবসময়ই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে! কেউ কেউ সংবাদে বেশ আলোও ছড়ায়। তাদের কেন টনক নড়েনি? তবে দু-একজন সাংবাদিক এসব ব্যাপারে সংবাদ বা প্রতিবেদন তৈরি করলেও সংশ্লিষ্ট পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল তা প্রকাশ করতে দেয়নি বলেও সংবাদে দেখলাম। অনেক জায়গায় ক্লাবগুলো থেকে খেলাধুলা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সামনে আসে ক্যাসিনো এবং জুয়া। কিছু কিছু ক্যাসিনোতে সরাসরি বিনোদন প্রদানের ব্যবস্থাও থাকে। আগে যাত্রা বা শীতকালীন বিভিন্ন প্রদর্শনীতে ছোট পরিসরে অল্প পুঁজিতে জুয়া খেলা হতো। সাধারণ মানুষ খেলত। এখন বৃহৎ পরিসরে আলো ঝলমলে পরিবেশে অসাধারণ মানুষ শত শত কোটি টাকা দিয়ে এই খেলা খেলে। সবার চোখের সামনেই চলেছে এই খেলা। কিন্তু কারোরই টনক নড়েনি। কিন্তু যখনই টনক নড়ল তখনই হাজার কোটি টাকার হিসাব বেরুলো। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

আজকাল টেলিভিশন চ্যানেল এবং পত্রিকাগুলোতে একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়। তা হচ্ছে মৃত্যুবার্ষিকী পালন। তাও আবার সবার না, কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে মাফিক। একজন শিল্পীর মৃত্যু হলে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানাবিধ শোকানুষ্ঠান আয়োজন করা হয় এবং প্রতি বছরই প্রয়াত সেই ব্যক্তির কাছের কজন মানুষকে ডাকা হয় আলোচনার জন্য। প্রতিবারই সেই একই মানুষ একই ধরনের আলোচনা করে থাকেন। অনেক সময় মনে হয় পুরনো অনুষ্ঠান দেখছি না তো? আমন্ত্রিতদের পোশাকে পরিবর্তন না থাকলে আলাদা করা কঠিনই বৈকি। এ তো গেল একটা দিক। আর একটি দৃষ্টিকটু বিষয় হলো, মৃত্যুর পর এসব শিল্পী বা ব্যক্তির নামের আগে এমন সব বিশেষণ ব্যবহার করতে দেখি যা জীবিত অবস্থায় কখনো দেখিনি। কিছু কিছু অবিশ্বাস্য বিশেষণও দেখা যায়। শিল্পী জীবিত থাকলে হয়তো তিনি নিজেই এসব লিখতে নিষেধ করতেন। যেমন ‘কিংবদন্তি’ শব্দটি গুরুত্ব অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত, অন্যথায় এই শব্দটিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। আসলে জীবিত অবস্থায় একজন শিল্পীর কর্ম এবং সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা দরকার, প্রয়োজনে গঠনমূলক সমালোচনাও হতে পারে। যা তাকে ভবিষ্যৎ চলার পথের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বা তার একটি সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বিজ্ঞজনদের আলোচনা তাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তার কাজের মূল্যায়ন তাকে আরও নতুন কিছু সৃষ্টিতে উৎসাহিত করতে পারে। শিল্পী যদি জীবিত অবস্থায় দেখে যেতে পারতেন তাকে নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, তাকে এত সম্মান করা হচ্ছে তাহলে অনেক আনন্দ পেতেন। কিন্তু আমাদের দেশে এই সংস্কৃতিটি গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর পর যত আলোচনা। পুরস্কারও অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হয় মরণোত্তর। যা শিল্পী দেখে যেতে পারেন না। এখানেও সেই একই সমস্যা। মৃত্যুর আগে টনক নড়ে না, টনক নড়ে মৃত্যুর পরে। যা কাম্য নয়।

তবে আরও একটি ভয়ঙ্কর টনক হচ্ছে পারিবারিক টনক। যেটি সময়মতো নড়া উচিত। অনেক অভিভাবকই জানেন না তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় যায়, কী করে? কার সঙ্গে মেশে। কোনটা মাদকের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, কোনটা গ্যাং লিডার হচ্ছে, কোনটা অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় যখন চরম আকার ধারণ করে তখন সবার টনক নড়ে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তাই অভিভাবকদেরও সন্তানদের ব্যাপারে সময়মতো টনক নড়া উচিত। ঘটনা ঘটার আগেই হুঁশ বা চৈতন্যোদয় হওয়া উচিত। বিষমুক্ত খাদ্য যেমন আমাদের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন বিষমুক্ত সমাজ। মানুষ বাঁচতে চায়।  ভালোভাবে বাঁচতে হলে সমাজ দেহে জন্মে ওঠা সব বিষবৃক্ষ সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। বিপথ বা কুপথ থেকে  সুপথে আসার জন্যই প্রয়োজন সময়মতো টনক নড়াতে টনিক।

                লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর