বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আখেরি চাহার শোম্বার আলোচনা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আখেরি চাহার শোম্বার আলোচনা

‘আখেরি চাহার শোম্বা’ ফারসি ভাষার পরিভাষা। আখের মানে শেষ, চাহার অর্থ সফর মাস এবং শোম্বা অর্থ বুধবার। ঐতিহাসিক এ দিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাময়িক সুস্থতা লাভ করেন। কিছু সময় পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এর কয়েকদিন পর তিনি ওফাত লাভ করেন। তাঁর অসুস্থতা ছিল নিদারুণ যন্ত্রণার। এত বেশি যন্ত্রণার যে, তাঁর স্ত্রী আয়শা (রা.) বলেন, ‘অসুখে এত বেশি কষ্ট পেতে আমার জীবনে আগে পরে আর কাউকেই দেখিনি।’

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুখের শুরু মাথা ব্যথা থেকে। আয়শা (রা.) বলেন, ‘একদিন রাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারতের জন্য বের হলেন। আমিও তাঁর পেছন পেছন গেলাম। আমার সন্দেহ হলো, তিনি বোধহয় আমার হক অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু না, তিনি দীর্ঘ সময় কবরবাসীর জন্য দোয়া করলেন। তিনি যখন ঘরে ফিরে এলেন আমিও এলাম। আমি চাইছিলাম, তাঁকে অনুসরণ করার বিষয়টি যেন তিনি বুঝতে না পারেন। কিন্তু আমাকে হাঁপাতে দেখে তিনি ঠিকই বুঝে ফেললেন আমি তার পেছন পেছন গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, আয়শা! তোমার সন্দেহ ভুল ছিল। ঠিক এমন সময়ই তাঁর মাথা ব্যথা শুরু হয়।’

প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ও জ্বর নিয়ে রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন হজরত। তিনি বার বার বলছিলেন, ‘এ আমার শেষ যাত্রার অসুখ। আল্লাহ নবীদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তাই তাদের তিনি সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করেন। তবে অন্যসব নবী যত কষ্ট পেয়েছেন আমি একা তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি।’ হজরতের কষ্ট সবাইকে কষ্ট দিচ্ছিল। সবাই ধরেই নিয়েছে এবার আর তিনি সুস্থ হবেন না। কিন্তু সফর মাসের শেষ বুধবার হঠাৎ তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। সাত কুয়োর পানি দিয়ে গোসল করলেন। কলিজার টুকরো ফাতেমা ও দুই নাতিকে সঙ্গে করে ভালো খাবার খেলেন। জামাতের সঙ্গে জোহরের নামাজ আদায় করলেন। এসব দেখে সাহাবিরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। খুশিতে তারা আত্মহারা হলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহর রাস্তায় সোনা-রূপা-নগদ অর্থ-উট-ভেড়া অকাতরে বিলিয়ে দিতে লাগলেন। সিরাতবিদরা বলেন, ‘নবীজির সুস্থতায় খুশি হয়ে আবুবকর ৫ হাজার, ওমর ৭ হাজার, আলী ৩ হাজার দিরহাম এবং আবদুর রহমান বিন আওফ ১০০ উট আল্লাহর ওয়াস্তে দান করলেন।’

নবীজির সুস্থতায় আনন্দিত হয়ে সাহাবিদের অকাতরে দান-সদকা ও নফল ইবাদতের সুন্নতটি সেই থেকে আজ পর্যন্ত নবীপ্রেমিক সুফিরা জারি রেখেছেন। তাই নবীজির সুস্থতার দিনে দান-খয়রাত, নফল ইবাদত ও শুকরিয়া দিবস হিসেবে উদ্যাপন করেন তারা। এ দিনকে মানুষ সুস্থতার অসিলা হিসেবে বিভিন্ন নফল ইবাদতে কাটায়। মূলত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থ হয়েছেন, এটাই যেন প্রেমিক হৃদয়ে উৎসবের জোয়ার এনে দেয়। তাই সাহাবিদের মতো আমরাও এ দিনকে শুকরিয়া দিন হিসেবে উদ্যাপন করছি এবং করব। আমাদের বিশ্বাস, নঈপ্রেমের এসব টুটাফাটা আমলের অসিলায় দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি মিলবে।

এ ক্ষেত্রে ওলামায়ে কিরাম বলেন, নবীজির সুস্থতার দিনটি সফর মাসের শেষ বুধবার হওয়ার পক্ষে অনেক দলিল রয়েছে। তবে তিনি যে সাময়িক সুস্থ হয়েছেন এবং সাহাবিরা আনন্দিত হয়ে দান-খয়রাত করেছেন এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই। বিষয় হলো, সফর মাসের শেষের দিকে নবীজি সুস্থ হয়েছেন, সাহাবিরা শুকরিয়াতান দান-খয়রাত, নফল ইবাদত করেছেন, আমরাও করছি এবং করব। বুধবার সম্পর্কে বেশি বর্ণনা এসেছে, তাই একে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কেউ যদি আগে-পরেও নবীর সুস্থতায় আল্লাহর রাহে শুকরিয়া জানায় শরিয়তের দৃষ্টিতে এতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে মানুষের মনে দিবসের একটি আলদা তাৎপর্য রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহি বুঝ দান করুন এবং হৃদয়ে নবীপ্রেম ঢেলে দিন।

                লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন

                চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাস্সির  সোসাইটি।

সর্বশেষ খবর