শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাছ চাষের নতুন বিপ্লবের গবেষণা কত দূর?

শাইখ সিরাজ

মাছ চাষের নতুন বিপ্লবের গবেষণা কত দূর?

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সারা বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আশির দশক থেকে এ দেশে মাছ চাষের এক জোয়ার এসেছে। একে বলা যেতে পারে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জোয়ার। আমি বলি রুপালি বিপ্লব। আজকের গ্রামীণ জনপদে আর্থ-সামাজিক যে পরিবর্তনগুলো সূচিত হয়েছে তার পেছনে কৃষির বহুমুখী বৈচিত্র্যের পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান মাছ চাষের। দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে মাছ উৎপাদনের হিসাব-নিকাশ। ঘরের মধ্যে মাছ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি এখন নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় এক উদ্যোগ। পুকুরের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি মাছ উৎপাদনের পদ্ধতি রিসার্কুলেটেড অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম ইতিমধ্যে বহু মাছ চাষ উদ্যোক্তার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, চীন, ভারতসহ অনেক দেশেই এখন ঘরের ভিতর মাছ চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণ হচ্ছে। আমাদের দেশেও এ প্রযুক্তি বিষয়ে ইতিমধ্যে বেশকিছু প্রতিবেদন তুলে ধরেছি। এর মধ্যেই এসে গেছে বায়োফ্লক পদ্ধতি। সেটিও উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কেড়েছে।

পাঠক! ২০১৭ সালে চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম বিসিএসআইআরে রাস পদ্ধতির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। ২ হাজার বর্গফুটের মোটা টিনের তৈরি একটি ঘরের মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছিল আরেকটি ঘর। যেখানে ১১টি পানির ট্যাংকে চলছিল ঘরোয়া মাছ চাষের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। একেকটি ট্যাংকের ধারণক্ষমতা ৩ হাজার লিটার; যা প্রতিনিয়ত রিসার্কুলেটেড সিস্টেমে পরিবর্তন হচ্ছে। সঠিক পুষ্টি ও অক্সিজেন পেয়ে বড় হচ্ছে তেলাপিয়া, পাবদা, গুলশা, কই, মাগুর, শিং, বাইমসহ বেশ কয়েক রকমের মাছ। বিসিএসআইআরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানিয়েছিলেন, ১১টি ট্যাংকের সেটআপ নিতে বিনিয়োগ করতে হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এ বিনিয়োগ ১০ বছরের জন্য। আর মাসিক বিল সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ধরে প্রতি কেজি পাবদার উৎপাদন খরচ দেখিয়েছিলেন ১৮০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি পাবদার বিক্রয়মূল্য ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। অবশ্য বিনিয়োগকারীরা এ টাকা অল্প দিনে তুলে নিতে পারবেন বলেও জানিয়েছিলেন রেজাউল করিম। অনুষ্ঠানটি প্রচারের পর দেশব্যাপী মৎস্য খামারিদের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রাথমিক অবকাঠামো ব্যয়। বিসিএসআইআরে প্রথমে এ অবকাঠামো নির্মাণে জার্মানির কারিগরি সহায়তা ও সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের খামারি উদ্যোক্তারা স্থানীয়ভাবে তাদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে অল্প খরচে অবকাঠামো বানাতে সক্ষম হন। অন্যদিকে চীনের বিভিন্ন কোম্পানি অপেক্ষাকৃত কম খরচে রাসের অবকাঠামো স্থাপনের বাণিজ্য শুরু করে। লক্ষ্য করেছি, এতে দেশের অনেক স্থানেই কম খরচে রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন শুরু হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বিসিএসআইআরও কম খরচে কীভাবে এ অবকাঠামো খামারিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় তা নিয়ে নতুন গবেষণা শুরু করে। গত সেপ্টেম্বরে বিসিএসআইআরের সে গবেষণা সরেজমিন দেখে আসি। এবার তারা ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪টি প্লাস্টিক বা পলি ট্যাংকে ৬০ হাজার লিটার পানিতে পরীক্ষামূলক মাছ উৎপাদন করছে। রাস পদ্ধতিতে এখানে সঠিক পুষ্টি ও অক্সিজেন পেয়ে কই, শিং, গুলশা ও টেংরা মাছ বেড়ে উঠেছে। ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানালেন, ঘনত্বের বিচারে পুকুরের তুলনায় যত বেশি এটি লাভজনক তার থেকে বেশি লাভের দিকটি হলো এখানে উৎপাদিত মাছ অনেক বেশি অর্গানিক ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। পাঁচ মাস আগে ২.৫ গ্রাম ওজনের কইয়ের পোনা ছেড়েছিলেন ১টি ট্যাংকে। এ পাঁচ মাসে প্রতিটির ওজন দাঁড়িয়েছে ৩০০-৩৫০ গ্রাম। পুকুরে চাষ করলে এই আকার পেতে সাত মাস লাগত। একদিকে যেমন কম সময়ে বেশি ফলন হচ্ছে অন্যদিকে এটি অর্গানিক ও অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত। পাশাপাশি পুকুরের চেয়ে ৫% বেশি প্রোটিনসমৃদ্ধ মাছ। শিংও পাঁচ মাসে বেশ বেড়ে উঠেছে। জানা গেল, প্রতিটির গড় ওজন ১৭০ গ্রাম। রেজাউল করিম জানালেন, রাস পদ্ধতিতে চাষ করা এসব মাছে নেই কোনো দূষিত পদার্থ, হেভি মেটাল। স্বাস্থ্যকর এসব মাছ স্বাস্থ্যের জন্য কোনো ক্ষতিই বয়ে আনবে না। রেজাউল করিমের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, দুই বছর আগে আপনি ৭০ লাখ টাকায় ইউরোপীয় যন্ত্রপাতি এনে পরীক্ষা করলেন। এবার তার অর্ধেক মূল্যে ৩৫ লাখ টাকায় চীনা যন্ত্রপাতি কিনে এনে আরএএস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। বহির্বিশ্বে যা পরীক্ষিত তা আবার পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? তিনি জানালেন, তার এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা রাস পদ্ধতিতে মাছ চাষ আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে কতটুকু সংগতিপূর্ণ তা যাচাই করা। তিনি বলছেন, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ নিরাপদ ও লাভজনক- এ বিষয়টি এখন পরীক্ষিত।

ইন্টারনেটের এই যুগে তথ্য ছড়িয়ে পড়ে নিমেষেই। এ দেশে খামারি ও উদ্যোক্তারা অনেক আগেই রাস বা বায়োফ্লক নিয়ে নিজের মতো করে গবেষণা করে নিজের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে ঠিকই লেগে গেছে মাছ উৎপাদনে। রাসের চেয়ে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে কম খরচ হওয়ায় দেশের মানুষ ঝুঁকছে বায়োফ্লকের প্রতিই বেশি। রেজাউল করিমের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, রাস ও বায়োফ্লকের মাঝে তুলনা করলে কোনটা কৃষকের বেছে নেওয়া উচিত। তিনি জানালেন, রাস পরীক্ষিত। বায়োফ্লক সে অর্থে পরীক্ষিত নয়। আর বায়োফ্লকে মূলত প্রোবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়। নাট্রিফায়িং ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনের একটা হিসাব আছে। চিংড়ির মতো কম খাদ্য গ্রহণকারী মাছের জন্য বায়োফ্লক সফল হলেও অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রে ততটুকু সফল না-ও হতে পারে। আমাদের দেশের তাপমাত্রা বা আবহাওয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা তা দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমি বললাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় বায়োফ্লক পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশেও খামারিরা সফলভাবেই মাছ চাষ শুরু করেছে। আপনারা সেগুলোকে কেস স্টাডি হিসেবে নিতে পারেন। যুগের সঙ্গে গোটা কৃষিব্যবস্থাই পাল্টে যাচ্ছে। মাঠকৃষি যেমন চলে যাচ্ছে, গ্রিন হাউসের ধারাবাহিকতায় এর আগে বিসিএসআইআরই নিয়ে এসেছিল গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক ঘাস উৎপাদনের কার্যকর ব্যবস্থা। এবার দেখা গেল প্রজেক্ট শেষ বলে সেখানে তালা ঝুলছে। প্রশ্ন হলো, এ গবেষণা মাঠ পর্যায়ে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে তাও নির্ধারণ করতে হবে।

প্রিয় পাঠক! বছরের পর বছর ধরে মাছ উৎপাদনের এসব উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা গ্রামীণ সাধারণ মাছ চাষি কিংবা উদ্যোক্তাদের জন্য কতটা সুখবর বয়ে আনছে? নাকি প্রকল্পের পর প্রকল্প চলবে আর সাধারণ মানুষ নিজের মতো করে একে একে অনুশীলন করবে? ইতিমধ্যে মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতি রাস ও বায়োফ্লক- দুটিই দেখেছেন। এর বাইরেও মাছ চাষের বেশ কয়েকটি আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ চলছে। এগুলো পর্যায়ক্রমে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারব, আশা করি। তবে নতুন উদ্যোক্তা ও খামারিদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তারা সব সময় স্বল্প বিনিয়োগে অর্থনৈতিক সাফল্যের সন্ধান করছেন। এখানে কয়েকটি বিষয় আমার পর্যবেক্ষণে এসেছে। এক. এখন মাছ চাষের আধুনিক পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে ইউটিউবে লোভনীয় কিছু ভিডিও থাকায় সেগুলো দেখে অনেক উদ্যোক্তা ঝুঁকে পড়ছেন। অনেক সময় ঠিকমতো যাচাই-বাছাইও করা হচ্ছে না। এর মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা সরেজমিন ঘুরে এসে সম্যক ধারণা নিয়ে চাষ শুরু করেছেন। দুই. নতুন উদ্যোক্তারা স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারে অনেক বেশি আগ্রহী। তিন. বিজ্ঞানসম্মত সরকারি প্রকল্পের সুফল নতুন উদ্যোক্তা পর্যায়ে দ্রুত পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। খামারিদের উপযোগী কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এখন পর্যন্ত টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভিডিও কনটেন্টই তাদের কাক্সিক্ষত তথ্যের প্রধান উৎস। এই সময়ে এসে বিসিএসআইআর একের পর উদ্যোগ নিচ্ছে ঠিক, কিন্তু মাছ চাষের নতুন নতুন বিজ্ঞানসম্মত সব পদ্ধতির নানামুখী পরীক্ষা, গবেষণা ও খামার পর্যায়ে বাস্তবসম্মত তথ্য ও পরামর্শ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাটি সবচেয়ে জরুরি। মনে রাখতে হবে, গোটা পৃথিবীই এখন সব উৎপাদন খাতে কম বিনিয়োগে বেশি লাভের দিকে ঝুঁকছে। এ ক্ষেত্রে মানুষকে যত কম অর্থ বিনিয়োগে কম ঝামেলায় লাভজনক খামার উদ্যোগের পরামর্শ দেওয়া যাবে ততই তারা উপকৃত হবেন।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর