শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কাতারে জনশক্তি রপ্তানি হুমকির মুখে

ড. আবদুল্লাহ আল মামুন

কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। ২০২২ বিন্ডাকাপ ফুটবল সামনে রেখে এখানে জনশক্তি রপ্তানি আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও আমিরাতের পরই হচ্ছে কাতারের অবস্থান। কাতারে বসবাসরত অন্যান্য প্রবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যার বিচারে ভারতীয়দের পর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও স্বাগতিক দেশে বাংলাদেশ কমিউনিটি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। উপরন্তু কিছু বাংলাদেশি বিভিন্ন অপরাধমূলক ও বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ায় কাতারে বাংলাদেশ কমিউনিটির ভাবমূর্তিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে কাতার পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারিতে রয়েছে বাংলাদেশ কমিউনিটি। কাজের চুক্তিপত্র, বেতন ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে মানুষ প্রবাসে পাড়ি দিচ্ছে। এভাবে খুব সহজেই ভিসা ব্যবসায়ীদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে অনেক প্রবাসী। অসাধু ব্যবসায়ীরা কোম্পানি খুলে মোটা টাকার বিনিময়ে কাজের কথা বলে শত শত কর্মী নিয়ে আসছে কাতারে। দেখা যাচ্ছে, কাতারে আসার পর তাদের জন্য কোনো কাজ নেই। দীর্ঘদিন কাজের সন্ধান না পেয়ে চরম হতাশায় কিংবা অর্থোপার্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে আইনবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। কোম্পানির আড়ালে ভিসা বেচাকেনা করে অর্থ কামিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কখনো হয়ে যায় লাপাত্তা। স্থানীয় কফিল বা স্পন্সরদের ভিসাপ্রতি কিছু অর্থ দিয়ে এ ধরনের অবৈধ কাজে সহযোগিতা করার জন্য প্রলোভিত করছে কিছু বাংলাদেশি ভিসা ব্যবসায়ী। এখন দোহা শহরের বহু এলাকার  ফুটপাথ, রেস্তোরাঁ ও মসজিদসংলগ্ন এলাকায় প্রচুর বাংলাদেশি নগরিককে কাজের সন্ধানে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের সমাবেশ কাতার কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে। তাই এ ধরনের জটলা থেকে বহু মানুষকে গাড়িতে তুলে নিয়ে জেলে ভরা হচ্ছে কিংবা সরাসরি দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইদানীং কিছু বাংলাদেশি জুয়া খেলা, গাঁজা ও ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্যের নেশা ও বেচাকেনায় মেতে উঠেছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্যানুযায়ী, ২ শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক এখন কাতারের জেলে রয়েছে, যার ৮০ শতাংশ মাদকসম্পৃক্ত অপরাধে জড়িত থাকার কারণে সাজা খাটছে। কারাভোগী অনেকের বয়স ২৫-৪০ বছরের মধ্যে। এদের কেউ আবার যাবজ্জীবন কারাদ- ভোগ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগের কথা, বিভিন্ন অবৈধ কার্যকলাপ ও সংঘাতের জেরে সম্প্রতি বাংলাদেশিদের হাতে একজন নেপালি নাগরিক নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশ কমিউনিটি একটি জটিল ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কাতারে জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মসজিদে ইমাম ও মুয়াজ্জিন পদে প্রচুর বাংলাদেশি ওলামা কর্মরত আছেন। কিন্তু গত বছর বাংলাদেশি এক মুয়াজ্জিনের হাতে বাহরাইনের এক ইমাম নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি ওলামাদের সুদিন শেষ হওয়ার পথে। ইতিমধ্যে বাহরাইন থেকে অর্ধশতাধিক ইমাম ও মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োজিত বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাহরাইনে ইমাম খুন হওয়ার ঘটনা কাতারেও প্রভাব ফেলেছে। জানা গেছে, কাতারে ইমাম ও মুয়াজ্জিন পদে ২০০ বাংলদেশির নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর হঠাৎ সেই নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। গত আগস্টে বকেয়া বেতনের দাবিতে কাতারের দুট বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের হাজারো বাংলাদেশি শ্রমিক বিক্ষোভ করতে রাস্তায় নামেন এবং কাতারের একটি মহাসড়ক অবরোধ করে বসেন। কাতারি কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের ফলে সমস্যার সুরাহা হলেও, এ ঘটনা বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ধারণা করা হচ্ছে। বেশকিছু স্থানীয় জনশক্তি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এ বিক্ষোভের পর তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো শ্রমিক আনতে আর আগ্রহী নন। বহুদিন ধরে বেতন না পাওয়ায় বিপর্যস্ত শ্রমিকরা হয়তো অনেকটা নিরুপায় হয়ে এ পথে নেমেছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, হরতাল, সড়ক অবরোধ, কাতারে সম্পূর্ণ অবৈধ। দাবি পূরণের জন্য স্বাগতিক দেশের আইন ভঙ্গ করে কখনই এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়। মাদকদ্রব্য সেবন ও পাচার প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেক নিরপরাধ মানুষ পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে সাজা ভোগ করছে। অপরিচিত কারও কোনো প্যাকেট কিংবা মাল কখনো নেওয়া উচিত নয়। এমনকি পরিচিত হলেও তা খুলে দেখে পরখ করে নিতে হবে। ইদানীং হারবাল বা ভেষজ ওষুধের আড়ালে কৌশলে নেশাজাত দ্রব্য গাঁজা, ভাং ইত্যাদি পাচার করা হচ্ছে। যাত্রীদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সব রকমের ওষুধের জন্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন সঙ্গে রাখা আবশ্যক। মাদক পাচার বন্ধ করতে হলে হাত দিতে হবে উৎসে। যাত্রী একবার কাতার চলে এলে তখন তেমন কিছু করার থাকে না। তাই বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে কড়া নজরদারি রাখতে হবে। উন্নত স্ক্যানিং পদ্ধতি চালু করতে হবে। বিমানবন্দরের কোনো কর্মচারী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। কাতারে মাদক ও নেশাজাত দ্রব্য ব্যবহার ও পাচারের জন্য সাজা খুবই কড়া।

কাতার আইনে এজন্য জেল, ৫ লাখ রিয়াল জরিমানাসহ সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ডেরও বিধান রয়েছে। মাদকের মতো ভিসা প্রতারণা বন্ধ করতে হলেও দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে। যেসব কোম্পানি শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে তাদের হাতে আসলেই কাজ আছে কিনা তা কোম্পানির প্রোফাইল যাচাই করে নিশ্চিত করতে হবে। জনশক্তি-সংশ্লিষ্ট সরকারি কার্যালয়ে দুর্নীতি বন্ধ ও দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : কাতারপ্রবাসী নগর পরিকল্পনাবিদ ও জলবায়ু গবেষক।

সর্বশেষ খবর