রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আলোর দিশারি শিক্ষকসমাজ

অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তরিত করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। সে কারণেই আমাদের সমাজে পিতা-মাতার পরই শিক্ষকের স্থান। সন্তানের জীবন দান করেন পিতা-মাতা কিন্তু তাকে উন্নত জীবনের আলোয় আলোকিত করেন শিক্ষক। পিতা-মাতা সন্তানের দৈহিক ও ব্যবহারিক চাহিদা মেটান সত্য, তবে তাকে সুনীতিমান, সুরুচিসম্পন্ন, সুশীল আর জ্ঞানবান করার কাজটি করেন শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষকের স্পর্শে যেমন শিক্ষার্থীর মানসিক দর্শনগুলো বিকশিত হয়, আবার তেমনই সে হয়ে ওঠে উত্তম হৃদয়ের অধিকারী সদাশয়, বিনয়ী, কল্যাণমুখী, সৃষ্টিশীল শ্রেষ্ঠ মানুষ। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশেষ আন্তরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলনে প্রণীত হয় শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অধিকার ও মর্যাদাবিষয়ক ঐতিহাসিক ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশ, ১৯৬৬। ১৩টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এবং ১৪৬ ধারা-উপধারাসংবলিত এই দলিলে শিক্ষককে দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার, মর্যাদা ও দায়দায়িত্বের বিষয় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

মানবাধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইউনেস্কো-আইএলও সুপারিশমালা জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বাংলাদেশসহ প্রতিটি রাষ্ট্রে যথাযথভাবে কার্যকর করা একান্ত প্রয়োজন। ইউনেস্কো-আইএলওর সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করে তুলতে ১৯৯৩ সালে সমন্বয়ক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বেলজিয়ামভিত্তিক সমগ্র বিশ্বের শিক্ষক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন  Education International.  শিক্ষকতার মর্যাদা ও দায়দায়িত্ববিষয়ক সুপারিশমালা প্রণয়নের দিবস ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাদানের জন্য  Education International  ইউনেস্কোকে অনুরোধ জানায়। তারই ফলে ১৯৯৪ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে সংস্থাটির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক এম মেয়র কর্তৃক ঘোষিত হয় ঐতিহাসিক ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ দিবসের আবেদন অনেক গভীর। সারা বিশ্বে একদিকে যেমন আনন্দ-উৎসবমুখর পরিবেশে সর্বস্তরের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ম্যাচ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি উদ্যাপিত হয়; আবার তেমনই আলোচনা, সংলাপ ও সমালোচনামূলক সভার মাধ্যমে শিক্ষকের পেশাগত সাফল্য অর্জন ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে শিক্ষার গুণগতমানের বিকাশ ও নিজেদের মর্যাদা অর্জনের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের উপায় নিরূপণ করতে পালিত হয় এই দিন। শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়, বরং এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে কালে কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞান ভান্ডার। অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি প্রতিদানে কী পেয়েছেন। শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার মহৎ চেতনা ও উপলব্ধি তাকে শিক্ষাদান করার পবিত্র দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে। এর জন্য তাকে সারা জীবন ত্যাগ করতে হয়, সংগ্রাম করতে হয় তবু তিনি আদর্শচ্যুত হন না। শিক্ষার্থীকে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে তাদের অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী, অনুসন্ধানী ও জ্ঞানপিপাসুরূপে গড়ে তোলাই শিক্ষকের দায়িত্ব। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে এমন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠদান করবেন যাতে শিক্ষার্থীর আর গৃহশিক্ষকের বা আলাদা করে কোচিংয়ের প্রয়োজন না হয়। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকের নিজের আচরণ যেন তার বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। এখন প্রশ্ন- এই মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকরা কতটুকু যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটুকু আন্তরিক? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আবার প্রশ্ন আসে শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেখতে হবে দেশের এই শ্রেষ্ঠ মানুষ শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন কি? পাচ্ছেন কি? প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হতে চলল কিন্তু এখনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের অসংগতিপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থাই গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার অন্তরায়। তা ছাড়া এখনো একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় দিকনির্দেশনাহীন, সমন্বয়হীন এক অব্যবস্থাপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রমের ফলে, চলছে নিয়োগবাণিজ্য ও ভর্তিবাণিজ্য ইত্যাদি; যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ৯০%-এর অধিক শিক্ষার্থীর প্রয়োজন মেটাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, কিন্তু সে অনুপাতে শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার কোনো ক্ষেত্রেই তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। আবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরিরত শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর মতো বেতন-ভাতা, চাকরিবিধি, নিয়োগনীতি, অবসর-জীবনের আর্থিক নিরাপত্তার সুযোগ এমনকি পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগও নেই। যদিও একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে সহজ ও সুন্দরভাবে জীবনযাপনের জন্য তাদের অভিন্ন বেতন-ভাতা, চাকরির নিশ্চয়তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।

লেখক : সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর