রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শহীদ নূর হোসেন

শফী আহমেদ

শহীদ নূর হোসেন

নূর হোসেন দিবস আজ। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর গণতন্ত্রের সংগ্রামে জীবন দিয়েছিলেন এই অমিত সাহসী যুবক; যার বুকে-পিঠে লেখা ছিল ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নূর হোসেনসহ শত শহীদের রক্তের পথ বেয়ে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের সুফল বাংলাদেশের জনগণ ভোগ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বার বার ব্যাহত হয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো এখনো রয়ে গেছে উপেক্ষিত। গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে বিকশিত না হওয়ায় আমরা এখনো রয়ে গেছি অসম্পূর্ণ গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতায়।

সময় ১৯৮৭ সাল, ১০ নভেম্বর। বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হচ্ছে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাত্রা। অনেক নারকীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জগদ্দল পাথরকে এত সহজে সরানো যায় না। খুনি জিয়া খুন হয়ে যাওয়ার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের নব্য সংস্করণ ও ধারাবাহিকতা এরশাদের সামরিক শাসন। ’৮২-এর ২৪ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলো ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০-দলীয় ঐক্যজোট পৃথকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ’৮৩-এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ শত শত সাথী, যাদের লাশ গুম করে ফেলে স্বৈরশাসক। আন্দোলনের নবতর যাত্রায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫-দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি সাতদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু আন্দোলনের যাত্রাপথে ’৮৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫-দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। আট দল, পাঁচ দল ও সাত দলÑ এই তিনটি জোটের আবির্ভাব ঘটে। সবার লক্ষ্যই এক ও অভিন্ন। সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।

সেদিন ছিল আট দল, পাঁচ দল ও সাত দলের নৌপথ-রেলপথ-রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট। কার্তিকের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলে দলে মানুষ সমবেত হতে থাকে নিজ নিজ জোটের ব্যানারে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আটদলীয় জোটের অবস্থান ছিল এখন যেখানে নূর হোসেন স্কোয়ার। পাঁচদলীয় জোটের অবস্থান ছিল হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সামনে আর সাত দলের অবস্থান ছিল দৈনিক বাংলা মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আটদলীয় জোটের অবস্থানে মিলিত হলো একদল সাহসী যুবকের খন্ড মিছিল। ওই মিছিলটি গুলিস্তান থেকে তোপখানা মোড় পর্যন্ত বার বার প্রদক্ষিণ করছিল এবং আন্দোলনকামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন নূর হোসেন। খন্ড মিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল উপরোক্ত স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান। আমরা যারা পাঁচ দলের ছাত্রকর্মী ছিলাম, তারাও হাউস বিল্ডিং থেকে জিরো পয়েন্ট আবার কখনো দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সমবেত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে প্রকম্পিত করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। স্বৈরাচার এরশাদের পুলিশবাহিনী প্রথমে টার্গেট করে গুলি করে নূর হোসেনকে হত্যা করে, পরে শুরু হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন সেই মঞ্চকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। পাঁচ দল ও সাত দলের অবস্থানের ওপরও পুলিশ জলকামান ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষ ঠেকানোর ক্ষমতা স্বৈরাচারের ছিল না। সেদিন নূর হোসেনের জীবনদান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, বিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সেদিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ। ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শহীদ যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই নূর হোসেন যুক্ত হলেন আরেক স্বাধীনচেতা আত্মোৎসর্গকারী যুবক হিসেবে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর