শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন শৃঙ্খলা

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন শৃঙ্খলা

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস এক মহামারী রোগ। কয়েক দশক আগেও এটি ছিল খুব স্বল্প পরিচিত রোগ। অথচ বর্তমানে শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, বরং উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত বিশ্বেও অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াবেটিস সাধারণত দুই রকম। টাইপ ১ বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস, যা মূলত কম বয়সীদের হয়ে থাকে। তাতে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করার ক্ষমতা হারায় এবং এসব রোগীর ইনসুলিন অপরিহার্য। আরেকটি হচ্ছে টাইপ টু বা ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস। বিশ্বজুড়ে ৮০ শতাংশ হলো টাইপ ২ ডায়াবেটিস, যা বয়স্কদের হয়ে থাকে। স্থূলতা বা ওজন বৃদ্ধি, মন্দ খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, মানসিক চাপ, ধূমপান ইত্যাদি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। বর্তমানে একই সঙ্গে বাড়ছে নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা ‘জিডিএম’-এর প্রবণতা। ডায়াবেটিসের কারণ : বিভিন্ন কারণে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যেমন- টাইপ ১-জন্মগত কীংবা পরিবেশতগত কারণে এই ডায়াবেটিসের প্রকোপ দেখা যায়। বছরে তিন শতাংশ এই ডায়াবেটিস বাড়ছে এবং সাধারণত তরুণরাই এতে আক্রান্ত হচ্ছে । টাইপ ২- অতিরিক্ত ওজন, মেদবাহুল্য, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, উচ্চ শর্করা এবং কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভ্যাস থাকলে এই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বংশগত কারণেও এই ধরনের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। বাবা-মা কারও একজনের ডায়াবেটিস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে, আর দুজনেরই থাকলে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা অনেক গুণ বেড়ে যায়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস : অনেক সময় শুধু গর্ভকালেই ডায়াবেটিসের উদ্ভব ঘটে। মেডিকেল সাইন্সের পরিভাষায় একে ‘জিডিএম’ বলে। এটি মা এবং শিশুর অসংখ্য জটিলতার কারণ হতে পারে। সঠিক কারণ জানা না গেলেও পরিবারে ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিসের লক্ষণ : ডায়াবেটিসের মূল লক্ষণ ইংরেজির তিনটি ‘পি’- পলিফেজিয়া বা অধিক ক্ষুধা লাগা, পলিডিপসিয়া বা অধিক তৃষ্ণা, পলিইউরিয়া বা অতিরিক্ত ঘন ঘন প্রস্রাব। আরও কিছু লক্ষণ হলো- ক. মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঘনঘন প্রস্রাবে ইনফেকশন। খ. স্বল্প সময়ে জানা কোনো রোগ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া, দুর্বল বোধ করা বা অবসাদ। গ. নগ্ন শরীরে ফোঁড়া, জিহ্বায় সাদা ক্যানডিডার আক্রমণ, মহিলাদের যৌনাঙ্গে ছত্রাক জাতীয় রোগের আক্রমণ, হাত-পায়ে ঘা বা আঙ্গুলের মাঝে ছত্রাকের আক্রমণ। ঘ. শরীরের যে কোনো অংশে ছোট বড় ঘা বা ক্ষত হলে তা শুকাতে দেরি হওয়া। ঙ. হাত-পা অবস হয়ে আসা বা ভারী ভারী লাগা। মেডিকেল টার্মে এগুলোকে নিউরোপ্যাথি বলে, যার অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। চ. গ্রামেগঞ্জে খোলা জায়গায় প্রস্রাব করলে সেখানে পিঁপড়া আসা। ছ. মনে রাখতে হবে অনেক রোগীর ডায়াবেটিসের কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। অন্য কোনো রোগের জন্য সুগার পরীক্ষা করাতে গিয়ে এই ডায়াবেটিস প্রথমবার ধরা পড়ে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয় : ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একবার আক্রান্ত হলে নিরাময়ের আশা একেবারেই ক্ষীণ। তবে এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন কিছু নয়। তাই রোগ হওয়ার আগেই একে প্রতিরোধ করাটা জরুরি। খাদ্যাভ্যাস : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি নিয়মতান্ত্রিক খাদ্যাভ্যাস। পরিমাণ মতো খাওয়ার অভ্যাস, বেশি বেশি সবুজ শাকসবজি, কম চর্বি ও কম শর্করাযুক্ত খাদ্য গ্রহণ এবং অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার বর্জন বা কম খাওয়া। কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম : ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস, সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করা, সম্ভব হলে সাঁতার, জগিং এবং শিশু, কিশোর ও বয়স্ক সবার মধ্যেই কায়িক শ্রমের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অলস জীবনযাপন পরিহার করা উচিত। জেনে রাখা ভালো ব্যায়াম ইনসুলিনের কার্যকারিতা এবং নিঃসরণ বাড়ায়, রক্তের ভালো কোলেস্টেরল কমায়।

শিক্ষা ও সচেতনতা : ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তকে সঠিক জীবনাচরণ সম্পর্কে তথ্য অন্তর্ভুক্তি, মিডিয়ায় গণসচেতনতা, শিক্ষক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজ কর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প- ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বংশগত বিষয়টি যেহেতু এড়ানো সম্ভব নয়, তাই অন্য ঝুঁকিগুলো কমিয়ে ফেলতে হবে। ৩৫ বছরের পর থেকে বছরে অন্তত একবার রক্তের সুগার পরীক্ষা, ওজন হ্রাস, দুর্বলতা, পিপাসা বৃদ্ধি বা ঘন ঘন প্রস্রাব ইত্যাদি কোনো লক্ষণ দেখা গেলে অবিলম্বে রক্তের সুগার পরীক্ষা করে নেওয়া, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে এমন কেউ সন্তান ধারণের পরে রক্তে শর্করা পরীক্ষা করা, গর্ভধারণের ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে অবশ্যই সুগার পরীক্ষা করা ইত্যাদির মাধ্যমে ডায়াবেটিস শনাক্ত করা যায়। রোগীদের নিজেদেরই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার দক্ষতা অর্জন করা দরকার। জীবন প্রণালির কাক্সিক্ষত পরিবর্তন, রোগের লক্ষণ ও ঝুঁকি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, কখন কেন সুগার পরীক্ষা করা জরুরি, পরীক্ষার সহজলভ্যতা ও ব্যয় সংকোচন-এ বিষয়গুলো সবার জানা উচিত।

শৃঙ্খলা : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল ভিত্তিই হলো সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। নিয়মমাফিক খাওয়া-দাওয়া, ঠিকমতো হাঁটাচলা বা ব্যায়াম, ওষুধপত্র ব্যবহার ইত্যাদি যারা মেনে চলেন, তারা যেমন ডায়াবেটিস থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন, তেমনি আক্রান্ত হলেও সহজেই একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপন যেমন সম্ভব, তেমনি ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা থেকেও বাঁচা সম্ভব।

রোগীদের আর কি করণীয় : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা দেখার জন্য মাঝেমধ্যে রক্তের সুগার টেস্ট করাতে হয়। স্বল্প দামের গ্লুকোমিটার দিয়ে বাড়িতে বসে সহজেই এটি করা যায়। অভুক্ত অবস্থায় রক্তের সুগারের পরিমাণ ছয় মিলিমোল এবং খাওয়ার পরে আট মিলিমোল কাছাকাছি হলে ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে করতে হবে। রক্তের HbA1c মেপেও নিয়ন্ত্রণের ধারণা করা যায়। HbA1c 7% নিচে হলে তিন মাস ধরে সুগার ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।

চিকিৎসা পদ্ধতি : ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য সংক্ষিপ্ত তিনটি ‘ডি’ অনুসরণীয়- ক. প্রথম ‘ডি’-ডায়েট বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ৬০ থেকে ৮০ ভাগ রোগী এতেই ভালো থাকেন। খ. দ্বিতীয় ‘ডি’-ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন। গ. তৃতীয় ‘ডি’- ড্রাগ বা ওষুধ, খুব অল্প সংখ্যক রোগীরই এর প্রয়োজন পড়বে। মনে রাখতে হবে, প্রথম ও দ্বিতীয় ‘ডি’ অর্থাৎ শৃঙ্খলা ও খাদ্য নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমেই ডায়াবেটিসকে ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব; ওষুধের ভূমিকা এখানে খুব কম। আবার প্রথম দুটিকে বাদ দিয়ে শুধু ওষুধের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ খুবই দুরূহ। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়।

লেখক : ইউজিসি অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর