শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আল্লাহর ওপর ভরসা করে দাওয়াতে এগিয়ে যেতে হবে

মুফতি এহসানুল হক জিলানী
পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কি জীবনকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। নবুয়তপ্রাপ্তির আগের সময় আর নবুয়তপ্রাপ্তির পরের সময়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি গোটা আরব জাতির কাছে ছিলেন আস্থার প্রতীক। আরবরা সম্মিলিতভাবে তাঁকে ‘আল আমিন’ অভিধায় অভিহিত করেছিল। আরবরা তাদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের নিরসনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করত এবং সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিত। যেমন নিচের ঘটনাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স ৩৫ বছর, তখন কুরাইশরা কাবাঘর পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। বায়তুল্লাহর নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করতে পারাকে প্রত্যেকেই নিজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় মনে করত। আর কুরাইশ গোত্রগুলো বায়তুল্লাহ নির্মাণে কে কার চেয়ে বেশি অংশ নিতে পারে, এর ওপর নিজেদের ভাগ্যের ফয়সালা করে রেখেছিল। তাই সম্ভাব্য ঝগড়া এড়ানোর নিমিত্ত এর নির্মাণকাজকে গোত্রগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। এই কর্মবণ্টন পদ্ধতির মাধ্যমে কাবাঘরের নির্মাণকাজ ‘হাজরে আসওয়াদ’ বসানোর স্থান পর্যন্ত সুসম্পন্ন হয়ে গেল। কিন্তু নির্মাণের এই পর্যায়ে এসে হাজরে আসওয়াদকে উঠিয়ে তার নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করার ব্যাপারে তাদের মাঝে চরম মতানৈক্য দেখা দিল। প্রতিটি গোত্র ও ব্যক্তিরই প্রাণের দাবি ছিল, সে এই সৌভাগ্য লাভ করবে; এমনকি এর জন্য হত্যা ও লড়াইয়ের ব্যাপারে ওয়াদা ও অঙ্গীকার নেওয়া আরম্ভ হলো। সম্প্রদায়ের কিছু ভদ্র ও চিন্তাশীল ব্যক্তি চিন্তা করলেন, পরামর্শের মাধ্যমে মীমাংসার কোনো পথ বের করবেন আর এ উদ্দেশ্যে তারা মসজিদে সমবেত হলেন। পরামর্শে সিদ্ধান্ত হলো, আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি সবার আগে মসজিদের নির্দিষ্ট এই দরজা দিয়ে কাবা চত্বরে প্রবেশ করবেন, তিনিই তোমাদের এ ব্যাপারে ফয়সালা দেবেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তকে কুদরতি ফয়সালা মনে করে প্রত্যেকে তা মেনে নেবে। মহান আল্লাহর কুদরত যে, সবার আগে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে সবাই একবাক্যে বলে উঠল, ‘ইনি আল আমিন, আমরা তাঁর সিদ্ধান্ত মানতে সম্মত আছি।’ নবীজি এগিয়ে এলেন এবং এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ ফয়সালা দিলেন, যাতে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে গেল। তা হলো : তিনি একটি চাদর বিছালেন এবং নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদটি তাতে রেখে দিলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন, প্রত্যেক গোত্রের ব্যক্তিরা যেন চাদারের এক এক কোণ ধরে। এভাবেই করা হলো। যখন তা ভিত পর্যন্ত পৌঁছল, তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে পাথরটি তুলে যথাস্থানে রেখে দিলেন। আরবদের এমন আস্থা ও ভালোবাসার মধ্যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের ৪০টি বছর অতিবাহিত করেন। কিন্তু ৪০ বছর বয়সে নবুয়তলাভের পর এ চিত্র পাল্টে যায়। নিচে আমরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়ত-পরবর্তী মক্কি জীবনের কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি-

নবুয়ত লাভ : নবুয়ত রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ৪০ বছর, একদিন আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বের জন্য করুণাস্বরূপ ও মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। এর আগে পৃথিবীতে যত নবী-রসুল এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আল্লাহতায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তাঁরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মোকাবিলায় সাহায্য করবেন। আর তাঁদের প্রতি যারা ইমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদেরও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তপ্রাপ্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ যখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়তের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের মতো বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এই সময় আল্লাহ তাঁকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করেন। একাকী অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে। আবদুল মালিক ইবনে ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যখন নবুয়তের সূচনা করলেন, তখন তিনি (রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনো প্রয়োজনে বাইরে বেরোলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে কোনো পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই যেতেন ওই পাথর বা গাছ বলে উঠত আসসালামু আলাইকুম ইয়া রসুলুল্লাহ। তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাশে তাকিয়ে গাছ-পাথর ছাড়া কিছুই দেখতেন না।’

প্রকাশ্য দাওয়াত : নবুয়তপ্রাপ্তির পর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোপনে তিন বছর দাওয়াতের কাজ পরিচালনা করেন। তিন বছর যাবৎ গোপন দাওয়াত দেওয়ার পর এবার আল্লাহর হুকুম হলো প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার। নাজিল হলো, ‘নিকটতম আত্মীয়স্বজনকে ভয় প্রদর্শন করুন।’ সূরা শুয়ারা, আয়াত ২১৪। কিন্তু প্রকাশ্য দাওয়াত দেওয়ার প্রতিক্রিয়া যে অতীব কষ্টদায়ক হবে, সে বিষয়ে আগেভাগেই স্বীয় নবীর মন-মানসিকতাকে প্রস্তুত করে নেন সূরা শুয়ারা নাজিল করে। ২২৭ আয়াত-বিশিষ্ট এই সূরার শুরুতেই আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেন, ‘লোকেরা ইমান আনছে না বলে হয়তো আপনি মর্মবেদনায় আত্মঘাতী হওয়ার উপক্রম করেছেন। জেনে রাখুন, যদি ইচ্ছা করি, তাহলে আকাশ থেকে তাদের ওপর এমন নিদর্শন (গজব) অবতীর্ণ করতে পারি, যা দেখে এদের সবার (উদ্ধত) গর্দান অবনত হয়ে যাবে।’ এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে, অহংকারী সমাজনেতাদের আচরণে বেদনাহত হয়ে তাওহিদের দাওয়াত থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। বরং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বুকে বল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

সর্বশেষ খবর