রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আয়করের হিসাব-নিকাশ

তপন কুমার ঘোষ

আয়করের হিসাব-নিকাশ

আয়কর দেওয়া আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। সুনাগরিক হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে নিয়মিত ও সঠিক আয়কর দেওয়া। গত বছরের ১ জুলাই থেকে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়কালের আয়কর রিটার্ন ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দাখিল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আয়বর্ষ হবে ২০১৮-১৯ এবং করবর্ষ হবে ২০১৯-২০। বস্তুতপক্ষে, রিটার্ন দাখিল শুরু হয়েছে ১ জুলাই থেকে। রিটার্ন ইতিমধ্যে দাখিল করা না হয়ে থাকলে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। আয়কর রিটার্ন কারা দাখিল করবেন : সাধারণভাবে, কোনো ব্যক্তি-করদাতার করযোগ্য আয় যদি আয়বর্ষে (২০১৮-১৯) আড়াই লাখ টাকার বেশি হয় তবে তাকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। তবে কোনো নারী এবং ৬৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সের কোনো করদাতার করযোগ্য আয় বছরে তিন লাখ টাকা অতিক্রম করলে তাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সোয়া চার লাখ টাকা। নয় ধরনের পেশাজীবীর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়াও কয়েকটি ক্ষেত্রে, আয়ের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট আয় বছরের জন্য করদাতাকে আবশ্যিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার অথবা সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, সত্তা বা ইউনিট বা আইনের মাধ্যমে গঠিত কোনো কর্তৃপক্ষ, করপোরেশন, সত্তা বা ইউনিটের কোনো কর্মচারী আয়বর্ষের যে কোনো সময় ১৬ হাজার টাকা বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ মূল বেতন আহরণ করে থাকলে তাকে আবশ্যিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আয়ের খাত : ১০টি খাতের আয় করদাতার মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এগুলো হচ্ছে, বেতনাদি, নিরাপত্তা জামানতের উপর সুদ, গৃহ-সম্পত্তির আয়, কৃষি আয়, ব্যবসা বা পেশার আয়, মূলধনী লাভ, অন্যান্য উৎস হতে আয়, ফার্ম বা ব্যক্তিসংঘের আয়ের অংশ, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান, স্ত্রী বা স্বামীর (পৃথকভাবে আয়কর নথি না থাকলে) আয় ও বিদেশ থেকে আয়। বেতনাদি খাতের আয় : সাধারণভাবে (সরকারি বেতন আদেশভুক্ত কর্মচারী ব্যতীত) একজন চাকরিজীবী করদাতার প্রাপ্ত মূল বেতন, মহার্ঘ ভাতা, উৎসব ভাতা, বোনাস, পরিচারক ভাতা, সম্মানী ভাতা, ওভারটাইম ভাতা, স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত চাঁদা এবং বিভিন্ন পারকুইজিট (সুবিধা) করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিলে অর্জিত সুদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থসহ অন্যান্য কয়েকটি উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংক করমুক্ত। বাড়ি ভাড়া ভাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত সীমা হচ্ছে, মূল বেতনের ৫০ শতাংশ অথবা মাসিক ২৫ হাজার টাকাÑ এ দুটির মধ্যে যেটি কম। চিকিৎসা ভাতার ক্ষেত্রে মূল বেতনের ১০ শতাংশ অথবা বার্ষিক এক লাখ ২০ হাজার টাকা, এ দুটির মধ্যে যেটি কম সে পরিমাণ অঙ্ক করমুক্ত। যাতায়াত ভাতার করমুক্ত সীমা হচ্ছে বার্ষিক ৩০ হাজার টাকা। সরকারি বেতন আদেশভুক্ত কোনো কর্মচারীর সরকার প্রদত্ত মূল বেতন, উৎসব ভাতা ও বোনাস করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচিত হবে। অবসরকালে প্রদত্ত লাম্প গ্র্যান্টসহ সরকারি বেতন আদেশে উল্লিখিত অন্যান্য ভাতা ও সুবিধাদি যেমন, বাড়ি ভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা ইত্যাদি করমুক্ত থাকবে।  গৃহ-সম্পত্তি আয় : করদাতা তার বাড়ি আবাসিক বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ভাড়া দিলে, সে আয় গৃহ-সম্পত্তি আয় খাতে দেখাতে হবে। ভাড়া থেকে অনুমোদিত খরচ (মেরামত,  পৌর কর, ভূমি রাজস্ব, ঋণের সুদ ইত্যাদি)বাদ দেয়ার পর এ খাতে করযোগ্য আয় নির্ণীত হবে।  নিরাপত্তা জামানতের ওপর সুদ : সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত বন্ড বা সিকিউরিটিজ(টিএন্ডটি বন্ড, ট্রেজারি বন্ড, ট্রেজারি বিল ইত্যাদি) হতে অর্জিত সুদ এবং জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ এ খাতের আয় হিসেবে গণ্য হবে। অন্যান্য উৎস হতে আয় : বাংকে গচ্ছিত টাকার ওপর সুদ, নগদ লভ্যাংশ, লটারি, যন্ত্রপাতি ভাড়া দিয়ে আয়, বক্তৃতা বা লেখার সম্মানী ইত্যাদি অন্যান্য সূত্রের আয়। উৎসে কর কর্তন করা হয়ে থাকলে মোট প্রাপ্তি (উৎসে কর কর্তনের পূর্ববর্তী অঙ্ক)এ খাতের আয় হিসেবে দেখাতে হবে, নিট প্রাপ্তি নয়। করমুক্ত বা করঅব্যাহতিপ্রাপ্ত আয় : করমুক্ত এবং করঅব্যাহতিপ্রাপ্ত আয় করদাতার মোট আয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে না। এটি রিটার্নে করমুক্ত আয়ের কলামে দেখাতে হবে। করমুক্ত আয়ের মধ্যে অন্যতম হলো - পেনশন, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত গ্র্যাচুইটি, স্বীকৃত প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ, ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইনভেস্টমেন্ট বন্ড ও প্রিমিয়াম বন্ড ইত্যাদি হতে প্রাপ্ত সুদ আয়। ২০১৮-১৯ আয়বর্ষে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে পুঞ্জীভূত বিনিয়োগের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকা অতিক্রম না করলে পেনশনার সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্য মুনাফা/সুদ করমুক্ত থাকবে। আয়করের হার : সাধারণভাবে, ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতাদের আয়ের প্রথম আড়াই লাখ টাকার ওপর কোনো কর দিতে হবে না। তবে নারী, ৬৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতা, প্রতিবন্ধী এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি ছাড় আছে। করমুক্ত আয়সীমার পরবর্তী চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর ১০ শতাংশ হারে, এর পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর ১৫ শতাংশ হারে, পরবর্তী ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর ২০ শতাংশ হারে, তৎপরবর্তী ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের উপর ২৫ শতাংশ হারে এবং অবশিষ্ট আয়ের উপর ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

ন্যূনতম কর : করমুক্ত আয়সীমার অতিরিক্ত আয়ের ক্ষেত্রে প্রদেয় ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ হবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা। অন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় চার হাজার টাকা এবং অনান্য এলাকায় তিন হাজার টাকা।  কর রেয়াত : নির্দিষ্ট ২২টি খাতে বিনিয়োগ/দান করলে বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে নতুন বিনিয়োগ করা হলে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। কোনো তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপোজিট পেনশন স্কিমে বার্ষিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত কিস্তি জমার ওপর কর রেয়াত পাওয়া যাবে।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর