বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী

নূর ইসলাম হাবিব

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন এবং ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি বৈমানিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত ও উদ্দীপ্ত করে। যুদ্ধ শুরু হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালি বৈমানিকরা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে পালিয়ে আসার সময় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমান পাকিস্তান থেকে যুদ্ধবিমান ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের চেষ্টাকালে ওই বিমান দুর্ঘটনায় শাহাদাতবরণ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বাঙালি বৈমানিকরাও পালিয়ে ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ’৭১ সালের মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে এক নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট এলাকায় বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ধ্বংস ও চট্টগ্রাম এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে তার একক কৃতিত্ব রয়েছে। তা ছাড়া, তিনি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ইউনিট কিলো ফ্লাইটেরর প্রথম অধিনায়ক।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। বন্দী অবস্থায় তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এজন্য তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।

ঢাকা থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমেদ রেজা (অব.), ইউং কমান্ডার শামসুর রহমান মির্জা (অব.), ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম ও স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। তারা এভাবে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, স্কোয়াড্রন লিডার হাবিবুর রহমান ও ফ্লাইং অফিসার জি এইচ মির্জা পালাতে গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ইউনিট কিলো ফ্লাইট গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা হয়। ভারতের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া তিনটি এয়ারক্রাফট নিয়ে গঠিত হয় কিলো ফ্লাইট। পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ (পিআইএ পাইলট) ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। ডিএইচসি-৩ অটার বিমানের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (পিআইএ পাইলট) ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ (বেসরকারি কোম্পানির পাইলট)। ডিসি-৩ ডাকোটা বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক (পিআইএ পাইলট), ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত (পিআইএ পাইলট) ও ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার (পিআইএ পাইলট)।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর টেকনিশিয়ানরা অক্লান্ত পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে তিনটি নন-কমব্যাট এয়ারক্রাফটকে যুদ্ধোপযোগী বিমানে রূপান্তর করেন। এ কাজে সাহায্য করেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। কিলো ফ্লাইটের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে। কিলো ফ্লাইটে অফিসারের ছিলেন নয়জন, বিমান সেনা ছিলেন ৩৮ জন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার ৬ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান ১১ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৩ ডিসেম্বর অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথম অপারেশন চালানো হয়। হেলিকপ্টারটির পাইলট ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। সঙ্গে ছিলেন মেশিনগান চালানোর মতো একজন গানার। সাহসী বৈমানিকদ্বয় ওইদিন রাতে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে তেল ডিপোতে রকেট হামলা করে তা জ্বালিয়ে দেন।

৩ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ অটার বিমান দিয়ে এ হামলা চালান। রাত ১১টা ৪০ মিনিটে উড্ডয়ন করে রাত ১টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছান। তারা এ সময় ১৪টি রকেট ফায়ার করে তেল ডিপোতে আগুন ধরিয়ে দেন। সব অভিযান শেষে ভোররাত ৩টা ১০ মিনিটে শিলচরে ফিরে আসেন তারা।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ১ হাজার ১৩১ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য একজন বীরশ্রেষ্ঠ, ছয়জন বীরউত্তম, একজন বীরবিক্রম ও ১৫ জন বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন (মোট ২৩ জন)। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ছয়জন অফিসারসহ মোট ৫০ জন সদস্য মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) শামসুল আলমকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১১ সালে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার ও স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলমকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। যুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকার জন্য ২০১৮ সালে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদকেও স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

লেখক : সহকারী পরিচালক

আইএসপিআর।

 

সর্বশেষ খবর