মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তি মিশনের লক্ষ্য ছিল জুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম। ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি সমাজে ন্যায়বিচারের মানদ- সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জাতি-ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণি, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, ধনী-দরিদ্র, প্রভু-ভৃত্য সবার ক্ষেত্রে বিচার সমান, এখানে বিন্দুমাত্র হেরফেরের অবকাশ ছিল না। সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনি অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালান। সমকালীন দুনিয়া বিশেষত প্রাক-ইসলামী সমাজে ধনসম্পদ ছিল আভিজাত্যের মাপকাঠি, কামিয়াবির নিদর্শন, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাই মানুষ হন্যে হয়ে অর্থ ও সম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটেছে সারা জীবন। বৈধ-অবৈধ, হালাল-হারাম, ন্যায়-নীতি, পাপ-পুণ্য এসব ধার ধারেনি। এভাবে মানুষ হয়েছে অর্থসম্পদের দাস আর অর্থসম্পদ হয়েছে তাদের প্রভু। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লক্ষ্যে ওহিনির্ভর যে দর্শন পেশ করেন তা হলো মানবজীবনে অর্থসম্পদ অপরিহার্য। মানুষ ও মানুষের সব কর্মকা- কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিবেদিত। সুতরাং অর্থসম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত পথে। এতেই নিহিত আছে মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবি। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনগণকে নীতি ও বিধিসম্মতভাবে অর্থসম্পদ অর্জন করার এবং জাকাত ও সদকার মাধ্যমে সে অর্জিত সম্পদের কিয়দংশ দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দেন। অধিকন্তু রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য তিনি ছয় ধরনের রাজস্ব প্রবর্তন করেন। এগুলো হলো ১. আল-গনিমাহ বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি ২. জাকাত বা ধনীদের দেয় দরিদ্রকর ৩. খারাজ বা অমুসলিম কৃষকের ভূমিকর ৪. জিজিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর ৫. আল-ফে বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ৬. সদকা বা স্বেচ্ছাধীন দান।

এসব খাতে সংগৃহীত রাজস্ব নির্ধারিত হারে জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এ ব্যবস্থা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা জীবনে এবং পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে জনগণের সামাজিক জীবনে আশানুরূপ সুফল বয়ে আনে। অভাব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী। স্বচ্ছন্দ এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, জাকাত গ্রহণের জন্য কোনো দুস্থ পাওয়া যায়নি। তিনি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশকৌলিন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজবন্ধন সুদৃঢ় করেন। এই পৃথিবীতে সব মানুষই যে আল্লাহর দৃষ্টিতে সমান, কৃষ্ণ-শ্বেত, ধনী-নির্ধন সবই যে আল্লাহসৃষ্ট মানুষ, সব মানুষই যে পরস্পর ভাই, ধর্মীয় ও কর্মীয় অধিকার যে সব মানুষেরই সমান এ কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন এবং স্বীয় কর্মে ও আচরণে প্রমাণ করেন ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনিই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন মানুষের মুক্তিবাণী। সারা জীবনের সাধনায় তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন এমন এক সমাজ, যে সমাজে মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, ব্যক্তি ও জাতি-গোত্র পায় পূর্ণ স্বাধীনতার আস্বাদন।

             লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।

সর্বশেষ খবর