শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক

শফী আহমেদ

গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করুক

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর, ডা. মিলনের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।  মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের জীবনদান পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির স্বাধিকার-স্বাধীনতার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল। ২৪ জানুয়ারি শহীদ মতিউরের আত্মত্যাগের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। সফল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরেই ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। ঠিক তেমনি ডা. মিলনের আত্মদানের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির কাঁধে চেপে বসা সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর অপসারণের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। শহীদ ডা. মিলন স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের, নিয়োজিত রেখেছিলেন নিজেকে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, আদর্শবান চিকিৎসক আত্মাহুতি দিয়ে প্রমাণ করলেন সব স্বৈরাচার কোনো না কোনো দিন রক্তের স্রোতে জনতার সম্মিলিত আন্দোলনে ভেসে যেতে বাধ্য হয়। আজকের এই দিনে ডা. মিলনকে আমরা স্মরণ করি একজন সংগ্রামী মানুষের পথিকৃৎ হিসেবে।  সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের একজন নেতা হিসেবে আমি সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। অনেকদিন হয়ে গেল নতুন প্রজন্ম হয়তো জানে না সেদিন কী ঘটেছিল, সেদিন যা ঘটেছিল তা নিম্নরূপ- প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের এক বিরাট লাঠিমিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। স্বাভাবিক নিয়মে খন্ড খন্ড মিছিল মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হয়। পরে কেন্দ্রীয় মিছিল শুরু হয়। সেদিন আমরা মিছিল না থামিয়ে লাইব্রেরি, টিএসসি, এলাকা চক্কর দিতে বললাম। মিছিল হাকিম চত্বর অতিক্রম করেছে, এ অবস্থায় সন্ত্রাসীদের আক্রমণ শুরু হয়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আকস্মিক হামলায়। ছাত্র ঐক্যের নেতা-কর্মীরা লাইব্রেরি চত্বর থেকে প্রতিরোধ শুরু করেন। ডাকসু ও মধু থেকে কর্মীরা লাইব্রেরি, টিএসসি এলাকায় ছুটে যান। দ্রুত দলগুলোতে সংবাদ পাঠানো হয়। আমরা আলোচনা বন্ধ করে লাইব্রেরির সামনে চলে আসি। ছাত্রদলের কর্মীরা সংবাদ নিয়ে আসেন যুবদল সভাপতি মির্জা আব্বাসকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। থেমে থেমে আন্দোলন চলছিল। সোয়া ১১টা নাগাদ বিএমএর যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম খান মিলন ও ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন রিকশায় পিজিতে যাওয়ার পথে লাইব্রেরির পূর্ব কোনায় সন্ত্রাসীদের আক্রমণে পড়ে যান। গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কর্মীরা ডা. মিলনকে রিকশায় করে মেডিকেলে নিয়ে যান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মিলনের মৃত্যুর সংবাদ ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পরপরই ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ছাত্র -শিক্ষক-কর্মচারীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

ডা. মিলন খুবই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের (জাসদ) রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল শাখার সভাপতি ছিলেন। তারই প্রমাণস্বরূপ মেডিকেলের শত শত কর্মচারী লাঠি নিয়ে কার্জন হলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করতে। শুরু হয় সম্মিলিত প্রতিরোধ। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কর্মীরা সন্ত্রাসীদের হঠাতে হঠাতে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত নিয়ে যান। দোয়েল চত্বরের সামনে পুলিশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাস্তায় শুয়ে পড়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে থাকে। লাগাতার প্রতিরোধের মুখে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের একটি মিছিল বাবুল, মিলন, সাইফুদ্দিন মণি, জাসদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ পেরিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে পৌঁছায়। সন্ত্রাসীদের বন্দুকের গুলিতে ছাত্রদল নেতা ফজলুল হক মিলন আহত হন। এদিকে লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজু গুলিবিদ্ধ হন। ডা. মিলনের মৃত্যুর সংবাদ মহানগরীতে ছড়িয়ে পড়লে সর্বস্তরের মানুষ অফিস, আদালত ছেড়ে রাজপথে নেমে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও মিছিল নিয়ে ওই মিছিলে মিলিত হন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ওই মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি প্রেস ক্লাবের সামনে এসে সমবেত হয়। আইনজীবীরা আদালত ছেড়ে রাজপথে চলে আসেন। আট দল, সাত দল ও পাঁচ দলীয় জোটের নেতারাও সমাবেশে যোগ দেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারাও প্রেস ক্লাবে মিলিত হন। ঘণ্টা দুয়েক সমাবেশ চলে। বিএমএর পক্ষ থেকে ডা. মাজেদ চিকিৎসকদের গণপদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। সমাবেশে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন, ড. কামাল হোসেন, ফয়েজ আহমদ, আট, সাত ও পাঁচ দলীয় জোট এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারা বক্তৃতা দেন। সচিবালয় থেকে কতিপয় গণবিরোধী আমলা ছাড়া সব কর্মকর্তা প্রেস ক্লাবের সামনে সমবেত হন। সমাবেশ শেষ করে সর্বস্তরের জনতা মেডিকেলে চলে আসে। বস্তুত ডা. মিলনের শহীদি আত্মদানের মধ্য দিয়েই আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা।

সর্বশেষ খবর