মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতে সংখ্যালঘু তাড়ানোর জিকির

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতে সংখ্যালঘু তাড়ানোর জিকির

ফের এনআরসির জিগির তুললেন অমিত শাহ। সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রক্রিয়া সারা দেশে শুরু হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকবে অসমও। স্ববিরোধিতা প্রকট করে তিনি বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের সঙ্গে এনআরসির কোনো সম্পর্ক নেই। রাজ্যসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে দাবি করেছেন, এনআরসিতে ধর্মের ভিত্তিতে নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। অমিত শাহের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিপিআই (এম) পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত। তিনি স্পষ্ট করেছেন সর্বশক্তি দিয়ে জাতীয় স্তরে এনআরসি চালুর বিরুদ্ধে লড়বে সিপিআই (এম)। তিনি বলেছেন, এনআরসি সংকীর্ণ, বিভাজনকামী এবং ন্যায়ের ধারণার বিকৃতি। এই প্রক্রিয়ার আসল উদ্দেশ্য ভারতীয় নাগরিকদের একটি বেছে নেওয়া অংশকে তাদের ন্যায় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

অসমের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কারাত বলেছেন, গুরুতর অন্যায় এবং অবিচারের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে চোখের সামনে। অসমের বাইরে গোটা দেশে এনআরসি চালু অর্থহীন। দেশে বিভাজন ছড়ানোর কৌশলের নাম এনআরসি। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি তাস খেলছে বিজেপি। বামপন্থিরা স্পষ্ট বলেছে, এই রাজ্যে এনআরসি চালু করতে দেওয়া হবে না। আরএসএস এবং কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি জীবন-জীবিকার সংকট থেকে চোখ ঘোরাতে বিভাজনের এই কায়দা ধরেছে। সম্প্রতি গুয়াহাটিতে রাজ্যের বিজেপি সরকারের মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এনআরসি বাতিলের দাবি তোলেন। অমিত শাহ রাজ্যসভায় সেই দাবিতে সম্মতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জাতীয় স্তরে এনআরসি তৈরির প্রক্রিয়ায় থাকবে অসমও। সেক্ষেত্রে বাতিল হবে রাজ্যের চালু এনআরসি। বিরোধীরা জাতীয় স্তরে এনআরসি নিয়ে প্রশ্ন তুলে রেখেছেন। ১৯৫১-তে এনআরসি হয়েছিল কেবল অসমেই। চলতি পর্বে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে কেবল অসমের জন্যই তা সংশোধিত হয়েছে। তাতে বাদ পড়েছে ১৯ লাখ লোকের নাম। উল্লেখ্য, কলকাতায় দলের সভায় অমিত শাহ বলে গিয়েছিলেন আগে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হবে। তার পর পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি। কোনো হিন্দু নাগরিকত্ব হারাবেন না। পরে আবার তিনিই সংসদে বলেছেন, এনআরসি এবং নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী বিল আলাদা বিষয়। একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক নেই। সেই সঙ্গে তার সংযোজন এনআরসিতে ধর্মের ভিত্তিতে বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। বিরোধীদের বক্তব্য, সম্পর্ক না থাকলে বিজেপি কেন বলে চলেছে আগে নাগরিকত্ব আইন, তারপরে এনআরসি? শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্নে অন্য একাধিক ধর্মাবলম্বীর কথা উল্লেখ করলেও মুসলিমদের কথা বলেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অসমে এনআরসি নিয়ে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করেছিল বিজেপি। প্রকাশ্য সমাবেশে মুসলিমদের ঘরছাড়া করার হুমকিও দিয়েছিল। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিলেও স্পষ্ট ধর্মীয় বিভাজনের কৌশল। ২০১৬-এর ১৯ জুলাই বিলটি লোকসভায় পেশ করেছিল বিজেপি। ২০১৯-এর ৭ জানুয়ারি লোকসভায় তা পাস হলেও রাজ্যসভায় পেশ হয়নি। সে কারণেই নতুন করে বিল পেশ করতে হবে কেন্দ্রকে। ওই বিলে বলা হয়েছিল, প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে এসে ভারতে বসবাসরত বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ এবং পার্সিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ইন্ডিয়া নমঃশূদ্র বিকাশ পরিষদ এনআরসির বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। তাদের দাবি অসমে এনআরসি থেকে বহু বাঙালি হিন্দুর নাম বাদ পড়েছে তাঁদের তালিকাভুক্ত করতে হবে। আলিপুরদুয়ার জেলা কমিটির তরফে অসমবাংলা সীমানার বারবিশায় বিশাল একটি মিছিল করা হয়। জোড়াই নদীর দশমীঘাট এলাকা থেকে মিছিল করে অসমের দিকে যান সংগঠনের সদস্যরা। ওই মিছিলে শেরপা অ্যাগোসিয়েশনের সদস্যরাও যোগ দেয়। অল ইন্ডিয়া নমঃশূদ্র বিকাশ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি মুকুলচন্দ্র বৈরাগ্য বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে বলা হয়েছে ওপার বাংলা থেকে যারা এসেছে তারা শরণার্থী। আমরা শরণার্থী নই। আমাদের ভোটার কার্ড রেশন কার্ড আধার কার্ড আছে। যাদের এদেশে জন্ম তারা শরণার্থী হতে পারে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল একটি বিভ্রান্তিকর বিল। এই আইন আমরা মানি না। এই বিল পাস হলে দেশে তথা রাজ্যে আগুন জ্বলবে বলে জানান তারা। লোকসভা নির্বাচনে প্রচারে এসে বারবার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ শানিয়েছেন মোদি থেকে অমিত শাহ সবাইকে। এ বিষয়ে সংসদে তৃণমূলের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এবার কড়া ভাষায় বিজেপিকে জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসনিক সভা থেকে মমতার জবাব, এই বাংলায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলও তিনি করতে দেবেন না। তার কথায়, এনআরসির ভয়াবহতা আর ভিটেমাটি উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনা অসমে স্পষ্ট হয়েছে হিন্দুদের কাছেও। সন্ত্রস্ত হিন্দুদের ক্ষোভ বাড়ছে। সেই ক্ষোভকে বিপথে চালিত করতে এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে পাস করানোর মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্র। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এই রাজ্যে এই বিল কার্যকর করতে দেওয়া হবে না বলে মোদি-অমিত শাহদের জবাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অসমে এনআরসি হওয়ার পর থেকে বারবার সরব হতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। এমনকি অসমে তৃণমূলের একটি টিমকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তৃণমূল নেত্রী। বাংলাতে কোনোভাবেই এনআরসি চালু হবে না বলে বারবার সাধারণ মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন। এবার নাগরিকত্ব সংশোধনী নিয়ে নিজের মনোভাব সাফ করে দিলেন মমতা। প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এনআরসি হবে না, নাগরিকত্ব সংশোধনীও হবে না। কেন ভয় পাচ্ছেন? হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, রাজবংশী, কামতাপুরিসহ বাংলায় যারা থাকেন, তারা সবাই নাগরিক। কোনো ভেদাভেদ এখানে চলবে না। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই বাংলার সম্পদ। নাম না করে গেরুয়া শিবিরকে মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষ, নাগরিকত্ব সংশোধনীর নামে কেউ কেউ কোথাও কোথাও গিয়ে সংখ্যালঘুদের ভয় দেখাচ্ছে, কোথাও ভয় দেখাচ্ছে রাজবংশীদের, কোথাও তফসিলি জাতির লোকজনকে, কোথাও আবার হিন্দু উদ্বাস্তুদের। তার কথায়, যদি হিন্দু উদ্বাস্তুদের ওপর এতই দরদ, তবে কেন অসমে নাগরিক তালিকা থেকে ১৩ লাখ নাম বাদ দেওয়া হলো? কেন বাদ গেল এক লাখ হিন্দিভাষীর নাম আর কেনই বা এনআরসিতে ঠাঁই হলো না এক লাখ গোর্খা ভাইবোনের। মুখ্যমন্ত্রী জানান, আসলে এসবই ফাঁদ। প্রথমে ছ’বছরের জন্য নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারপর দয়া হলে মিলবে নাগরিকত্ব। বাংলাতে কিছুতেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল কার্যকর করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।    

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

 

 

সর্বশেষ খবর