শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ওয়াজ আজ প্রেমহীন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ওয়াজ আজ প্রেমহীন

‘উদউ ইলা সাবিলি রাব্বিকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাওয়িজাতিল হাসানা।’ ডাকো আল্লাহর পথে হিকমতি ওয়াজ করে।’ আরবি ওয়াজ শব্দের অর্থ হলো, উপদেশপূর্ণ বাণী, মন গলানো, হৃদয় নিংড়ানো কথা। যুগে যুগে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য হিকমতি ওয়াজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসলামের ইতিহাসে নবী-সাহাবি থেকে শুরু করে প্রত্যেক বুজুর্গ ব্যক্তিই কমবেশি ওয়াজ করেছেন। ওয়াজ করেননি এমন বুজুর্গ নেই বললেই চলে। মূলত ওয়াজের মাধ্যমেই দাওয়াতের কাজ গতি পেয়েছে। ইসলামের এই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি ভারতীয় উপমহাদেশে ঐতিহ্য লাভ করেছে। উপমহাদেশের যেখানেই মুসলমান আছে, সেখানেই ওয়াজের সুর ফুটেছে। আর বাংলাদেশের কথা বলতে গেলে তো এভাবেই বলতে হয় যে, শাহজালাল-শাহপরান-খানজাহান আলীদের মতো সুফিদের ওয়াজের কারণেই  বাংলা ভূমি মুসলমানের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। আগে শীতের মৌসুম মানেই ওয়াজের মৌসুম হিসেবে জানত মানুষ। সম্প্রতি এ ধারা পরিবর্তন হয়েছে। এখন বছরজুড়েই বাংলার আনাচে-কানাচে ওয়াজের মাহফিল বসে। শীত এলে মাহফিলের প্রতিযোগিতা লেগে যায়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, এক শ বছর এমনকি পঞ্চাশ বছর আগেও একটি গ্রামে কখনো কখনো একটি জেলায় বছরে একবার মাত্র মাহফিল হতো। সে মাহফিল ঘিরে কত উৎসাহ-উন্মাদনা বিরাজ করত সাধারণ মানুষের মনে। কত মানুষ মনে মনে নিয়ত করত, এ বছরের মাহফিলে পীর সাহেবের হাতে তওবা করে ভালো হয়ে যাব, বার্ষিক মাহফিলের আখেরি মোনাজাতে আল্লাহর কাছে কেঁদে-কেটে মাফ চেয়ে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ধরব, হালাল খাব, মিথ্যা ছেড়ে দেব ইত্যাদি। আফসোস! আজ বাড়ি বাড়ি, মহল্লায় মহল্লায় প্রতি রাতে মাহফিল হচ্ছে, কিন্তু কেন যেন মানুষর ভিতর জগতে পরিবর্তন এসেছে না। মাহফিল শুনতে শুনতে জীবন-যৌবন শেষ হয়ে যাওয়া মানুষটিও মরণ ভুলে, আল্লাহ-রসুল ভুলে পাপের সাগরে ডুবে থাকছে। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের মরহুম মাওলানা আবদুল হক আব্বাসী বর্তমান ওয়াজের অবস্থা দেখে খুব আফসোস করে বলেছিলেন, ‘আজকের জমানায় ওয়াজ শোনা হয়ে গেছে আপনাদের নেশা, আর ওয়াজ করা হয়ে গেছে আমাদের পেশা। নেশা আর পেশা এক জায়গায় হওয়ার কারণে ফল শূন্য। ওয়াজ হচ্ছে কিন্তু মানুষের আত্মায় পরিবর্তনের ভাব জাগছে না।’ ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘শ্রোতাদের মনের পরিবর্তন না হলে বুঝতে হবে ওয়াজের আমল ও ওয়াজের পদ্ধতিতে সমস্যা আছে। অনেক সময় খালি চোখে সে সমস্যা না-ও দেখা যেতে পারে। গভীর বিশ্লেষণে সমস্যা বেরিয়ে আসবে।’ ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘ওয়ায়েজদের প্রতি আমার সর্বপ্রথম নসিহত হলো- দুনিয়ার সব ধরনের লাভ ও লোভের মোহ থেকে ওপরে উঠে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মানুষকে ওয়াজ করবেন। কাজে-কর্মে কথাবার্তায় হিংসা-রিয়া কোনোভাবেই যেন স্থান না পায়।’ দার্শনিক গাজ্জালি (রহ.) বলেন, ‘বক্তাদের অবস্থা খুবই নাজুক। বাইরের দিক থেকে তাদের অনেক কাজ ভালো এবং কল্যাণকর মনে হলেও নিয়তে সমস্যা থাকায় তাদের কাজ আল্লাহর কাছে খারাপভাবে লেখা হচ্ছে। বক্তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এক বক্তা অন্য বক্তার ভালো দেখতে পারে না। নিজেকে সবার ওপরে সবার বড় রাখার জন্য অন্যের গিবত, দোষচর্চা এবং অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার মতো জঘন্য গুনাহর পথটি বেছে নেয়। এসব ক্ষেত্রে তারা সত্য-মিথ্যা ও ভদ্রতার সীমা পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।’ হাজার বছর আগে ইমাম গাজ্জালি (রহ.) ওয়ায়েজদের ব্যাপারে যা বলেছেন আজ সেগুলোই আরও নোংরা আরও বীভৎস হয়ে দেখা যাচ্ছে এই সময়ের ওয়ায়েজদের মধ্যে। এখনকার ওয়াজ শুনলে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, মানুষকে হেদায়াতের নিয়ত আদৌ ওয়ায়েজদের মনে আছে কিনা। গালাগালি, ধমকাধমকি, মিথ্যা ঠাটবাট এবং অন্যকে অপমান করা, ছোট বানানোর নানান কথাবার্তা দিয়ে সাজানো থাকে এই সময়ের ওয়াজগুলো। সাধারণ মানুষের মনে এসব গভীর প্রভাব ফেলে। মানুষ মনে করে, এসবই বুঝি ওয়াজ। তখন মানুষও এ ঘৃণ্যতায় ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের মধ্যে তারা আলোচনা করে অমুক এই, তমুক সেই ইত্যাদি। কিন্তু ভালো হওয়ার, ধার্মিক হওয়ার যে সবক নেওয়ার কথা তা হচ্ছে না।

                লেখক : মুফাসসিরে কোরআন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর