শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শাকিলকে স্মরণ

আনিসুজ্জামান

শাকিলকে স্মরণ

মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় অনেকের চেয়ে পরে এবং যে পরিচয় সময়ের দিক দিয়েও দীর্ঘ ছিল না। তবু তার সঙ্গে এমন একটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, যা অনেক দিনের চেনাজানার পরেই কেবল ঘটা সম্ভব। তার স্বাভাবিক প্রাণপ্রাচুর্যের ফলেই এমনটা হতে পেরেছিল। একই কারণে আমার স্ত্রী ও সে অল্প সময়েই পরস্পরকে আপন করে নিতে পেরেছিল। শাকিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কাজ করত। সমাজের অনেক প্রভাবশালী বা বিত্তশালী মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ গভীর হতে পারত। কিন্তু সময় কাটানোর জন্য সে যাদের বেছে নিয়েছিল, তারা সাহিত্যিক বা শিক্ষক, প্রকাশক বা শিল্পী। এদের কাছে তার পাওয়ার কিছু ছিল না এবং এরাও শাকিলের পদমর্যাদাহেতু কিছু পাওয়ার প্রত্যাশী ছিল না। শাকিলের প্রাণশক্তি এবং সরল-সহজ আচরণ মানুষকে কাছে টানার ব্যাপারে চৌম্বকশক্তির কাজ করত। তাদের জন্যে তার ভালোবাসাও ছিল আন্তরিক যা মুখ ফুটে বলে বোঝানোর আবশ্যকতা ছিল না। দেখা গেছে, অনেক সময়ে যে অনুষ্ঠান কেবল আত্মীয়দের নিয়ে করার কথা, শাকিল সেখানে তার স্বজনদের ভিড় করতে ডেকেছে। শাকিল ছিল রাজনৈতিক মানুষ, কিন্তু রাজনীতি তাকে সর্বক্ষণ ঘিরে রাখতে পারেনি। রাজনৈতিক সহমর্মিতার চেয়েও সে বেশি সন্ধান করেছে মানবসত্তাকে। সে নিজে যেসব কর্মে ও কথায় এই মানবসত্যের পরিচয় দিয়েছে, অন্যের মধ্যেও সে এই মানবিক গুণের প্রকাশ দেখতে চেয়েছে। অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি বা খলন-পতন সে খুবই কম অন্বেষণ করেছে এবং যে বিষয়ে কথা বলেছে আরও কম। লেখক হিসেবেও শাকিলের আত্মাভিমান ছিল না, নিজের লেখা সম্পর্কে বলতেও তার কুণ্ঠা ছিল। কবিতায় সে চেষ্টা করেছে প্রথা ও আধুনিকতার মিল ঘটাতে। গল্প রচনায় তার প্রধান শক্তি নির্মোহ বাস্তব পর্যবেক্ষণতা এবং কথনের সংযম। তবে অন্তর্গত শক্তির তুলনায় তার পরিচর্যা সে করেছে কম। হয়তো সেই কারণেই সাহিত্য ক্ষেত্রে যতটা মনোযোগ সে আকর্ষণ করতে পারত, বাস্তবে ততটা পায়নি।

একটি সর্বনাশা প্রবৃত্তি তাকে অমোঘ নিয়তির দিকে তাড়না করে ফিরেছে। তার মতো বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে তার পরিণাম বোঝার কোনো কারণ ছিল না। হয়তো কোনো অভিমান তাকে বাধা দিতে দেয়নি। অথচ সে যখন নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ কল্পনা করত, সে সম্পর্কে স্বগতোক্তির মতো বলে যেত, তখন মনে হতো, তার জীবনপিপাসা কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই দুর্জেয় কিছু থাকে তার ঘনিষ্ঠতম জনেরও উপলব্ধির বাইরে। সেখানে মানুষ একা, নিঃসঙ্গ, অপ্রকাশ্য। যাওয়ার সময়ে বুঝি জীবনের সব ঋণ পরিশোধ করে সে চলে যায়। যারা রয়ে যায়, তারা শোক করে। যে চলে যায়, তার বুঝি কোনো খেদ থাকে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর