মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

একেই বলে জ্ঞানী

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

একেই বলে জ্ঞানী

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তা সত্যিই বেশ উদ্বেগের। দুই দেশের এত ভালো সম্পর্কের পরও যদি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এমন বলেন তাহলে আমরা কোথায় যাব? বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি যখন যা খুশি তাই বলছেন। মন্ত্রিত্ব ত্যাগে তার নাকি এক সেকেন্ডও লাগবে না। ভদ্রলোক বলেন কী? এটা ভারতের রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী হলে শোভা পেত। টিপু মুনশির মুখে শোভা পায় না। আর ব্যাংক ঋণের সুদ নিয়ে তিনি সেদিন যে কথা বলেছেন, এরপর মন্ত্রিসভায় থাকার নৈতিক অধিকার তার কোথায়? আমাদের নেতা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিদেশের মাটিতে নিজের বাজেটের নিজেই সমালোচনা করলে, ভুলত্রুটি ধরলে মন্ত্রিত্ব থাকে? থাকে না।’ মন্ত্রিসভায় থেকে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করা নৈতিকতাবিরোধী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাই বলে জনাব মুনশি তো আর প্রধানমন্ত্রী নন! আমার ধারণা, জনাব মুনশির পদত্যাগ করতে হবে না, পদই তাকে ত্যাগ করবে।

গতকাল সোমবার ছিল আমার একমাত্র ছেলে দীপের জন্মদিন। আগামীকাল ১১ ডিসেম্বর বুধবার টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত দিবস। দুটোই আমার কাছে মহা আনন্দের। আমার একমাত্র ছেলে দীপ যখন জন্মায় তখন আমি বর্ধমানে নির্বাসিত জীবনের ঘানি টানছিলাম। মানুষের জীবন সে এক বিচিত্র, পাখির মতো- এই এখানে, এই ওখানে কোনো স্থিরতা নেই। বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২৫ জুন। আমার সঠিক জন্ম তারিখ লিখে না রাখায় স্বাধীনতার পর পাসপোর্ট করতে গিয়ে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের কাছে নানাভাবে খোঁজ নিয়ে ঠিক করেছিলাম। বছরের কোনো হেরফের নেই। মাস এবং দিনের একটা হেরফের থাকতে পারে। ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন আমার জন্মদিন। একেবারে নিশ্চিত জন্মদিন দেশবাসীকে জানাতে না পারলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সঠিক মৃত্যুদিন সারা দুনিয়া অবশ্যই জানবে। তবে আমার ছেলেমেয়ের জন্মদিনের কোনো হেরফের নেই। ১৯৮৫ সালের ৯ ডিসেম্বর দীপের জন্ম হয়েছিল ধানমন্ডির মেহেরুন্নেসা ক্লিনিকে। তখন এরশাদ ক্ষমতায়। তবু কেন যেন কীভাবে দীপের জন্মদিনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ লোক পাঠিয়ে গুলদস্তাসহ শুভ কামনা জানিয়েছিলেন। নিজের আপন ভাইয়ের সন্তান জন্মে যে কেউ যেমন উৎসাহী ও উদ্বিগ্ন থাকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তেমন ছিলেন। তবে জন্মের পর রাতদিন কখনো একটুও ঘুমায়নি। শুধু কান্না আর কান্না। কোনো শিশু এত কাঁদতে পারে অনেকের তেমন ধারণাই ছিল না। আমি অনেক পীর-মুরশিদের কাছে যাই। তাদের ভালো কথা ভালো লাগে, খারাপ বললে বুকে বাঁধে। কিন্তু আমি কোনো পীরের মুরিদ না। হুজুর মওলানা ভাসানীর ভক্ত-অনুরক্ত, পীর শাহসুফি সামান ফকির আমার এক মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার দুই মাস আগে আমার সঙ্গে গণভবনে গিয়ে অন্তত দশবার বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু কই, আমি তো তারে দেখি না।’ বঙ্গবন্ধু চেয়ার থেকে উঠে তাকে জাপটে ধরে বলেছিলেন, ‘এই আমি, আপনাকে ধরে আছি।’ শাহসুফি সামান ফকির তবু বলেছিলেন, ‘আমি আপনেরে না দেখলে কী করে বলব? আমি তো আপনারে দেখি না।’ সেই সামান ফকিরেরও আমি মুরিদ না। আমি তার ভক্ত, তিনি আমার ভক্ত। তিনি আমায় বঙ্গপীর বলে ডাকতেন। কোরআন-হাদিস সম্পর্কে শাহসুফি সামান ফকিরের মতো জ্ঞানী আমি দেখিনি। আমার ছেলের কান্নায় অতিষ্ঠ হয়ে ছোটবোন শাহানা নারিন্দার পীরের কাছে গিয়েছিল। দীপকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এর বাবা কে?’ আমার কথা বলায় মিষ্টি হেসে ছেলের পিঠে দু-তিনবার হাত বুলিয়ে দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এর জন্য কিছু করতে হবে না। বাবার কাছে নিয়ে যান। তার কোলে গেলে দেখবেন শান্ত হয়ে গেছে।’ নারিন্দার পীরের কথার একটুও ব্যতিক্রম হয়নি। আমার মা যখন দীপ এবং দীপের মাকে নিয়ে কলকাতা দমদমের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন আমি রানওয়েতে গিয়েছিলাম আমার সন্তান, মা ও স্ত্রীকে নামিয়ে আনতে। মায়ের কোল থেকে যেই আমি বুকে নিয়েছিলাম আর দীপ কাঁদেনি। ব্যথা পেয়ে ছোটখাটো কান্নাকাটি করলেও দীপের জীবনে খুব কান্নাকাটি নেই। দীপকে আমার বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব আদরযত্ন করতেন। বহুদিন ওকে গোসল করিয়ে খাবার খাইয়ে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন। সেই দীপের ছিল গতকাল জন্মদিন। ও জন্মদিন পালন করতে চায় না। তবু বাড়ি থাকা কর্তব্য বলে মনে করেছি তাই দীপের জন্মদিনে কুশিকে নিয়ে বেশ আনন্দেই ছিলাম। আপনারা দয়া করে আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন ওকে তাঁর ছায়াতলে হেফাজতে রাখেন।

দীপের কান্নার কথা বলতে গিয়ে নারিন্দার পীরের আরেক বুদ্ধিমত্তার কথা মনে পড়ল। সে ছিল স্বাধীনতার পরপর একেবারে গরম সময়ের কথা। শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা দেশত্যাগ করেননি বলতে গেলে তারা সবাই যেন স্বাধীনতাবিরোধী, দালাল। অসুবিধায় পড়েছিলেন মরমি শিল্পী পল্লীগীতির প্রবাদপুরুষ ভোলাভালা সাধারণ মানুষ আবদুল আলীম। স্বাধীনতার পর বেতার -টেলিভিশনে দালাল শিল্পী হিসেবে তার নাম এঁটে দেওয়া হয়। গান ছাড়া আবদুল আলীম কিছু জানতেন না। আজগর, জহির তখন খুবই ছোট। আবদুল আলীমের ঘরে তোন্দল-নাস্তি। তিনি গিয়েছিলেন নারিন্দার পীরের কাছে। আবদুল আলীমের বিপদের কথা শুনে পীর সাহেব বলেছিলেন, ‘এখন আমি পীর না। যে রকম নামধাম শুনি, এখন পীর কাদের সিদ্দিকী। পারলে তার কাছে যা।’ আশরাফ গিরানী ছিল আমার এক বিস্ময়কর মুক্তিযোদ্ধা। হাই কোর্টের নুরা পাগলা থেকে শুরু করে আমাদের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কারও সঙ্গে সম্পর্কের অভাব ছিল না। আশরাফ গিরানীর রাজনৈতিক গুরু কাজী জাফর আহমদ, আধ্যাত্মিক গুরু হুজুর মওলানা ভাসানী, রণগুরু কাদের সিদ্দিকী। সে এই অসাধারণ সম্পর্ক মৃত্যু পর্যন্ত বজায় রেখেছিল। সেই আশরাফ গিরানী আবদুল আলীমকে নিয়ে আমার বাবর রোডের বাড়িতে হাজির। ওর আগে দু-একবার মঞ্চে তার গান শুনেছি। কথা হয়নি। আমার বাড়িতে এসে সে কি কান্না! ‘ভাত দে হারামজাদা’ লিখে কবি রফিক আজাদের নামে হুলিয়া হওয়ায় তিনিও ও রকম বাবর রোডের ড্রয়িংরুমে আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন, ‘আমি কবি মানুষ, জেল আমার ভালো লাগবে না। আমার নামে ওয়ারেন্ট। আমি জেলে গেলে বাঁচব না।’ বলেছিলাম, ‘এভাবে নেতাকে পিতাকে হারামজাদা বললেন?’ রফিক আজাদ গলগল না করে কথা বলতে পারতেন না। খুব আস্তে বললেও ৫০ হাত দূর থেকে শোনা যেত। আমার ছোট্ট বাসা। রফিক আজাদের গলগল মা হয়তো রান্নাঘর থেকে শুনেছিলেন। ড্রয়িংরুমে এসে মা খুব বিরক্ত হয়ে রফিক আজাদকে বলেছিলেন, ‘কদিন আগে তোমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করেছ। আর তুমি এভাবে এখানে এসে কাঁদছ কেন? বঙ্গবন্ধুকে হারামজাদা বললে কাজটা কি ঠিক হয়েছে? হাত-মুখ ধুয়ে আগে কিছু পেটে দাও। তারপর বজ্রর কাছে যখন এসেছ তার যা করার তা সে অবশ্যই করবে। না হলে আমিই কি তাকে পছন্দ করব?’ খাবার খেয়ে জুতজাত হয়ে কামানের গোলা ছুড়ছিল। তার প্রতিটি কথা মনে হচ্ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর সিক্স পাউন্ডারের গুলি। মা এসে পাশে বসেছিলেন। ছুটে গিয়ে মায়ের পা ধরে পটু অভিনেতার মতো বলেছিলেন, ‘আপনিই বলুন ক্ষুধা লাগলে গ্রামের বাচ্চারা কি বলে? অনেক বাচ্চা বলে না, মা খাবার দিলি না? পেটে আগুন ধরছে। পুইড়া গেল যে! ভাত দে নইলে তোর কইলজা খামু, বলে না?’ এ রকম কত কী যে বোঝালেন আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিকালেই গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। মিরপুর সড়কের গণভবনে রফিক আজাদ বঙ্গবন্ধুর দুই পা জড়িয়ে ধরলে তিনি বলে ওঠেন, ‘এই হারামজাদা, তুই কী লিখছিস?’

-ক্যান? এই যে আপনি আমারে হারামজাদা বললেন আমি এই কথাই তো লিখেছি। আপনি কি আমারে গালি দিলেন? নাকি আদর করে বললেন? আমি তো ওই কথাই বলছি। পেটে আগুন জ্বললে সবাই যা বলে আমি তাই বলেছি। এখন আমি জেলে থাকলে কবিতা লিখব কী করে?

বঙ্গবন্ধু খুব আলোড়িত হয়েছিলেন, মুগ্ধ হয়েছিলেন রফিক আজাদের কথায়। তিনি মনসুর ভাইকে ডেকে সেই মুহূর্তে মামলা তুলে নিয়ে রফিক আজাদের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘তুই আরও লিখবি, এমনি করেই লিখবি। কাদেরের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আসবি। তুই তো আমার মুক্তিযুদ্ধের কবি। দেশের কবি।’

এ রকমই ঘটনা পল্লীগীতি সম্রাট মরমি শিল্পী আবদুল আলীমকে নিয়ে। রফিক আজাদের ’৭৪-এ আর আবদুল আলীমের ঘটনা ’৭২-এ। আবদুল আলীম এসেছেন এ কথা শুনে মা বৈঠকখানায় এসেছিলেন। কারণ মা আবদুল আলীমের গান খুব পছন্দ করতেন। তার কান্নাকাটি থামানো যাচ্ছিল না। পরে অনেক বলে-কয়ে তার কান্নাকাটি থামিয়ে খালি গলায় মা তার অনেক গান শুনেছিলেন। এর তিন-চার দিন পর বঙ্গবন্ধুর কাছে বলেছিলাম পল্লীগীতি গায়ক আবদুল আলীম ব্ল্যাক লিস্টেড। তার আশঙ্কা যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন। এসব কথা বঙ্গবন্ধুকে বলতেই বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী বলিস?’

-মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বেতারে কতজন কত নাচানাচি করেছে, কত নতুন নতুন কবিতা, গান, প্রবন্ধ রচনা করেছেÑ তাদের বেলায় কিছু না? আবদুল আলীমের বেলায় সবকিছু?

বঙ্গবন্ধুকে বলতেই তিনি অনেকটা বিস্মিত হলেন। পরদিন তাকে নিয়ে যেতে বললেন। তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ডুগি-তবলা-হারমোনিয়ামের ব্যবস্থা করতে বললেন। আমরা গিয়ে দেখি সব তৈরি। আবদুল আলীম ১০-১২টা গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে ‘পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে’ গানটা বোধহয় তিন-চারবার গেয়েছিলেন। মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং বেতার-টেলিভিশনের ডিজিদের বলে দিলেন ‘আবদুল আলীমকে সব শিল্পীর থেকে সপ্তাহে যেন একটি প্রোগ্রাম বেশি দেওয়া হয়। তিনি যেন সবার ওপরে সম্মানী পান।’ আমি খুবই চমৎকৃত হয়েছিলাম নারিন্দার পীরের বাস্তব জ্ঞান, বিবেচনাবোধ দেখে। একেই বলে পীর, একেই বলে জ্ঞানী।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর