বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা : চাই সমন্বিত প্রয়াস

গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি

জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা : চাই সমন্বিত প্রয়াস

পৃথিবী আজ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ে বিপন্নপ্রায়। জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশ বিনষ্টের কারণ হচ্ছে। আবার মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কার্যক্রম জলবায়ু পরিবর্তনে ও সরাসরি পরিবেশ দূষণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সার্বিকভাবে বিষয়টি নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি করছে। বিশ্বের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ববাসী খাবার পানির ভয়াবহ সংকটে পড়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের আরও বিপর্যয় আমাদের সামনে অপেক্ষমাণ, যদি আমরা সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই। জলবায়ু বলতে আমরা জানি ৩০-৪০ বছরের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, উষ্ণতার গড় হিসাব। সাধারণভাবে জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক বিষয়। এ পরিবর্তনের কতগুলো প্রাকৃতিক কারণ আছে যেমন কনটিনেন্টাল ড্রিফট বা মহাদেশীয় সরণ, আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ, সমুদ্র স্রোত ও আর্থস টিল্ট বা পৃথিবীর হেলানো অবস্থান।

তবে মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও জলবায়ু পরিবর্তন হতে পারে। যেমন কলকারখানা, যানবাহন চলাচল ও অনেক কর্মকান্ডে প্রচুর কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হয়। এ গ্যাসের অতিরিক্ত অংশ যখন প্রাকৃতিক উপায়ে রূপান্তরিত হয় না তখন তা ভূপৃষ্ঠের ওপর আবহাওয়া মন্ডলে একটি আবরণ সৃষ্টি করে। এ আবরণটি গ্রিনহাউসের মতো ভূপৃষ্ঠের তাপ ধরে রাখে ও বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টিকে গ্রিনহাউস ইফেক্ট ও কার্বন ডাইঅক্সাইডকে গ্রিনহাউস গ্যাস নামে আখ্যায়িত করেন। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সে কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউস ইফেক্টের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। বর্তমানে মনুষ্যসৃষ্ট উক্ত কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ও ব্যাপকতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। প্রতিদিন অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা এখনো তুলনামূলক কম। তা ছাড়া অন্য কোনোভাবেও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক তেমন বড় ধরনের কোনো কাজ বাংলাদেশে হচ্ছে না। তার পরও পারিপার্শি¦ক অবস্থার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। এর প্রধান কারণ আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান। প্রায় প্রতি বছর আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছি। অল্প কিছুদিন আগে গেল নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের চিহ্ন আমাদের দেশের বুকে এখনো রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সামনের বছরগুলোয় বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা আছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হবে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-

দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং তাপমাত্রার বৈচিত্র্য দেখা দেবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালনাগাদ বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হবে।

পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে এবং জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক কর্মকা- বাড়ার কারণে পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। ফলে পানির অভাব হবে।

মাটির গুণগত অবনতি ঘটবে। অসময়ে বৃষ্টিপাত, ঘন কুয়াশার কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যশস্যের অভাব হবে।

উপকূলীয় এলাকায় বাস্তুসংস্থান ও ভারসাম্য নষ্ট হবে।

ঘূর্ণিঝড়ে জমি লবণাক্ত হবে, ফসল নষ্ট হবে, ভাঙন ও ভূমিধসে জমির পরিমাণ কমবে।

উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের এবং বিভিন্ন পর্বত শ্রেণির শৃঙ্গের জমাট বরফ দ্রুত গলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে, ভূমিধস বাড়বে। দীর্ঘমেয়াদে নদ-নদীর পানির প্রবাহ কমে যাবে।

আর্দ্রতা পরিবর্তনের কারণে কীটপতঙ্গ, রোগব্যাধি ও অণুজীবের বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও অতিবৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতা বাড়বে; এর ফলে মশামাছির প্রকোপ ও রোগবালাই বাড়বে।

মানুষ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, বন্য পশুপাখি, কীটপতঙ্গের প্রাণহানি ঘটবে।

জলবায়ু উদ্বাস্তু বাড়বে।

দরিদ্রতা বাড়বে।

এখানে উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম অগ্রগণ্য। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫৭টি নদীপ্রবাহ ছাড়াও দেশটির দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবাহে তলিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। ক্ষুদ্র আয়তনের বাংলাদেশে এমনিতেই বিপুল জনসংখ্যার চাপ রয়েছে। জলবায়ুর শরণার্থীর সমস্যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক তথ্যমতে বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরের মধ্যে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। গবেষকদের ধারণা, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে বাংলাদেশ। ২০৫০ সালনাগাদ বিশ্বের ৪৫ জনের মধ্যে একজন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ফলে সেখানে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তু হবে। উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, একই সালনাগাদ বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হবে; যা আগেই বলা হয়েছে এবং বিশ্বের ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, আগামীত বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট থেকে বাংলাদেশের বাঁচার একমাত্র পথ ‘অভিবাসন’। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৬০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটারেরও কম উচ্চতাসম্পন্ন এবং তা কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রের উচ্চতাজনিত হুমকির মুখে রয়েছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এক হতে শুরু করেছে । বাংলাদেশে এখনো জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। তবে আমরা যদি এখনই এর প্রভাব উত্তরণে সচেষ্ট না হই তাহলে সামনে অনেক বড় সংকটের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের যা করণীয় হতে পারে তা হলো-

বেশি করে বনায়ন করতে হবে, বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে কৃষিজমি সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষা করে শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে।

অবশ্যই শিল্পকারখানার বর্জ্য পরিশোধন করে তা নির্দিষ্ট স্থানে জমা রাখতে হবে এবং রিসাইক্লিন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্লাস্টিক-জাতীয় বর্জ্য ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে হবে।

সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

শিল্পকারখানা করতে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কৃষিজমি নষ্ট না হয়। অল্প জায়গা ব্যবহার করে শিল্পকারখানা তৈরি করতে হবে। শিল্পকারখানার আশপাশে গাছগাছালি লাগানো বা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।

কৃষিকাজে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার কমিয়ে জৈবসারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

নদ-নদী ড্রেজিং করে নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

টেকসই বাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙন রোধ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও তা খাওয়ার উপযোগেী করতে হবে।

উপকূল এলাকায় ঘর তৈরির সময় জায়গা উঁচু করতে হবে এবং যাতে ক্ষতি না হয় এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে।

দুর্যোগ তহবিল গঠন করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল ২ ডিসেম্বর স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে কপ-২৫ সম্মেলনে (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিসের ২৫তম অধিবেশনে) বাংলাদেশের সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় যে এখন বাস্তবতা তা তিনি বলেছেন। বাংলাদেশ নিজে উল্লেখযোগ্য পরিবেশ দূষণ না করেও তাকে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের অসাবধানতা/অবহেলাপ্রসূত কর্মকান্ডের খেসারত দিতে হচ্ছে, এমনকি অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেতাদের কাছে সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ও ক্ষতিপূরণের দাবিসহ সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছেন।

জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্তহীনতা বিশ্বকে মারাত্মক পরিণতির দিকে ধাবিত করছে। যত দ্রুত সম্ভব সমন্বিত কর্মসূচি প্রণয়ন করে দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এই আমাদের প্রত্যাশা।  

লেখক : চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি।

Email  : [email protected]

সর্বশেষ খবর