শিরোনাম
রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে কলকাতা

ফখরে আলম

মুক্তিযুদ্ধে কলকাতা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পর্বতসমান। ১৯৭১ মানে ইতিহাসের বৃহৎ পা-ুলিপি। এ পা-ুলিপিতে রয়েছে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের সাদা বাড়ি। এ বাড়িটিই স্বাধীন বাংলাদেশের আঁতুড়ঘর। পূর্ব পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী প্রথম কলকাতায় বিদেশের মাটিতে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এটিও একটি ইতিহাস। রণাঙ্গনের ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধজয়ী সেই ট্যাঙ্ক কলকাতার ব্রিগেড মাঠে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা একাত্তরের স্মৃতিময় সেই ট্যাঙ্কটি দেখে বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতা ওল্টাচ্ছেন।

বাংলাদেশের আঁতুড়ঘর

স্বাধীন বাংলাদেশের আঁতুড়ঘর কলকাতার সাদা রঙের দোতলা একটি বাড়ি। ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের এ বাড়িটি ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস যুক্ত হয়ে আছে। কিন্তু ঐতিহাসিক এ ভবনটি বাংলাদেশ সরকারের হাতছাড়া হয়ে গেছে। ভবনের কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই। অন্য একটি সংগঠন এখন এ ভবনে তাদের কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারসহ মুক্তিযোদ্ধারা এ ভবনটি সংরক্ষণের পাশাপাশি এখানে একটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন। এ দাবির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন মন্ত্রীও একমত পোষণ করেছেন। একাত্তরে তৎকালীন থিয়েটার রোডের (বর্তমানে শেকসপিয়র সরণি) দোতলা বাড়িটি ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে বরাদ্দ দেয়। এর পর থেকে এ বাড়িটি বাংলাদেশ সচিবালয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পরিচালিত হয়েছে। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এখানে বসেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের দাফতরিক কাজ করেছেন। এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এ ভবনের নেতৃবৃন্দের দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ কারণেই অনেকেই ভবনটিকে বাংলাদেশের আঁতুড়ঘর বলে অভিহিত করেন। ভারতে কর্তব্যরত বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক জানান, ‘ভবনটি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার বেশ তৎপর। ২০১১ সালের এপ্রিলে কলকাতায় এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বসুকে ওই ভবনটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বুদ্ধদেব বসু পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই দুজন মন্ত্রীই ভবনটি বাংলাদেশ সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর ভবনটি ফিরে পাওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টের বৃহত্তর যশোর জেলার উপপ্রধান রবিউল আলম বলেন, ‘আমি ওই ভবনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গিয়েছি। এটি আমাদের প্রথম সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। অনেক আগেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল যে কোনো উপায়ে ভবনটি সংরক্ষণের পাশাপাশি সেখানে একটি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর গড়ে তোলা। তাতে বাংলাদেশেরই মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। ভারতের নতুন প্রজন্মের সন্তানরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত।’

যুদ্ধজয়ী সেই ট্যাঙ্ক

একাত্তরের রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর অপরাজেয় সেই ঐতিহাসিক ট্যাঙ্কটি কলকাতার গড়ের মাঠের পাশে ব্রিগেড মাঠে সংরক্ষিত রয়েছে। ট্যাঙ্কটি সব সময়ই চকচক করে। গ্রিল দিয়ে ট্যাঙ্কটি ঘিরে রাখা হয়েছে। যুদ্ধজয়ী এ ট্যাঙ্কটি দেখতে অনেকেই আসেন। রেইনট্রির ছায়ায় দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্ক দেখেন। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধজয়ের পর ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড এ ট্যাঙ্কটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে উপহার দিয়েছিল। এর পর থেকে যত্ন করে ট্যাঙ্কটি গড়ের মাঠের পাশে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারত সরকার তাদের সেনাবাহিনীকে রণাঙ্গনে পাঠায়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে ১ হাজার ৫০০ ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মার্চেই বাঙালির সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। ভারত ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। ওই শরণার্থীর পেছনে যুদ্ধের নয় মাসে ভারত সরকারের খরচ হয় ৩৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যায় ২৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর মিত্রবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন ট্যাঙ্কবহর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় চৌগাছার বয়রা সীমান্ত দিয়ে গরিবপুর, জগন্নাথপুরে অবস্থান নেয়। ২১ ও ২২ নভেম্বর এ রণাঙ্গনে ভয়াবহ ট্যাঙ্কযুদ্ধে মিত্রবাহিনী পাক সেনাদের সাতটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেয়। ভূপাতিত করে দুটি জঙ্গিবিমান। পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যশোর সেনানিবাসে অবস্থান নেয়। ৬ ডিসেম্বর যশোর জেলাকে শত্রুমুক্ত করে যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর সকালে যৌথ বাহিনী রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করে। বিকালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে যৌথ বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষে লে. জে. নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’। কিন্তু বিজয়ের ৪৮ বছর পরও মিত্রবাহিনীর আত্মত্যাগের কোনো স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশে নির্মাণ করা হয়নি। কলকাতার সংরক্ষিত সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধজয়ী ট্যাঙ্কের মতো একাত্তরের রণাঙ্গনের কোনো ট্যাঙ্ক, বিমান, কামান দেশে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিদেশের যে মাটিতে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল তা ভারতের কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে। ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী দড়ি টেনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তিনিই প্রথম পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। এর ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়। বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। কয়েকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন জানায়। কিন্তু কলকাতা হাইকমিশনে ঐতিহাসিক ওই ঘটনার কোনো তথ্য ও স্মারক নেই।

কলকাতার মুজিব সরণির ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের কর্মকর্তা হোসেন আলী প্রথম পতাকা তুলেছিলেন এ কথা জানালেও এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য তারা দিতে পারেননি। আনন্দবাজার পত্রিকাসূত্রে জানা যায়, হোসেন আলী হাইকমিশন কর্মীদের নিয়ে নিজে দড়ি টেনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল। একই সঙ্গে তিনি কেন্দ্রীয় হলঘর থেকে পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি সরিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে দেন। হাইকমিশন অফিসের সামনে লেখা পাক হাইকমিশন নাম মুছে লিখেন ‘বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন’। তিনি বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য জানিয়ে তার অফিসকে বাংলাদেশ দূতাবাস করে স্বাধীনতার পক্ষে কূটনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেন। ১৮ এপ্রিল পতাকা উত্তোলনের সময় উপস্থিত ছিলেন উদীচীর সাবেক সভাপতি নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। এ ব্যাপারে হাসান ইমাম বলেন, ‘ওই সময় আমি বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের আহ্বায়ক। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আমাদের মগবাজার ওয়্যারলেস মোড়ের বাড়িতে পাকিস্তানি আর্মিরা হামলা চালায়। তখন আমি ঢাকা থেকে মাগুরা-ঝিনাইদহ হয়ে মেহেরপুরে আসি। এরপর মুজিবনগর হয়ে কলকাতায় যাই। ৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি থেকে কলকাতা আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি। এরপর আমি হোসেন আলীর সঙ্গে কথা বলি। ১৮ এপ্রিল তিনি হাইকমিশন অফিসের লনে পতাকা উত্তোলন করেন। পরে দেশ স্বাধীন হলে ১৬ ডিসেম্বর আমরা সেখানে সমাবেশ করি।’   

                লেখক : কবি ও সাংবাদিক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর