রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ পাকিদের কাছেও আইকন

ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান

বাংলাদেশ পাকিদের কাছেও আইকন

বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানিদের কাছেও আইকন। যে দেশকে বছরের পর বছর ধরে অবজ্ঞা করেছে ওরা, সে দেশের সাফল্যকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে অবাক বিস্ময়ে। পাকিস্তানি শাসনামলের ২৪ বছরে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানি শোষণের মৃগয়াভূমি। জনসংখ্যায় বাঙালি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশ অর্জন করত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ, কিন্তু সে অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশের রাজধানী ছিল পশ্চিমাংশে। সশস্ত্র বাহিনীর হেডকোয়ার্টারও ছিল সেখানে। কেন্দ্রীয় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিংহভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী। পাকিস্তানের প্রথম সরকারের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। উর্দুভাষী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ছিলেন ভারত থেকে আসা মোহাজির। তিনি ঠাঁই পেতেছিলেন করাচিতে। কিন্তু তাকে পূর্ব পাকিস্তানের কোটায় প্রধানমন্ত্রী করা হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী বাঙালির ওপর এ শোষণ ও উপেক্ষার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পরিহাসের চোখে দেখত পাকিস্তান ও তার মুরুব্বিরা। পাকিস্তানের প্রভুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ চার যুগের ব্যবধানে বিশ্ব অর্থনীতিতে অমিত সম্ভাবনার দেশ। পাকিস্তানিরাও এখন স্বীকার করছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অর্জন অনেক বেশি। সম্প্রতি পাকিস্তানের দ্য নিউজ পত্রিকায় বাংলাদেশ থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে উল্লেখ করে ‘টেকিং এ কিউ ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে উন্নয়ন বিশ্লেষক শহিদ শেখ বলেছেন, পাকিস্তানের হতাশাগ্রস্ত অর্থ উপদেষ্টা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ যদি কর দিতে পারে পাকিস্তানিরা কেন পারবে না? এ বক্তব্যের রেশ টেনে দুই দেশের উন্নয়ন বিশ্লেষণ করেছেন শহিদ শেখ। খ্যাতনামা এই উন্নয়ন বিশ্লেষক উল্লেখ করেন, কিছু সাদৃশ্য থাকলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বৈদেশিক ঋণের আকার বাংলাদেশ জিডিপির ১৪ শতাংশে ধরে রাখতে পেরেছে। বছরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় করে বাণিজ্য ভারসাম্যে এগিয়ে রয়েছে। ফলে মুদ্রামান ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বড় বিনিয়োগ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারায় অর্থনৈতিকভাবে এর সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশ। জনগণের জন্য সামাজিক খাতে তুলনামূলক বেশি ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের ১৮ শতাংশ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট খাতে ব্যয় হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ৩৫ কোটি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নারীদের আত্মকর্মসংস্থানে এগিয়ে আসার চিত্র ইতিবাচক।

নারীদের সামাজিকভাবে এগিয়ে যাওয়ায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তান সাড়ে ২০ কোটি জনসংখ্যার দেশ হলেও বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারায় বাংলাদেশের বাজেটে চাপ তুলনামূলক কম। পাকিস্তান পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে দেশটিতে উগ্র জঙ্গিবাদের বিস্তার অনেকাংশে দায়ী। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও পাকিস্তান পিছিয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদের কারণে। অবশ্য বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের চিত্রও রয়েছে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিকভাবে এগিয়ে গেলেও ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনে সংবিধানের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। রাজনীতির মেরুকরণ শুরু হয়। সে সময় একজন নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বে টেকনোক্র্যাট সরকার প্রতিষ্ঠার কাজ ভেস্তে যায়। ওই নোবেল বিজয়ীর ঋণনির্ভর উন্নয়নচিন্তা ভবিষ্যতে দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কা তৈরি হয়।

রাজনৈতিক ইস্যুর বাইরেও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার উদাহরণ রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এ সমস্যার সমাধানে বিদেশি সহায়তাও পেয়েছে। এত সংকটের পর বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যায়, সে বিষয়টি বাংলাদেশ থেকে শিক্ষণীয়। প্রতিবেদনে একটি ভিন্ন উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তানের ২ রুপির কয়েনে দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর রাজকীয় মসজিদের ছবি, যেখানে বাংলাদেশের ২ টাকার একটি কয়েনে দেখা যায় একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বই হাতে ধরে আছে। যা দুই দেশের ভবিষ্যতের পথনির্দেশনার চিত্রই বহন করে।

পাকিস্তানের দ্য নিউজ পত্রিকা পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে পার্থক্য তুলে ধরেছে তা বাস্তব অবস্থার খ-িত চিত্রমাত্র। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব তিন মিত্র দেশের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় চাপকে অগ্রাহ্য করার সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ মঞ্জুর করার পর ভুয়া অভিযোগ তুলে প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে সেই সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সমমর্যাদার ধারণাকে সমুন্নত রাখতে সমর্থ হয়েছে। যে ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে দাতা দেশগুলোর খবরদারিকে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে প্রতি ক্ষেত্রে।

লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর