বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দেউলিয়া মন্ত্রীর তালিকায় ঘাতকদের উল্লাস

পীর হাবিবুর রহমান

দেউলিয়া মন্ত্রীর তালিকায় ঘাতকদের উল্লাস

অনেক সময়ই এমন ঘটে- চিন্তা করি এক ইস্যুতে লিখব, কিন্তু লিখতে হয় আরেক ইস্যুতে। অনেক সময়ই চিৎকার করে বলতে গিয়েও অনেক কথা বলতে পারি না। অনেক সময় অনেক অপ্রিয় সত্য লিখতে গিয়েও লিখতে পারি না। ছেলেবেলায় ঘুমের মধ্যে মাঝেমধ্যে ভয়ের স্বপ্ন দেখতাম। যে স্বপ্নে কেউ চেপে ধরত বা আক্রমণ করতে দৈত্যের মতো এগিয়ে আসত। কিন্তু সেই সময় দৌড়াতে গিয়েও দৌড়াতে পারতাম না। ভীষণ ভয় ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যখন জেগে উঠতাম, তখন বুঝতে পারতাম এতক্ষণ যা দেখেছি তা ছিল নেহাত দুঃস্বপ্ন। মা বলতেন, বোবায় ধরেছে। আজকাল মাঝেমধ্যে মনে হয়, জেগে থাকা অবস্থায়ই বোবা এমনভাবে ধরেছে যে, কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারি না। লিখতে গিয়েও লিখতে পারি না।

উপমহাদেশের প্রাচীন তৃণমূল বিস্তৃত রাজনৈতিক দল ও এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সুমহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বদানের মহিমায় উদ্ভাসিত সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে দাবানলের আগুন ছড়ানো আওয়ামী লীগ নামের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের আসন্ন কাউন্সিল নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এক কঠিন অন্ধকার সময়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এ দলটির হাল ধরে চারবার ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। অসংখ্য জাতীয় বীরের জন্ম দেওয়া, অনেক নেতা-কর্মীর রক্ত-ঘামে গড়া এ দলটি টানা তৃতীয়বারের মতো ১১ বছর ধরে ক্ষমতায়। দলটি সর্বশেষ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছে তার আলোকে সুমহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে দলের নিবেদিতপ্রাণ, পোড় খাওয়া আদর্শিক, ত্যাগী, সৎ ও গ্রহণযোগ্য নবীন-প্রবীণ, নারী-পুরুষের সমন্বয়ে কী নেতৃত্ব উপহার দেয় জাতির সামনে সেই অগ্নিপরীক্ষার জাতীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে শাসক দল হিসেবে রাজনীতির বিষাদগ্রস্ত সময়ে মূল্যবোধের অবক্ষয়ে যাওয়া সমাজের তলানিতে ভাঙাগড়া বিধ্বস্ত সামাজিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে দলের নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর সামনে ইমানের সঙ্গে কী বার্তা দেয়, কী নতুনত্ব ও সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আসে তা দেখার অপেক্ষায় দেশের রাজনৈতিক মহল। সেটি নিয়ে বিস্তর লেখার ইচ্ছা থাকলেও তা হলো না।

আমাদের গৌরবের, বীরত্বের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়বরণ ও আত্মসমপর্ণের দিন মহান ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৪৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে সোমবার। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে ইসলাম, জিন্নাহ, মুসলমান ও পাকিস্তান- এ চার অনুভূতি নিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশের ভারত বিভক্তির ষড়যন্ত্রের নাটকীয়তায় সৃষ্ট ধর্মের ওপর সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে জন্মলগ্ন থেকেই তরুণ প্রতিবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রহণ করেননি। মেনে নিতে পারেননি বলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী ও পূর্ব বাংলার তাদের প্রতাপশালী দালালদের প্রতিরোধ সামনে রেখে তিনি তাঁর দূরদর্শিতা, বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও দুর্ধর্ষ সাহস নিয়ে স্বাধীনতার দুঃসাহসিক অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন। যৌবনের ১৩টি বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। ফাঁসির মঞ্চে গেছেন। তাঁর আদর্শ ও লক্ষ্যের প্রশ্নে আপস করেননি। শৌর্যে-বীর্যে সুদর্শন বীর বাঙালির মহাকাব্যের এই মহানায়ক তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সূর্যের মতো তেজস্বী গমগমে কণ্ঠের ভাষণে গোটা জাতিকে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ভাষার লড়াই থেকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে টেনে এনে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে জনতার মঞ্চে আবির্ভূত হয়ে ’৭০-এর গণরায়ে তাঁর গগনচুম্বী ইমেজের ওপর নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী করে বিশ্ববাসীর সামনে জাদুকরী একক নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর ছয় দফা ছিল স্বাধীনতার সনদ। ’৬৯ ছিল ইতিহাসের বাঁক। ’৭০ ছিল সাংবিধানিক গণরায়ের প্রাপ্তি। আর ’৭১-এর ৭ মার্চ তিনি গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে দিয়েছিলেন মহান স্বাধীনতার ডাক। অগ্নিঝরা উত্তাল মার্চ পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়া খানের শাসন নয়, কার্যত শেখ মুজিবের শাসন চালু হয়েছিল। তাঁর এ দীর্ঘ সংগ্রামের পথে তিনি একটি বীর জাতিকেই তৈরি করেননি, অসংখ্য স্বাধীনতাসংগ্রামীকে তৈরি করেছেন। তাঁর ছাত্রলীগ থেকে যেমন অসংখ্য জাতীয় বীরের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি আওয়ামী লীগ থেকে রাজনীতিতে গণমুখী অনেক রাজনৈতিক নেতার জন্ম দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার থেকে সিভিল প্রশাসনের এমনকি নানা শ্রেণি-পেশার দায়িত্বশীল মানুষের নিরন্তর যোগাযোগের মাধ্যমে যে প্রক্রিয়ায় নিয়ে এসেছিলেন ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ ও গণহত্যা চালালে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার আগে তিনি যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তা নানা কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছিল।

’৬২ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে নিয়ে ২৫ ডিসেম্বর রাতের প্রথম প্রহরে তৎকালীন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহরলাল নেহরুর কাছে তাঁর জাতির স্বাধীনতার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে তিনি যেমন তাঁর জাতিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন, তেমনি সেই ঘটনার ধারাবাহিকতায় নেহরুকন্যা ইন্দিরার শাসনামলে বন্ধুপ্রতিম ভারতের সহযোগিতার প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় স্বাধীনতা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কলকাতায় যেমন আশ্রয় নেন, তেমনি তাঁর মুজিব বাহিনীর চার প্রধানও সেই ঠিকানায় মিলিত হন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা যেমন দিয়েছেন, তেমনি গণহত্যার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যেমন বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়; জেনারেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়। তেমনি মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ন্যাপ ভাসানী প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কমরেড মণি সিংহ ও মস্কোপন্থি ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হন। তাঁদের কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও গেরিলা যোদ্ধা হয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ সেই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেই সময় জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ বিভিন্ন দল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসরে পরিণত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করে। একটি অংশ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ নানা গ্রুপে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে অনেকে গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধে শরিক হয়। কিন্তু এদের বাইরে গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়।

এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিলে তাদের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার শত সমস্যা এবং দরিদ্রতার মুখেও আশ্রয় ও খাবার তুলে দেয়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পাশে তৎকালীন দুই সুপার পাওয়ারের এক পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ায়। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও বিশ্বের মানবিক সম্প্রদায় গণহত্যার বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে দাঁড়িয়ে যায়। বীরত্বের লড়াইয়ে অনেক যোদ্ধা রণাঙ্গনে শহীদ হন। অনেকে হানাদার বাহিনীর হাতে আটক হয়ে নির্যাতন সয়ে শহীদ হন। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের এ বিজয় এসেছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ভবনকে সেদিন বেশ্যালয়ে পরিণত করা মাতাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করলে ইন্দিরা গান্ধীও পাল্টা যুদ্ধ ঘোষণা দেন। ভারতের সশস্ত্র বাহিনী ও আমাদের মুক্তিবাহিনী মিলে যৌথ বাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর একের পর এক আকাশ, স্থল ও জলপথে আক্রমণ চালালে একেকটি অঞ্চল হানাদারমুক্ত হতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ডাক দেওয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই ভারত আমাদের কাছে ’৭১-এ রক্তে বাঁধা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের রক্তে লেখা এক অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র। ভারত আমাদের এক ঐতিহাসিক সূত্রে গাঁথা সংস্কৃতি ঐতিহ্যে হৃদয়ের পাশে বাস করা বন্ধু রাষ্ট্র। আমরা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর মোশতাক চক্র ও সেনাবাহিনীর একদল বিশ্বাসঘাতক খুনি সদস্যের বুলেটে হারিয়েছি। সেই সঙ্গে হারিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্রীয় আদর্শগুলো। তার অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, শোষণমুক্তির সমাজতন্ত্র আর জাতীয় পরিচয়সত্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

যে ভারত পৃথিবীর বুকে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে নেহরুর হাত ধরে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী থেকে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের শাসনব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষ, উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান, সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে কলঙ্কের কালিমায় স্পর্শ করেছে। নানা ইস্যুতে গোটা ভারত আজ উত্তাল। অমিত শাহের বক্তব্য এই দেশের অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা জনগণকেও ব্যথিত করেছে। এসব নিয়ে লিখতে চাইলেও আর লেখা হলো না।

সোমবার গোটা জাতি যখন ৪৮তম বিজয়ের দিনে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিল, তখন পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও স্বাধীনতা পদক নেওয়া আ ক ম মোজাম্মেল হক দীর্ঘদিনের কাক্সিক্ষত রাজাকারের যে তালিকার প্রথম কিস্তি ১০ সহস্রাধিক মানুষের নাম প্রকাশ করেছেন তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম আসার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি। সেখানে কার নাম আছে, কার নাম নেই, সেটা আমরা বলতে পারব না।’ তাঁর এ বক্তব্য শুনে আমি ব্যক্তিগতভাবে আরও বেশি তাজ্জব বনে গেছি। মনে হয়েছে, যে মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবের, অহংকারের, যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর লড়াই চলছে, সেখানে তাঁকে বোবায় ধরেছে নাকি আমাদের বোবায় ধরেছে! পাকিস্তানের তালিকাই যদি তাঁকে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ আর সারা দেশের এত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কীসের জন্য বহাল রয়েছেন? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হিসেবে তাহলে কি পাকিস্তানের ইতিহাসটাকেই আমরা গ্রহণ করব? এমন বেআক্কেল জবাব এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতীতে কোনো দায়িত্বশীলের মুখে শোনা যায়নি। মন্ত্রীর কাছে আজ প্রশ্ন, টানা ১১ বছর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বিএনপি-জামায়াতের সরকার ও প্রশাসন নয়, তাহলে রাজাকারদের তালিকা বিতর্কিত করার এই ঔদ্ধত্যের জবাব তিনি কেন দেবেন না? মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর যখন রাজনীতিতে জন্ম হয়নি, তখন এ দেশের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের আরেক ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের ’৫৩ সালের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম আরিফ টিপু, যিনি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে রাজশাহী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলেন। যিনি দেশের প্রথম রাজশাহী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর সেই বর্ষীয়ান আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপুকে কি পাকিস্তানি তালিকায় রাজাকার বলা হয়েছে? রাজশাহীর সব মত-পথের মানুষের কাছে সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতির এই পবিত্র পুরুষের নাম দেখে সবাই চমকে উঠেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন, ব্যথিত হয়েছেন। রাজশাহী বিএনপির কান্ডারি সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের কান্ডারি শহীদ কামারুজ্জামানের পুত্র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও বামপন্থি রাজনীতিবিদ এমপি ফজলে হোসেন বাদশা এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা কি আপনি দেখেছেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের অপরাধে বহিষ্কৃত গোলাম আরিফ টিপু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিই নেননি, আইন পেশায় নিজের ক্লিন ইমেজই গড়ে তোলেননি, প্রগতিশীল রাজনীতির পতাকা তুলে ধরে তাঁর দীর্ঘ জীবন পাকিস্তানের সব শাসকগোষ্ঠীসহ এ দেশের সব সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও লোভের হাতছানি উপেক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেনাশাসক আইয়ুবের আমলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নির্যাতিত নেতা-কর্মীসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষে আইনি লড়াই করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সেই ধারা অব্যাহত রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব নির্যাতিত ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের জন্য যখন আইনি লড়াই করেছেন আপনি তখন কোথায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একদিকে তিনি যেমন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তেমনি আপনার দলের মরহুম সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ অনেকের জন্য গোলাম আরিফ টিপু সামরিক আদালতে সাহসের সঙ্গে আইনি লড়াই করেছেন। রাজনীতি ও আদালতপাড়ার সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রচারবিমুখ নির্লোভ, নিরহংকারী, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন দীর্ঘকাল ধরে দেশের অন্যতম ডিফেন্স কৌঁসুলি, যিনি নীতি-আদর্শের প্রতি বিচ্যুত না হয়ে আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে এক বর্ণাঢ্য আদর্শিক চরিত্র ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে রেখে যাচ্ছেন, জীবনের পড়ন্ত বেলায় ৯০ ছুঁইছুঁই এই মানুষটির বিরুদ্ধে জঘন্য এমন মিথ্যা অপবাদ কি পাওনা ছিল? যিনি কোনো অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত করেননি। তাঁর চরিত্রে কালো দাগ দেওয়ার অপরাধীদের কী শাস্তি হতে পারে আজ?  আইনে বলা হয়, ১০০ অপরাধীও যদি মুক্ত হয় তবু একজন নিরপরাধ লোক শাস্তিভোগ করতে পারে না। আপনি রাজাকার-ঘাতকদের নাম-পরিচয় প্রকাশে যেখানে ব্যর্থ সেখানে জীবিত-মৃত বীরদের এমন অপমান করার সাহস পেলেন কীভাবে?

তরুণ বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা দলের একজন কিংবদন্তি ফুটবলারও তিনি ছিলেন। তাঁর আইনি যুক্তি-তর্ক শোনার জন্য সার্কভুক্ত দেশের আইনজীবীরাই আদালতে হাজির হননি, পথের মানুষও ছুটে গেছে। সাড়াজাগানো নীহার বানু হত্যা মামলার ডিফেন্স কৌঁসুলি হিসেবে যখন দেশজুড়ে তাঁর নাম ছড়িয়ে যায়, তখন সেনাশাসক জিয়াউর রহমান তাঁকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে গণতন্ত্রের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। পরবর্তী সেনাশাসকদের নিমন্ত্রণও গ্রহণ করেননি। জাতির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে সম্মান দিতে না পারেন, অসম্মান করার অধিকার আপনাদের কেউ দেয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াত-শিবিরবিরোধী ১৬২ জন ছাত্রনেতার মামলা বিনা পয়সায় লড়ে জামিন আদায় করে শিঙ্গাড়া খেতে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়েছিলেন। সেই দুঃসময়ে আপনি কোথায় ছিলেন? ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সাইদুর রহমানসহ শিক্ষকদের ছাত্র বিক্ষোভের কারণে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন জানি না। কিন্তু অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু শত চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে চিরচেনা সাহস নিয়ে তাদের জন্য টানা পাঁচ ঘণ্টা আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে অনেককে মুক্ত করেছিলেন। সেই ওয়ান-ইলেভেনে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন মিথ্যা মামলায় আদালতে বন্দী করে সংসদের পাশে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, তখন অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল আপনি কোথায় ছিলেন জানি না। কিন্তু সেদিন মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের অনুরোধে গোলাম আরিফ টিপু রাজশাহী থেকে এসে বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য যুক্তি-তর্ক, আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন। গোলাম আরিফ টিপুকে আপনি ও আপনার ব্যর্থ মন্ত্রণালয় না জানলেও রাজশাহীর প্রতিটি মানুষ, সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিম্ন আদালতের সব বিচারক ও আইনজীবীরা ভালো করে জানেন। দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদরা যেমন তাঁকে চেনেন, তেমনি দেশের প্রবীণ ও সিনিয়র আইনজীবীরা আপনাকে বলতে পারবেন। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক গোলাম আরিপ টিপু পরিবার নিয়ে তাঁর শাশুড়ির নানাবাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদার আইহোর জমিদারবাড়িতে রেখে রণাঙ্গনে ভূমিকা রাখেন।

রাজশাহীর এ তালিকায় অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের নাম এসেছে। যিনি ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ভারতে ছিলেন এবং ’৬৯-এ কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু রাজশাহী সফরে গিয়ে অ্যাডভোকেট সালামের বাসভবনেই উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যে অ্যাডভোকেট সালামের পরিবারের পাঁচ সদস্য শহীদ হন, তিনি রাজাকার? সালাম সাহেব তো ভারতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মহসীনও রাজাকার? এই তামাশা, এই প্রহসন, এই নির্লজ্জ বিকৃতি আমাদের সহ্য করতে হবে! পাথরঘাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের ৪০ বছর সভাপতি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মজিবুল হক নয়া ভাই। তিনিও রাজাকার? তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগম বলেছেন, মরণের সময় দেখতে হলো, স্বামীর নাম রাজাকারের তালিকায়! এখন কবর থেকে তাঁর লাশ তুলে নিয়ে বিচার করুন। বরিশালের মেয়র নির্বাচনে বাসদের প্রার্থী হয়ে আলোচিত হয়েছিলেন ডা. মনীষা চক্রবর্তী। এই মূল্যবোধের অবক্ষয় আর লাভ-লোভ, স্বার্থপরতার আস্ফালনে নষ্ট সমাজে একদম আদর্শবান ছাড়া কেউ বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টি এসব দল করে না। সেই বাসদ করা মনীষার বাবা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পান। অথচ রাজাকারের তালিকায় আজ তাঁর নাম! মনীষার দাদা সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ’৭১ সালে বাসা থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। তাঁর সহধর্মিণী ঊষা রানী চক্রবর্তীর নাম এসেছে রাজাকারের তালিকায়! ভাষাসৈনিক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বরিশালের প্রয়াত মিহির লাল দত্তও এ তালিকা অনুযায়ী রাজাকার! তিনি ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পিতা জিতেন্দ্র লাল দত্ত ও মেজো ভাই সুবীর দত্ত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।

বিজয় দিবসের দিনে এ তালিকা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর জামায়াত-শিবিরসহ যারা স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তা লালন করেন তাদের নির্দয় উল্লাস করার যেমন সুযোগ করে দিয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, চিন্তা-চেতনায় লালিত মানুষকে হতবাক করেছে, ব্যথিত করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের আদর্শের অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লাস করে লিখেছে, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর ফাঁসি চায়। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আজীবন কারাদ-প্রাপ্ত সাঈদীর মুক্তি চায়। এই প্রতারণার মিথ্যা তালিকা, বিচারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আরও অবাক করে দিয়েছেন তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বলেছেন, যাচাই-বাছাই ছাড়াই ’৭১-এ পাকিস্তান সরকারের সংরক্ষিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তালিকা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কতটা দায়িত্বহীন ও ব্যর্থ তা তাঁর বক্তব্য ও প্রকাশিত তালিকায় প্রকাশ করে দিয়েছেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, কারা রাজাকার বাহিনীর সদস্য হয়েছিলেন, কারা আলবদর-আলশামস-আলমুজাহিদসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য হয়েছিলেন? কারা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ নানা অপরাধ করেছেন, তার বর্ণনাসহ নামের তালিকা না থাকায় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের রাজাকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করে আরেক দফা মিথ্যাচারের দলিল উত্থাপন করেছেন। এ যেন ইতিহাস বিকৃতির নতুন মডেল। এটি কি রাজাকারদের রক্ষা করার ষড়যন্ত্র নাকি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে বেইমানির আরেক অধ্যায়? অথবা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের আরেকটি আলামত? এটা যাচাই-বাছাই করা না হলে, কোন কালো শক্তির নেপথ্য হাত ধরে প্রকাশিত হয়েছে? তবে কি ’৭১-এর পরাজিত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রেসক্রিপশন? রাজাকারের তালিকা চাওয়া দূরে থাক, জাতীয় বীরদের ইজ্জত রক্ষার আকুতি দেখা দিয়েছে। যেন ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও অবস্থা।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রণালয়কে কি স্বপ্নের সেই বোবায় ধরেছে? নাকি যে রাষ্ট্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ হত্যা করা হয়, যে রাষ্ট্রে খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল, যে রাষ্ট্রে ’৭১-এর পরাজিত শক্তিকে পুনর্বাসিত করে হৃষ্টপুষ্ট করে বারবার ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতার অংশ? যে রাষ্ট্রে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য বীরদের অবহেলা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় বীরদের বাদ দিয়ে, মুজিববাহিনীর প্রধানদের থেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের অবজ্ঞা করা হয়, ’৭১ ও ’৭৫-এর বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমকে রাজাকার বলা হয়, খেতাবপ্রাপ্ত জাতীয় বীর থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির নায়কদের নির্বাসিত করে রাখা হয়, তারই ধারাবাহিকতার অংশ? তবে দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, অন্যায় করে লজ্জা না পাওয়া আরও বড় অন্যায়। ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতা যতই রাখুন না কেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিয়ে বিদ্রƒপ-উপহাস করুন না কেন, শত বছর পর হলেও সত্য তার আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হবে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অবদান রাখা বীর সন্তানরা অনেকে নিহত। অনেকে চিরনিদ্রায়। জীবিতরা হয়তো ১০ থেকে ১৫ বছর বাঁচবেন। কিন্তু অন্তহীন দহন নিয়ে তারা দেখে গেলেন স্বাধীনতাবিরোধীরাই নয়, গণতন্ত্র হরণকারীরাই নয়, ’৭১ ও ’৭৫-এর ঘাতকরাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রণালয় চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নির্লজ্জতাই দেখায়নি, বিশ্বাসঘাতকতাই করেনি, চরম বিকৃতি ঘটিয়েছে। এদের মুখে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ মানায় না। এই বিশ্বাসঘাতকতা মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব ও ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব শহীদের আত্মার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। যেখানে উচ্চ আদালত বলেছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না। সেখানে এটাই সত্য যে, সরকারের চার সচিব মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখেই জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ধরা পড়েও যেমন সাজা পাননি, তেমনি ’৭১-এর ঘাতক-দালাল, রাজাকারদের নাম আড়াল করে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের নাম রাজাকারদের তালিকায় দিয়ে অপমান করা হয়েছে বিতর্কিত তালিকায় নাম তুলে দিয়ে। ইতিহাস এ অপরাধের জন্য ক্ষমা করবে কিনা, সেটা সময়ের হাতেই ছেড়ে দিতে হয়। অতীতে অনেক টাকার খেলায় মুক্তিযুদ্ধ না করা মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার বানানোর মতো জঘন্য পাপ এবারই হলো। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এত দিন কী করেছেন? কী করেছে মন্ত্রণালয়? সংসদীয় কমিটিতে যাচাই-বাছাই করা হলো না কেন? কার জন্য? আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কতটা দেউলিয়া হলে শেখ হাসিনার সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী হন এমন অযোগ্য দায়িত্বহীন আ ক ম মোজাম্মেল! তাও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। কত স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বীরদের বাদ দিয়ে মন্ত্রী থাকার সুবাদে নিয়ে নেন স্বাধীনতা পদক। যত পারেন নিয়েছেন। কিন্তু এবার জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম রাজাকার তালিকায় দিয়ে বিজয় দিবসে ঘাতক চক্রকে গ্লানিমুক্ত করে বিজয়ের উল্লাস করতে দিয়েছেন। বিজয়ী বীরদের মুখে বিষাদ-অপমানের ছায়া দিয়েছেন। ক্ষমা চাইলেই এমন অপরাধের ক্ষমা হয় না। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে পদত্যাগ করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। যারা এ তালিকায় জড়িত তাদের শাস্তি দিয়ে সঠিক তালিকা প্রকাশ করা উচিত।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর