বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি ছাড়া উপায় নেই

তসলিমা নাসরিন

হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি ছাড়া উপায় নেই

ভারতের সবখানে এখন এনআরসি আর সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নিয়ে আলোচনা। আমার চুল কাটে যে ছেলেটি তার নাম মোহাম্মদ আরিফ। কাল আমি সেলুনে ঢুকতেই আরিফ জিজ্ঞেস করলো, ম্যাডাম, আপনি কি নাগরিকত্ব আইন সমর্থন করেন? আমি চুপ করে রইলাম। চারদিকে শুনছি, হিন্দু মুসলমান সবাইকে বলা হচ্ছে, তুমি যদি আইনটির পক্ষে বা সরকারের পক্ষে না থাকো তুমি দেশদ্রোহী। আমি ভাই দেশদ্রোহী হতে যাবো কোন দুঃখে, এই দেশকে ভালোবেসেই তো ইউরোপ-আমেরিকা ছেড়ে এসেছি। আরিফকে এমন অস্থির উচাটন আগে কখনও দেখিনি। টেলিভিশনের দিকে চোখ আরিফের। টেলিভিশনে দেখাচ্ছে মুসলমানরা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বাস ট্রাক ভাংচুর করে, আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করছে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে। আরিফের এবারের প্রশ্ন, এটা কি সত্যি যে ৭০ বছর ধরে আমরা মুসলমানরা যে এ দেশের নাগরিক, তার প্রমাণ দিতে হবে? আমি বললাম, সরকার তো বলেছে ভারতের মুসলমানদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, এ শুধু অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। আরিফের আবার প্রশ্ন, এনআরসি’র কথা বলছি। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি। ওটি নিয়েই তো ভয়। আমি বললাম, ভয় কেন, আপনি তো এ দেশের নাগরিক, আপনার চৌদ্দ পুরুষ এ দেশের নাগরিক। আরিফ বললো, হ্যাঁ, কিন্তু এগুলোর প্রমাণ কী করে দেখাতে হয় সেটা তো জানি না, শুনেছি আধার কার্ড নাকি প্রমাণ নয়। জিজ্ঞেস করলাম, পাসপোর্ট নেই? বললো, না, পাসপোর্ট নেই। দেশের বাইরে তো যাওয়া হয় না। আবারও প্রশ্ন আরিফের, আচ্ছা, এই আইনটা কি সত্যিই থাকবে, না উঠে যাবে? কত অসহায় বোধ করলে আরিফ দেশের কোনও বিজ্ঞ রাজনীতিককে প্রশ্ন না করে, আমাকে প্রশ্ন করছে, জেনেও যে আমি এ দেশের নাগরিক নই, বছর বছর বসবাসের অনুমতি বাড়িয়ে বাড়িয়ে থাকি।

আমাকে যদি নিজের জন্মের, কে আমার বাবা মা, কোন দেশে তাদের জন্ম, কোথায় তাদের বসতবাটি, কোন ইস্কুলে পড়েছে তারা, আমি কোন ইস্কুলে পড়েছি, কোথায় কবে চাকরি করেছি, এসবের প্রমাণপত্র দিতে বলে কেউ, আমি পারবো না। আমি শিক্ষিত হয়েই যদি না পারি, লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত মানুষ কী করে পারবে! আজ জানি না কার নির্দেশে জনগণের সম্পত্তি নাশ করতে নেমেছে মুসলমানেরা। ধংসাত্মক প্রতিবাদ করতে তাদের কি ইন্ধন জোগাচ্ছে কেউ? মুসলমান-বিদ্বেষীরা এখন ওদের দেখিয়ে দেখিয়ে বলার সুযোগ পাচ্ছে ‘দেখো কত ভায়োলেন্ট ওরা!’ প্রচুর হিন্দু এবং মুসলমান ভারতবর্ষের ইতিহাস, দেশভাগ, ধর্মের রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে কোনও জ্ঞান না রেখেই ক্ষোভে ফুঁসছে। মাঝে মাঝে এদের আমার স্রেফ দাবার ঘুঁটি বলে মনে হয়।

আমি সত্যি জানি না কী হতে যাচ্ছে ভারতে। শুধু মুসলমানই নয়, প্রচুর হিন্দুও অসন্তোষ প্রকাশ করছে। কেউ কেউ এমনও বলছে এ নাকি হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করার প্রথম ধাপ। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু চায় ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার, তবে কে বাধা দেবে! সংসদে যদি হিন্দু রাষ্ট্রপন্থিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকে, খুব সহজে পাস হয়ে যাবে বিল। আম্বেদকারের লেখা সংবিধান, যেটিতে সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষকে সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেটি একটু একটু করে বদলাতে থাকবে। বদলানোর ব্যাপারটা তো আমি জানিই। আমরা নিজেই কি দেখিনি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান কী করে অল্প অল্প করে পাল্টে গেল। এই যে আজ বাংলাদেশ পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাগণ ভারতের নাগরিকপঞ্জি তৈরি নিয়ে আপত্তি করছে, নাগরিকত্ব আইন নিয়েও আপত্তি করছে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায় গায়ে ফাটল ধরেছে বলে অনুযোগ করছে, তাদের নিজেদের রাষ্ট্রের সংবিধান কি ধর্মনিরপেক্ষ? তারা কি নিজেদের দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গড়ার চেষ্টা করেছে বা করছে? তুমি যদি ধর্মনিরপেক্ষ না হও, তবে অন্যকে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার উপদেশ দিতে পারো না। যে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম গেড়ে বসে, সে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা পালায়। আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার প্রথম শর্তই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া।

যে যতই বলুক ভারত সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে, আমার মনে হয় না ভারত কখনও হিন্দু রাষ্ট্র হবে বা মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করবে। আমার মনে হয় না ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক না করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মতো ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবে। ভারত এখনও শত ধর্মের শত বর্ণের শত জাতের শত ভাষার শত সংস্কৃতির সমাহার। কট্টরপন্থি কূপম-ূকের দাবি মানলে ভারত তার মহত্ত্ব হারাবে। ইতিমধ্যেই নাগরিকত্বপঞ্জির কারণেই পৃথিবীর বহু প্রান্ত থেকে নিন্দে শুরু হয়েছে। ২০ কোটি মুসলমান নাগরিকের সমান অধিকার ব্যাহত হচ্ছে কিনা বিশ্ব দেখছে। বিশ্বের সঙ্গেই ভারতের লেনদেন। বিশ্বকে হঠিয়ে দিয়ে বেশি দূর হাঁটা সম্ভব নয়।

মুসলমানরা জগৎজুড়ে যত সন্ত্রাসই করুক না কেন, মানবতার প্রশ্নে আজও দেশে দেশে মানুষ নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়ায়। মানুষের শ্রদ্ধা আর আস্থা পেতে হলে মুসলমানদের আরও সভ্য এবং শিক্ষিত এবং ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। আরও বেশি উদার এবং সহিষ্ণু হতে হবে। তা না হলে ধর্মনিরপেক্ষ অমুসলিম-প্রধান দেশগুলো যদি মুসলমানদের গ্রহণ করতে না চায়, সৌদি আরবে যেমন অমুসলিমদের সমান মর্যাদা দেওয়া হয় না, তেমন যদি তারাও মুসলমানদের সমান মর্যাদা না দেওয়ার ব্যবস্থা করে, তবে মুসলমানদেরই বিপদ। সারা বিশ্ব সভ্য হবে, শুধু আমাদেরই অধিকার আছে অসভ্য থেকে যাওয়ার, অনুদার থেকে যাওয়ার। ধর্মের দোহাই দিয়ে অমানবতা অসহিষ্ণুতা আর হয়তো চলবে না।

ভারতীয় উপমহাদেশ দেখেছে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরেছে দাঙ্গায়। হিন্দু মুসলমানকে হত্যা করেছে, মুসলমান হিন্দুকে করেছে। আর কোনও দাঙ্গা যেন না হয়। আর কোনও রক্ত যেন রাজপথ না ভেজায়। একজন সংখ্যালঘু মুসলমান ভারতের রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, একজন সংখ্যালঘু হিন্দু বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি যখন হতে পারেন, তখন সম্প্রীতি সম্ভব হিন্দু মুসলমানের মধ্যে। দুই সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি ছাড়া আর কোনও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এই মুহূর্তে নেই।

               লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর