সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জাতীয় বীর ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানসপুত্র রাজ্জাক

বাহালুল মজনুন চুন্নু

জাতীয় বীর ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানসপুত্র রাজ্জাক

আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের মানসপুত্র এবং তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের একজন শীর্ষ যোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক ছিলেন মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান। গণমানুষের রাজনীতির নায়ক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আদায় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক যিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এবং জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সবর্দা ছিলেন নির্ভীক। তিনি ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। সারাজীবন লড়ে গেছেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দৃপ্ত শপথ লড়াইয়ে রক্তেভেজা রাজপথের, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের অনিশ্চিত এক জীবন পাড়ি দেওয়া এই বীর সেনানী আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু মহাকালের খেয়ায় তিনি যে কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তার একজন বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে ষাটের দশকে ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে রাজপথ থেকে শুরু করে জেলজীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতেই একসময় আবদুর রাজ্জাকের উত্তরণ ঘটেছিল জাতীয় নেতা হিসেবে। রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে, সারা দেশ চষে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সারা দেশের মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করাই ছিল যেন তার জীবনের একমাত্র ব্রত। দীর্ঘ সংগ্রাম পরিক্রমার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি নিজ জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশমাতৃকার প্রতি প্রবল ভালোবাসা আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি তীব্র আবেগ তাকে রণক্ষেত্রে সবর্দা সাহস জুগিয়ে গিয়েছিল। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ও রূপকারই কেবল তিনি ছিলেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হয়ে নিজেও লড়াই করেছেন সম্মুখ সমরে। বাঙালি জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষাময় স্বাধীনতা অর্জন ও তৎপর চূড়ান্ত বিজয়ের পর থেকে আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাস্তবায়নে কাজ করে গিয়েছিলেন নিরলস। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন জাতির পিতার নির্দেশ পালন করে। পরবর্তীতে বাকশালের সম্পাদক হিসেবে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচিকে সাফল্যমন্ডিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের পর প্রায় দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন। দলের নেতা-কর্মীরা যখন দিশাহারা, সেই সময়টাতে তিনি জেলে বসেই দলকে সংগঠিত করার জন্য, জাতির পিতার হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে দল পরিচালনা করতেন। পঁচাত্তর পরবর্তী যে দুঃসময় গেছে, যে দুর্যোগ ঘটেছে জাতীয় জীবনে, সামরিক জান্তার শোষণ নিপীড়নে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন অসহায়-দিশাহারা হয়ে পড়েছিল তখন সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্রলীগের কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি কারাগার থেকেই আমাদের যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিতেন সবসময়। পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যখন আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই তাদের অনুগত করেছিল, তখন শত প্রলোভনেও তাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র কক্ষচ্যুত করতে পারেনি কেউ। এ জন্য তাকে সইতে হয়েছে শত নির্যাতন-নিপীড়ন। কিন্তু শত নিপীড়নেও তিনি কাবু হননি, মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাই তাকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল। তাই নিশঙ্কচিত্তে তিনি শত নির্যাতন, শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেছেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের দিগভ্রান্ত কর্মীদের সংগঠিত করে, আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত দলে পরিণত করার কাজে। আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধির দীক্ষায় নেতা-কর্মীদের সুসংগঠিত করে তিনি হয়েছিলেন দলের মধ্যমণি। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন দূরদর্শী-বিচক্ষণ এক রাজনীতিবিদ, তাই তিনি বুঝেছিলেন এ বাংলায় আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রাখার জন্য, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি বানাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জননেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে সাফল্যমন্ডিত করে স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের পিলে চমকে দিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও আবদুর রাজ্জাকের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে সামরিক স্বৈরাচারী সরকার দেশকে আবারও পাকিস্তানের করতলগত করার জন্য দেশকে সংঘাত, সংক্ষুব্ধ, গুম, খুনসহ যে অরাজক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার যে কূটকৌশল চালিয়েছিল, আবদুর রাজ্জাক সবর্দাই ছিলেন এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তীব্র প্রতিবাদী এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক মহান ধারক। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী একজন নেতা। নব্বই দশকের শুরুতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম এক সক্রিয় সৈনিক। তাদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা পদক্ষেপের ফলেই মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে আজ দেশ কলঙ্কমুক্ত। এমন কর্মীদরদি, এমন জনদরদি, সৎ, নির্লোভ, আদর্শিক রাজনীতিবিদ এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। ইতিহাসে তিনি একজন জাতীয় বীর ও জননায়ক হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন। জাতির পিতার আদর্শে অমৃত্যু অবিচল এই মহান নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ খবর