বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আত্মপরিচয়ের স্বার্থে চাই স্থানীয় জাদুঘর

মোশাররফ হোসেন মুসা

আত্মপরিচয়ের স্বার্থে চাই স্থানীয় জাদুঘর

এ দেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের (উর্দুভাষী বিহারি) সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয় তা হলোÑ তারা এ দেশে প্রায় ৭২ বছর যাবৎ বসবাস করেও এ দেশের সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি, তারা কৃষি আবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং তাদের খাদ্যাভ্যাসও আমাদের মতো নয়। তারা মাছ খায় না, তারা মাংসপ্রিয়। তারা শহুরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তাদের ধর্মীয় উৎসবও এ দেশের বাঙালি মুসলমানের মতো নয়। ফলে তাদের এ দেশের মানুষ এখনো বিদেশি মনে করে। সেজন্য বলা হয়, একটি দেশে স্থানীয়দের সঙ্গে দ্রুত মিশে যাওয়ার উপায় হলো তাদের সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়া। একই প্রশ্ন যদি বাঙালি মুসলমানদের করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তারাও এ দেশের সংস্কৃতিকে এখনো আপন করে নিতে পারেনি। তারা এ দেশের প্রকৃতিকেন্দ্রিক উৎসবকে হিন্দু সংস্কৃতি মনে করে। অ্যারাবিয়ান দেশগুলোর সংস্কৃতিকে আপন মনে করে আত্মপরিচয়ের সংকট ঘোচানোর চেষ্টা করে। ফলে নিজ দেশে হাজার বছর ধরে বসবাস করেও পরবাসী হয়ে আছে। উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইংল্যান্ডের মুসলমানদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া দেখে মন্তব্য করেছিলেন- ‘এ দেশে মুসলমানরা প্রায় ৬০০ বছর যাবৎ বসবাস করেও কেন যে ইংল্যান্ডবাসী হতে পারছে না, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।’ ইউরোপিয়ান দেশগুলো নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে সেসব দেশে বহু আগেই জাতি গঠন সম্ভব হয়েছে। বলা হয়, এখন বিশ্বায়নের যুগ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় নয়। তাই বলে নিজস্বতাকে ত্যাগ করে বিশ্বায়ন কাম্য হতে পারে না। সবার জানা রয়েছে, খ্রিস্টধর্মের প্রচারকরা তাদের ধর্ম প্রচারকালে একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঘাত করেন না। কিন্তু মুসলমানরা তাদের ধর্ম প্রচারকালে একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঘাত করায় স্থানীয়দের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় উগ্রবাদবিরোধী ‘আইডেনটিটি, আইডেনটিটি পলিটিক্স অ্যান্ড ইলেকশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার এক গবেষণাপত্র উপস্থাপনকালে বলেন, তিনি ২০৮ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যাদের ১৪৫ জনই ধর্মীয় পরিচয়কে এক নম্বরে রেখেছেন। তারা বাঙালি, বাংলাদেশি কিংবা এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য কোনোটাই বিবেচনায় নিতে রাজি নন। তাদের কাছে ধর্মগত পরিচয়টাই আসল। (প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৯)। অর্থাৎ কাক্সিক্ষত সাংস্কৃতিক আন্দোলন না থাকায় আত্মপরিচয়ের সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। আর আত্মপরিচয়ের সংকট থেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদের জন্ম ঘটছে। পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব। অবশেষে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ’৭১-এ আমাদের প্রিয় স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’ কিন্তু আমরা সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাকে জয় করতে ব্যর্থ হই। এখানে উল্লেখ্য, গুরুসদয় দত্ত বাংলার সাংস্কৃতিক দৈন্য দূর করার জন্য ব্রতচারী আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর ‘ব্রতচারী সখা’ গীতি গ্রন্থের শুরুতে লেখা আছে (প্রকাশকাল ১৯৩৩ খ্রি.)- আমরা বাঙালি, বাংলা মাতৃভূমি আমাদের মাতৃভূমি; বাংলার শক্তিধারা আমাদের মধ্যে অভিব্যক্ত, আমরা ছন্দধারার মূর্ত প্রকাশÑ এই দেশাত্মবোধ প্রতিদেনর অজস্র কর্মব্যস্ততার মধ্যে আমাদের অন্তরে সঞ্চারিত করে দিতে হবে। সর্বদাই আমাদের মনে এ কথা জাগাতে হবে যে, আমরা বাঙালি- সে হিসেবে আমরা এক। বাংলার ব্রতচর্চার গোড়ার কথা এই যে, বাংলাবোধ, পরস্পর অভিভাষণ প্রথার ভিতর দিয়ে তা প্রতিনিয়ত যাতে বাংলার ব্রতচারী স্মরণ পথে রাখতে পারে সেজন্য অভিভাষণের সময় ‘ই-আ’ উচ্চারণের পরে আমরা বলবÑ ‘জয় সোনার বাংলা’ অথবা সংক্ষেপে জ-সো-বা। জ-সো-বা বাক্যটার পুরো তাৎপর্য হলো এই যে, অভিভাষক ও অভিভাষিত উভয়ে পরস্পরকে জানাচ্ছেন ‘আপনিও বাংলার ধারার অংশ, আমিও বাংলার ধারার অংশ, বাংলার ভূমি, নদী, হাওয়া, জল, ফুল-ফল, গাছপালা, গরু-বাছুর, শস্য-শিলা, বাংলার ভাষা, বাংলার কলা, বাংলার নৃত্যগীত, বাংলার কৃষ্টি সবই বাংলার শক্তির ধারার অংশ। ব্রতচারী আন্দোলন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদ বহু আগে থেকেই অবগত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ধারণা পোষণ করতেনÑ ‘ব্রতচারী আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রোখাসহ আমাদের সংস্কৃতির জাগরণ সম্ভব।’ কিন্তু পরে রাজনীতিকদের দক্ষিণপন্থার সঙ্গে আপসের কারণে আমরা বহুভাবে পিছিয়ে পড়েছি। এখন নতুনভাবে শুরু করা প্রয়োজন। এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। একটি এলাকার কয়েকটি গ্রামের নাম যথা- রামেশ্বরপুর, রামন্নাথপুর, লক্ষ্মীকুন্ডা, অর্জুনপুর, লছিরামপুর দুর্গাপুর, জগন্নাথপুর, পূর্বটেংরী ইত্যাদি। নদ-নদীর নাম- কমলা, বড়াল, সুতা, কাতলা, ইচলি, ইলশা ইত্যাদি। এসব নামকরণ কীভাবে হলো অধিকাংশ মানুষ জানে না। নদ-নদী-প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেছেন, ‘এ দেশের নদ-নদী ও স্থানের নাম এসেছে ফুল, ফল, মাছ, পাখি, পশুর নাম ও ধর্মীয় মিথ থেকে।’ সেজন্য স্থানীয় পর্যায়ে জাদুঘর স্থাপন করতে হবে। সেখানে এলাকার ইতিহাস ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, বিভিন্ন উৎসব, খেটে খাওয়া মানুষের উপকরণের ব্যাখ্যা থাকবে। পাঠ্যপুস্তকে নিজ নিজ এলাকার ইতিহাস লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ের আকচা গ্রামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)’ প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহিদ-উজ-জামান ‘লোকায়ন জীবন বৈচিত্র্য’ নামে একটি স্থানীয় জাদুঘর গড়ে তুলেছেন। সেখানে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। নদী গ্যালারিতে নদীর ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এলাকার কৃষিজীবীদের উপকরণসহ নানা জীববৈচিত্র্যের সমাহার ঘটিয়েছেন। এ কাজটি এনজিওদের জন্য রেখে দেওয়া ঠিক হবে না। সরকারের উদ্যোগে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে তথা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে নির্ধারিত কক্ষে জাদুঘর স্থাপন করতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও আত্মপরিচয়ের সংকট দূর হবে এবং নতুনভাবে নিজস্ব সংস্কৃতির জাগরণ শুরু হবেÑ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয়  সরকারবিষয়ক গবেষক।

                ইমেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর