শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সুখের দেখা পান না প্রবাসীরা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

সুখের দেখা পান না প্রবাসীরা

প্রবাসে জন্ম নেওয়া বা বাংলাদেশ থেকে শিশু বয়সে প্রবাসে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রবাসী অভিভাবকদের ভাবিয়ে তোলে। প্রবাসের সব দেশে বা একই দেশের সব অঞ্চলে বাংলাদেশি পাঠ্যক্রম পড়ানোর মতো বাংলাদেশি স্কুল নেই। যে কটি স্কুল আছে, সেখানে ইংরেজি মাধ্যমে (ভার্সন) বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম পড়ানো হয়। বিকল্প হিসেবে মূলত ব্রিটিশ কারিকুলাম পড়ানো হয় প্রবাসের বাংলাদেশি স্কুলগুলোয়। বাংলাদেশের গ্রাম বা মফস্বল থেকে প্রবাসে যাওয়া ছাত্রছাত্রীকে এসব স্কুলের পড়ার মানের সঙ্গে তাল মেলানো কষ্ট হয়ে যায়। আবার যে কোনো কারণে কোনো পরিবারকে মফস্বল বা গ্রামে ফিরে যেতে হলে সে তার উপযোগী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পায় না। এসব স্কুল পরিচালনা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের ইমেজকে ক্ষুণ্ন করছে। স্কুলকেন্দ্রিক বেশ কিছু মামলা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। স্কুলের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে বিদেশি মিডিয়ায়। একটি দেশের স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও স্কুলের অধ্যক্ষকে জেলে যেতে হয়েছে স্কুলকেন্দ্রিক সমস্যার কারণে যা সংবাদ হয়ে আসে সংবাদমাধ্যমে। এসব স্কুলের শিক্ষকদের যে বেতন বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের তুলনায় মোটেও আকর্ষণীয় নয়। ফলে স্কুলগুলোয় মানসম্মত শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার দেশের শিক্ষা খাতে ব্যাপক সহায়তা ও বরাদ্দ দিলেও প্রবাসের এসব স্কুলের ভাগ্যে বেশি কিছু জোটে না। কালেÑভদ্রে সর্বোচ্চ মহলের কারও পরিদর্শনের সুযোগ হলে হয়তো কিছু সাহায্য মেলে। এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা শেষে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের সামনে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাসে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ মান অর্জন এবং মোটা অঙ্কের খরচ প্রয়োজন, যা অনেকের সাধ্যের বাইরে। দেশে ভালো নিরাপদ পরিবেশে সন্তানকে বিশেষত মেয়েদের রেখে উচ্চ শিক্ষা দিতে প্রবাসীরা আস্থা পান না। ফলে প্রবাসের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে তারা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি নিলেও বস্তুত তারা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে না। দেশে যে পদ্ধতিতে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এমনকি সরকারি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয়, তা ব্রিটিশ কারিকুলামে পড়াশোনা করা প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক প্রবাসী সন্তান তাই এইচএসসি বা সমমানের পড়ালেখার পর বেশি দূর এগোতে পারে না। আবার উন্নত দেশে থেকে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে ফিরে গ্রামের বা মফস্বলের জীবন মেনে নিতে পারে না।

জায়গাজমি নিয়ে প্রবাসীদের সমস্যা নিয়েও পৃথক একটি বই লেখা সম্ভব। বাংলাদেশে ‘হায় হায় কোম্পানি’ নামে কুখ্যাত আবাসন কোম্পানি -গুলোয় বিনিয়োগ করে যেসব গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন, তার একটি বিরাট অংশ প্রবাসী বাংলাদেশি। অনেকে আবার এসব কোম্পানির ডাইরেক্টরশিপ বা আংশিক মালিকানা কিনে প্রতারিত হয়েছেন। ব্যক্তি উদ্যোগে জমি বা ফ্ল্যাট কিনে প্রতারিত হয়েছেন এমন প্রবাসীর সংখ্যাও কম নয়। জমি কিনেও নানা জটিলতায় প্রবাসীরা মালিকানা বুঝে পান না, মালিকানা পেলেও দখল পান না, আবার দখল পেলেও তা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। আপস-মীমাংসার নামে এ ক্ষেত্রে গ্রাম্যমোড়ল, থানা-পুলিশ ও প্রশাসনের অন্যায় আবদার মেটাতে হয় প্রবাসীদের। সবার একই কথাÑ ‘আপনি তো প্রবাসী। আপনাকে তো আল্লাহ অনেক দিয়েছেন, এদের দিকে একটু দেখেন।’ এরা যে অন্যায় করছে তা কেউ দেখে না বরং যারা অন্যায় করেছে তাদের দেখা দাবি চাপানো হয় প্রবাসীদের ওপর। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক বঞ্চনাও কম নয়। পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনের সময় প্রবাসীদের বঞ্চিত করার সব সুযোগ খোঁজা হয়। সম্পত্তির সবচেয়ে খারাপ বা ঝামেলাপূর্ণ ভাগটা দেওয়া হয় প্রবাসীকে। কারণ তাকে তো আল্লাহ দিয়েছেন! প্রবাসী সন্তানের টাকায় বাবা-মা নিজ নামে জমি কিনলে সন্তান হিসেবে বেশি কিছু বলা যায় না। কিন্তু বাবা-মার অবর্তমানে সেই জমি বণ্টনের সময় প্রবাসীর ভাগ্যে অতিরিক্ত কিছুই জোটে না সমভাবে তা ভাইবোনের মাঝে বণ্টন হয়। আবার প্রবাসীরা সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারে না বলে তাদেরই পাঠানো টাকায় কেনা আংশিক বা সম্পূর্ণ জমি নিজের নামে করে নেয় কোনো কোনো নিকটাত্মীয়। প্রবাসীরা যখন তা টের পায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় বাবা-মা-স্ত্রীর আবেগের কাছে নতিস্বীকার করে প্রবাসীরা কোনো প্রতিকার করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে একটি অতিপরিচিত কথা হলো ‘খেলে তো তোর ভাই-ই খেয়েছে; থাক, তুই আর কিছু বলিস না। আল্লাহ তোকে আরও দেবেন।’ আর প্রবাসী ভুক্তভোগী ভাবেন, ‘আল্লাহ তো দেবেন, কিন্তু প্রবাসে কত কষ্টের বিনিময়ে যে দেবেন, তা যদি কেউ বুঝত।’ অন্যদিকে ব্যবসার জন্য টাকা নিয়ে সেই ব্যবসা লাটে উঠিয়ে লাপাত্তা হওয়ার ঘটনাও কম নয়। একজন প্রবীণ প্রবাসীর মতে, শালা আর বোনজামাইকে কোনো কারণে টাকা দিলে তা ফেরত আনার চেষ্টা না করাই শ্রেয়। এতে টাকার সঙ্গে পরিবারের সুখ আর আত্মীয়তার বন্ধনÑ দুটোই নষ্ট হয়। শালা আর বোনজামাই টাকা নিয়ে ফেরত দেন নাÑ এটা যেন প্রবাসীদের জীবনে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

সামাজিক জীবনেও ভালো থাকতে পারেন না প্রবাসীরা। প্রায় পরিবারেই প্রবাসীর বাবা-মা ভাবেন বিদেশে সন্তান যা উপার্জন করে, তা বুঝি শুধু তার স্ত্রী আর শ্বশুরবাড়িতে ঢেলে দেয়। আবার স্ত্রী ভাবেন সব টাকা বুঝি স্বামীর বাবা-মা, ভাই-বোন ভোগ করছেন। আর স্ত্রী-সন্তানরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এজন্য প্রবাসীদের মনে বিষণœতা লেগেই থাকে। প্রবাসীরা যখন স্ত্রী বা স্বামীকে ছেড়ে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকেন; তখন নানাবিধ সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। একজন প্রবাসীর স্ত্রীর বিরুদ্ধে সহজেই পরকীয়ার অপবাদ দেওয়া যায় এবং যা ঘটে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি রটিয়ে তার স্বামীকে বলা হয়। তবে সত্যি সত্যি পরকীয়ার ঘটনা যে ঘটে না, তাও নয়। আবার প্রবাসীর স্ত্রী কারও সঙ্গে হাসিমুখে কথা না বললে দুর্ব্যবহার, অসামাজিক, নতুন টাকার গরম প্রভৃতি অপবাদ দেওয়া হয়। একশ্রেণির প্রবাসী সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান না থাকায় উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে সর্বস্বান্ত হন। কেউ কেউ মরণব্যাধি এইডসকে সঙ্গে নিয়ে ফেরেন। সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে বাবা-মা উভয়ের স্নেহ ও শাসন অত্যাবশ্যক। অথচ প্রবাসীদের সন্তানরা প্রায় ক্ষেত্রেই বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গ পায় না বলে মানসিক গঠনের দিক থেকে ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত হয়। আবার অনেকেই বিপথগামী বা উচ্ছৃঙ্খল হয়। এসব সন্তান বেশি টাকা খরচ করতে পারে বলে তাদের কেন্দ্র করে বিভিন্ন ক্লাব, সমিতি বা সংগঠন গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে প্রবাসীদের সন্তানদের লেখাপড়ায় বাধাসহ নানাবিধ জটিলতায় ফেলে। প্রবাসীর সন্তানদের মাঝে পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জনের স্থলে বাবা-মার অর্থে সহজে সাফল্যলাভের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাবা-মা প্রবাসে যে পরিশ্রম করে সন্তানদের ভরণপোষণের অর্থ জোগাড় করেন, প্রবাসীর সন্তানরা তা অনেক ক্ষেত্রেই অনুধাবন করে না। এমনকি ১৮ বছর অতিক্রমের পর তাদের যখন প্রবাসে নেওয়া হয় এবং কাজ করতে বলা হয়, তখন তারা সেই কষ্টের জীবন মানতে পারে না। কারণ দেশে প্রবাস থেকে আসা টাকায় সে বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

সামাজিক নানা অপরাধ ও অনাচারের ভুক্তভোগী হন প্রবাসীরা। অসুস্থতার সময় অনাবশ্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ ও হাসপাতালের বিশেষ কেবিন বা ওয়ার্ডে ভর্তি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ নতুন নয়। রোগী যদি প্রবাসী কিংবা প্রবাসীর নিকটাত্মীয় হয়, তবে সে ভোগান্তি চরমে ওঠে। সন্তান বা নিকটাত্মীয়কে স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় মোটা অঙ্কের চাঁদা বা ডোনেশন দাবি করা হয় প্রবাসীদের কাছে। ডাকাতি বা কিডন্যাপের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ওপরে থাকেন প্রবাসী বা প্রবাসীর নিকটাত্মীয়। একজন প্রবাসীর কন্যা বা ছোটবোন বিয়ে দিতে গেলে বরপক্ষের যৌতুকের দাবি পারদের মতো ওপরে উঠতে থাকে। এমনকি পাত্রকে সম্পূর্ণ খরচ দিয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়া ও চাকরি বা ব্যবসার ব্যবস্থা করে দিতে হয়। মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রবাসীদের মূল্যায়ন হয় না। চলচ্চিত্র বা নাটকে প্রায়ই প্রবাসীদের ভাঁড় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তাদের অদ্ভুত পোশাকে কখনো হেলিকপ্টার কখনো বা হাতির পিঠে চড়ানো হয়। অদ্ভুত উচ্চারণে আরবি কথা বলে দর্শকদের আনন্দ দেওয়াই যেন প্রবাসীর কাজ। প্রবাসীদের সংবেদনশীল জীবন নিয়ে প্রচার গুরুত্ব পায় না অধিকাংশ মিডিয়ায়। তবে টাকার বিনিময়ে প্রবাসীদের সাধারণ সভা-সমিতির খবর বা প্রবাসীদের তথাকথিত সাফল্যের প্রচার কিছু কিছু মিডিয়ার নতুন ব্যবসা কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে যখন মধ্যরাত আর মধ্যপ্রাচ্যে যখন সন্ধ্যা, তখন নামসর্বস্ব কিছু টিভি চ্যানেলে জ্যোতিষ সম্রাট, শিশু ফকির, মঘা ঠাকুর, দরবেশ বাবা, দয়াময়ী মা, জিনের বাদশাহ প্রভৃতি নামে ভ- প্রতারক চক্র বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এসব ফকির-দরবেশ-মা-বাবা-জিনেরা আকাশে ওড়ে, পানি বা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে প্রবাসে যেতে পারে এবং প্রবাসীর স্পন্সর বা কফিলকে বাধ্য করে সব সমস্যা সমাধান এমনকি উচ্চবেতনে চাকরি, ভিসা পরিবর্তন, গ্রিনকার্ড প্রদান করতে পারে বলে প্রচার করা হয়। স্বামী বা স্ত্রীকে পরকীয়ামুক্ত করা, অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করা, লটারিতে টাকা পাওয়া, ঋণ থেকে মুক্তি, বিয়ের পথে বাধা দূর, মনের মানুষকে কাছে পাওয়া, কফিলকে বশ করার মতো প্রবাসীদের প্রাত্যহিক সমস্যার সব সমাধান করার কথা বলে তারা প্রচার চালায়। এরপর টাকা হাতিয়ে নিয়ে তারা প্রবাসীদের টেলিফোন নম্বর ব্লক করাসহ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। ইউটিউবে প্রবাসীদের স্ত্রীর নাম বা পরিচয় ব্যবহার করে রমরমা ভিডিও ক্লিপ ছাড়া হয়, যা আবার অসংখ্য লাইক বা কমেন্টস পায়। উঠতি বয়সের তথাকথিত মডেল বা অভিনেত্রী বলে দাবি করা একশ্রেণির মেয়ে ইউটিউব ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ্যে টেলিফোন নম্বর বিতরণ করে প্রবাসীদের আমন্ত্রণ জানায় বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্য। এ টাকার বিনিময়ে প্রবাসীদের সঙ্গে ভিডিও-মাধ্যমে বা সরাসরি যোগাযোগ রাখার এবং প্রবাসীদের যে কোনো আবদার মেটানোর কথা বললেও টাকা পাওয়ামাত্র তারা নম্বর ব্লক করে দেয় এবং লাপাত্তা হয়ে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কেউ কেউ আবার এটিকে দেহব্যবসার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে প্রবাসীদের সর্বস্বান্ত করে।

প্রবাসীদের একটি অন্যতম সমস্যা হলো স্পন্সর বা কফিল পরিবর্তন করতে না পারা। মধ্যপ্রাচ্যে সব সময় প্রতিটি প্রবাসীকে একজন স্থানীয় স্পন্সর বা কফিলের অধীনে থাকতে হয়। বছরের পর বছর কাজ করার পরও কফিলের লিখিত অনুমতি (এনওসি) না পেলে সে অন্য কোথাও কাজ করতে পারে না। দেশে ফিরে এলেও দুই বছরের মধ্যে আবার যেতে চাইলেও আগের কফিলের লিখিত অনুমোদন নিতে হয়। এই অনুমোদন বা এনওসির জন্য আবার অনেক টাকা লেনদেন হয়। একজন শ্রমিক হয়তো প্রথম অবস্থায় অদক্ষ থাকেন। পরে কাজের মাধ্যমে তার দক্ষতা বাড়ে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পর শ্রমবাজারে তার চাহিদা বেড়ে যায়। কফিলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে তার বেতন বৃদ্ধি বা অন্য কোথাও যোগদান। মানবাধিকারের এই চরম লঙ্ঘনকে মেনে নিতে হয় প্রবাসী শ্রমিকদের। আর মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে এক প্রকার নীরবতা পালন করে। তাই অত্যাচারিত হলেও একজন ক্রীতদাসের মতোই কফিলের কথা শুনতে হয় শ্রমিকদের। আইন-আদালত কাগজে-কলমে থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হয় না।

বিদেশের মাটিতে মরেও যেন শান্তি নেই প্রবাসীদের। হৃদরোগ ও দুর্ঘটনা, বিশেষত সড়ক দুর্ঘটনা প্রবাসীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আবার অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়। ২৭ মে, ২০১৯-এর একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, ২০০৫ সাল থেকে ৩৮ হাজার ৪৭৩ জন প্রবাসীর মৃতদেহ দেশে এসেছে। পত্রিকার মতে শুধু ২০১৮ সালেই সৌদি আরব থেকে ১ হাজার ১১৩টি মৃতদেহ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালে বিদেশের মাটিতে ৩ হাজার ৪৮০ জন প্রবাসীর মৃত্যুর খবর ছাপে ২০ জানুয়ারি, ২০১৮-এর আরেকটি ইংরেজি পত্রিকা। মৃত্যুর পর সাধারণত প্রবাসীদের মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য তার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের মতামতের ভিত্তিতে মৃতদেহ প্রবাসে দাফন করা হয় অথবা বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে নানাবিধ আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদন, ডকুমেন্ট তৈরি এবং বিমানে স্থানসংকুলানজনিত সমস্যার কারণে দীর্ঘ সময় লাগে। সৌদি আরব থেকে একটি মৃতদেহ দেশে আনতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই মাসও অপেক্ষা করতে হয়। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মর্গে শত শত বাংলাদেশির মৃতদেহ রাখা থাকে দিনের পর দিন। আর মৃত ব্যক্তির যদি পাসপোর্ট পাওয়া না যায় বা অবৈধ বলে প্রমাণিত হয় তবে জটিলতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী কিনা এবং এ ক্ষেত্রে বীমার টাকা প্রাপ্য কিনা তা নির্ধারণেও জটিলতা চলতে থাকে। তবে মূল জটিলতা বিমানে সময়মতো স্থানসংকুলান। বাংলাদেশগামী সব বিমান লাশ পরিবহন করে না। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিনামূল্যেও লাশ পরিবহন করে, তবে একসঙ্গে বেশি নয়। দেশে লাশ পাঠানোর আগে মৃতদেহে কিছু ওষুধ ও রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা হয় এবং বিশেষ কায়দায় কফিনে মৃতদেহ রাখা হয়। এ খরচ প্রায় ক্ষেত্রে প্রবাসী সংগঠনগুলো বহন করে। দেশে মৃতদেহ সৎকারের জন্য এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার টাকা দেয়। আর বিদেশ থেকেও বীমা বা ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া যায় বৈধ ক্ষেত্রে। তবে মূল সমস্যা দেখা দেয় উত্তরাধিকার নির্ধারণ নিয়ে। এ টাকার শতভাগ একদিকে দাবি করেন স্ত্রীপক্ষ আর অন্যদিকে মৃত ব্যক্তির বাবা-মা-ভাই-বোন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা একে অন্যের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না। স্ত্রীপক্ষ ভাবে অন্য পক্ষ টাকা পেলে তাদের ভাগ্যে কিছু জুটবে না। আর বাবা-মা-ভাই-বোন ভাবেন দুই দিন আগে বা পরেÑ স্ত্রী হয়তো আবারও বিয়ে করে অন্যের ঘর করবে। তখন এই টাকার সুবিধা নেবে তার নতুন স্বামী। এমন দ্বন্দ্বের মাঝেই মৃতদেহের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় প্রবাসীদের নিকটাত্মীয়ের। তাই বলা হয়, মরেও শান্তি পান না প্রবাসীরা।

 

                লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর