শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জাতে কালো, চাল ভালো

শাইখ সিরাজ

জাতে কালো, চাল ভালো

রবিঠাকুর ‘ক্ষণিকা’য় লিখেছেন, ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’ কালোর প্রতি সাধারণত মানুষের এক ধরনের অনীহা থাকে। আর তাই কবি-লেখকরা কালোর মহত্ত্বকে তুলে ধরতে গান-কবিতা লিখেছেন।

‘কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,

কালো দাতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি।’

নকশিকাঁথার মাঠ/জসীমউদ্দীন

পাঠক! ‘কালো’ নিয়ে এত কথা বলছি, কারণ আজ আপনাদের কালো জাতের চালের গল্প বলব। কবি জসীমউদ্দীনের কবিতাতেই যদি ফিরে যাই-

‘যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও!

সেই কালোতে সিনান্ করি উজল তাহার গাও।’

এর মানে কালো জাতের ধান বরাবরই কৃষকের কাছে ভালো। কালো ধান আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কালামানিক, কালিমুগা, কালাবিন্নি, কালি আমন, কাজলা, কালোজিরা, কাজলশাইল, কালা বালাম প্রভৃতি নামের প্রায় ৯০টির মতো জাতের কালো ধান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট চিহ্নিত করেছে। সিলেটের হাওরাঞ্চলে কালো জাতের যে কত ধরনের বিন্নিধান আছে! সেসব ধানের কোনো কোনোটির ভাত আঠালো। পেটে থাকে অনেকক্ষণ। তাই দরিদ্র কৃষক মাঠে কাজে যাওয়ার আগে সকালে সেই ভাত খেয়ে যেত, দুপুরে কিছু না খেলেও ক্ষুধা লাগত না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবার রাতে খেলেই হয়। তবে এসব জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল ঠিক কালো ছিল না। হয়তো কোনো কোনো জাতের ধানের তুষগুলো কালো হলেও ভিতরের চালটা সাদা কিংবা কালচে লাল রঙের হলেও ভাত সাদাই হতো। আমাদের চট্টগ্রামের দিকে পোড়াবিন্নি নামের এক ধরনের কালো চাল পাওয়া যায়। পাহাড়িদের কাছেই সেই চালের কদর ছিল।

চীনে দেখেছি রেস্তোরাঁগুলোয় কালো চালের স্যুপ খুব জনপ্রিয়। জনশ্রুতি আছেÑ কালো চালকে বলা হতো ফরবিডেন রাইস বা নিষিদ্ধ চাল। পাহাড়ের উপত্যকায় রাজাদের জন্য এ চাল গোপনে চাষ করা হতো। তারা ধারণা করত, এ চালে আছে অন্যরকম জীবনীশক্তি যা তাদের বহু বছর বেঁচে থাকার রসদ জোগাত। বর্তমানেও কালো চালের প্রতি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এর কারণ, কালো চালে অ্যান্থসায়ানিন বেশি থাকে। এটি আসলে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদার্থের মধ্যে আমিষ, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ কালো চালে সাধারণ চাল থেকে অনেক বেশি। নেটে ঘেঁটে জানতে পারলাম, বিশ্বে কালো চালসমৃদ্ধ ২০০ ধানের জাত আছে। এর মধ্যে চীনের হাতেই আছে ৬০ শতাংশের বেশি। চীন ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও ফিলিপিন্সে এ ধরনের ধান আবাদে চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের আবাদি খেতও পাল্টে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিটি আবাদি খেতই সেজে উঠছে নতুন ছন্দে। পাল্টে যাচ্ছে রং ও রূপ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ দেশের কোনো কোনো কৃষকের গবেষণাও কৃষিতে সাফল্য নিয়ে আসছে। আপনাদের নিশ্চয়ই ঝিনাইদহের হরিপদ কাপালির কথা মনে আছে, যিনি উচ্চফলনশীল হরি ধান আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হরিপদ কাপালির মতোই আর এক খেপাটে কৃষক মনজুর হোসেন। কুমিল্লা সদরের মনাগ্রামের তেতুইয়ারা গ্রামের এই কৃষক গত কয়েক বছর ধরে লেগে আছেন ব্যতিক্রমী ধানের পেছনে। কালো ধান নিয়ে তাঁর সাফল্যের চিত্র দেখতে হেমন্তের এক সকালে উপস্থিত হলাম তাঁর গ্রামে।

কৃষি অধিদফতরের ড. মেহেদী মাসুদের কাছ থেকে ২৭টি বীজ দিয়ে শুরু করলেন কালো চাল উৎপাদনের মিশন। কয়েক বছরে কালো চালের ধান চাষ করে আশপাশের কৃষকদের তাক লাগিয়ে দিলেন। জানালেন, প্রতি হেক্টরে গড়ে সাড়ে ৫ টন ধান উৎপাদন হয়। কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক বিষয়গুলো সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন মনজুর। আগেভাগেই ভাবেন বাজারের কথা। তাই মাঠে মাঠে আবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি এর বাজারও নিশ্চিত করেছেন তিনি। কারণ ইতিমধ্যে ইন্টারনেটে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছেন ব্ল্যাক রাইসের বহুমুখী উপকারিতার কথা। তিনি জানালেন, প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁড়ানো চালের তুলনায় কালো চালের ভাতে আমিষের পরিমাণ প্রায় ৮.৫ গ্রাম বেশি। ভাতে জিংকের পরিমাণও বেশি। ভিটামিন ‘ই’-সমৃদ্ধ কালো চাল আমাদের চোখ, ত্বক ও দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। কালো চালের ভাত শরীরের বিষাক্ত বর্জ্য ও লিভারের ক্ষতিকারক পদার্থগুলো দূর করে দিতে সক্ষম। কালো চাল শরীরে বিদ্যমান শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক; যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই জরুরি। ইতিমধ্যেই কুমিল্লার তেতুইয়ারা এলাকার কৃষক কালো ধান সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করেছেন। তাদের চোখেমুখে নতুন এক স্বপ্ন এনেছে এই কালো ধান। মনজুর স্থানীয় অন্য কৃষকদের এ ধান চাষে আগ্রহী করে তোলেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। কৃষক আনোয়ার হোসেন, বিল্লাল হোসেনও আবাদ করেছেন এ ধান। সব মিলিয়ে কৃষক মনজুর আবাদ করেছেন সাত জাতের কালো ধান। এর মধ্যে কোনো জাতের ধান অনেক বেশি কালো, কোনোটি লাল রঙের, কোনোটি কালচে লাল। আমন মৌসুমের ফসল উঠতে না উঠতেই মনাগ্রামে শুরু হয়ে গেছে বোরো মৌসুমে কালো ধান আবাদের প্রস্তুতি। মনজুরের নিজস্ব খেতে চলছে বোরো মৌসুমের তিন জাতের কালো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ। মনজুরের খামারবাড়ি-সংলগ্ন মনাগ্রাম প্রাইমারি স্কুলের আঙিনায় নবান্নের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে কালো ধান মাড়াই ও অন্য কাজগুলো ঘিরে। সাধারণ কৃষকের হিসাব হলো, ধানের সর্বোচ্চ মূল্য অর্থাৎ মণপ্রতি ২ হাজার টাকা পেতে যাচ্ছেন তারা। আমনে সাধারণ ধানের সরকার-নির্ধারিত মূল্য ২৬ টাকা কেজি অর্থাৎ ১ হাজার ৪০ টাকা মণ। এ হিসাবে কৃষকের ধানের গুণাগুণের চেয়ে মূল্যটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি সম্ভব করেছেন কৃষক মনজুর। তিনি বললেন, ইতিমধ্যে সুপারশপের সঙ্গে তার চুক্তি হয়েছে। কথা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও। আগেই বলেছি, কৃষক মনজুর অন্য কৃষকের চেয়ে আলাদা। তিনি শুধু ফসল আবাদ ও বাজারজাত নিয়ে ভাবেন না। এ কাজগুলোর আরও গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন কালো চাল থেকে কী কী হতে পারে তা তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন নিজের খামারবাড়িতেই।

যারা স্বাস্থ্য ও পুষ্টির নানা বিষয় খোঁজখবর করেন তারা জেনে থাকবেন, বিশ^ব্যাপীই এখন কালো চালের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় পুষ্টির কথা চিন্তা করে। আমাদের ঢাকার বাজারেও বড় বড় গ্রোসারিতে পাওয়া যাচ্ছে জাপান ও চীন থেকে আনা ব্ল্যাক রাইস। যেগুলো বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা কেজি পর্যন্ত। ব্ল্যাক রাইসের রেসিপি ও পুষ্টিকর উপায়ে খাদ্য উপকরণ তৈরির প্রক্রিয়াও প্রদর্শন করেন বিভিন্ন দেশের পুষ্টিবিদরা। কালো চালের বহুমুখী উপকারিতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ময়নামতি মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ড. ত্রিপতিশ চন্দ্র ঘোষ। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বলেন, তিনি নিজেই এই চালের নিয়মিত ভোক্তা। কালো চালে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যান্সার প্রতিরোধী ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া হৃদরোগের সুস্থতা বজায় রাখা, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ানো ও শারীরিক ব্যথা নিরাময়ে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিশেষ কার্যকর। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন আমাদের জন্য অনেক বড় এক অর্জন। এখন বিশ^ব্যাপী ভাবা হচ্ছে পুষ্টি নিরাপত্তা নিয়ে। শুধু নিয়মিত খাদ্য গ্রহণই শেষ কথা নয়, সেই খাদ্যের সঙ্গে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী কতটুকু পুষ্টিকর উপাদান আমরা গ্রহণ করছি তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের চাহিদা বুঝে শিক্ষিত ও সচেতন কৃষক উদ্যোগ নিচ্ছেন কৃষি উৎপাদনেও পুষ্টির বিষয়টি আগে গুরুত্ব দেওয়ার। এ ক্ষেত্রেই বড় এক চমক দেখিয়েছেন কুমিল্লার মনাগ্রামের কৃষক মনজুর হোসেন। মনজুরের স্বপ্নÑ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ুক পুষ্টিকর কালো চালের ধান। তাহলে আমাদের আর আকাশছোঁয়া দামে কিনতে হবে না কালো চাল। সাধ্যের মধ্যেই নিশ্চিত করা যাবে পুষ্টি চাহিদার অনেকটা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর