শিরোনাম
শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মহৎ মানবিক গুণ ধৈর্যশীলতা

আবদুর রশিদ

মহৎ মানবিক গুণ ধৈর্যশীলতা

সবর বা ধৈর্যশীলতা একটি মহৎ মানবিক গুণ। এ গুণ অর্জনের মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেকে মানসিক ও আত্মিকভাবে এমন শক্তিশালী করতে সক্ষম হয় যে, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ধীরস্থিরভাবে নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। ফলে ভুল সিদ্ধান্ত এড়ানো তার পক্ষে সহজ হয়। ধৈর্যশীলতার গুণকে কেউ ধারণ করতে পারলে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে অবিচল থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তৎক্ষণাৎ বা হঠাৎ করে কোনো কিছু অর্জনের মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হয়। ধৈর্যশীলতার গুণ ধারণ করা হলে বিপদের মুখেও নিজেকে স্থির রাখা সম্ভব হয়। এ গুণ কোনো মানুষের পক্ষে অর্জন করা সহজ নয়। তাই মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ এই মহৎ গুণ অর্জনে আল কোরআনের সূরা বাকারার ২৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ইসলাম তার অনুসারীদের ধৈর্যশীল হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘তিনি ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ-শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় ধৈর্যশীলতার কোনো বিকল্প নেই। ধৈর্যশীলতার ব্যত্যয় নানা বিপর্যয়ের উদ্ভব ঘটায়।

সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং আমি তোমাদের ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্য পরীক্ষা করব। তুমি (হে রসুল) শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।’ ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে দুশমনদের ব্যাপক অপপ্রচারে নতুন দীক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমানদের মন বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছিল। এই সংকটকালে তাদেরকে সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে প্রার্থনা করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ এর পরপরই ১৫৪ আয়াতে বলা হয়, ‘আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদের মৃত বোলো না, তারা জীবিত কিন্তু  তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।’ আগে উল্লিখিত ১৫৫ নম্বর আয়াতে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে  ধৈর্যশীলদের জন্য শুভ সংবাদ দেওয়া হয়েছে। বস্তুত এর চেয়ে বড় শুভ সংবাদ কী হতে পারে যে আল্লাহ স্বয়ং ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। আরবি ‘সবর’ শব্দের বহুমাত্রিক অর্থ ও তাৎপর্য রয়েছে। সবরের ব্যবহারিক অর্থ হতে পারে ১. ধীরস্থিরতা অবলম্বন, তাড়াহুড়া না করা ২, অব্যাহত অধ্যবসায়, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, দৃঢ়তা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে অবিচল থাকা ৩. তৎক্ষণাৎ কিংবা হঠাৎ কোনো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা না করা ৪. বিপদে-আপদে পরাজয় কিংবা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতেও বিপদ ও বিসংবাদকে ঠা-া মাথায় সহজে ও সানন্দে গ্রহণ করা অর্থাৎ ওইসব পরিস্থিতিতে শোকাভিভূত কিংবা ক্রোধান্বিত কিংবা হঠকারী না হওয়া। বলাবাহুল্য, ‘সবর’ মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতর এবং এর মানসিক ও আত্মিক তাৎপর্য অপরিসীম।

ভয়, ক্ষুধা, ধন-মালের, ফলফসলের ক্ষয়ক্ষতি নানান দুর্ঘটনা-উদ্ভূত বলে প্রতীয়মান হয়। সন্দেহ নেই এতে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে ব্যক্তি তথা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে কোনো সময় নানান দুর্ভোগ ও দুর্বিপাক হতে পারে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, প্লাবন ইত্যাদি যখন গোটা সমাজের ওপর দুর্দশা ও বিপদ নিয়ে আসে তখন সমাজ তথা সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তা ধৈর্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করা উচিত। ধীরস্থিরভাবে যে কোনো বিপদ অতিক্রম করার লক্ষ্যে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি ও সমষ্টিকে ধৈর্য ও সালাতের শক্তি ও সাহায্য নিতে হয়। একই সঙ্গে ইমানের ওপর দৃঢ় আস্থা রেখে ধৈর্যধারণে অবিচল থাকার জন্য পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হয়। সূরা আসরে স্পষ্টতই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ বিপদে অন্যের সহযোগিতার বিষয়টিও এখানে বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিপদগ্রস্ত সমাজের সবাই ধৈর্যধারণেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকবে না পরস্পর সহযোগিতা অর্থাৎ বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বৈষয়িক সাহায্যে এগিয়ে আসাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং পারস্পরিক সাহায্য আদান-প্রদানে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে উক্ত প্রয়াসে উপযোগী নেতৃত্বদান ও সফল কর্ম সম্পাদনে সহায়তা করা বাঞ্ছনীয়। এরূপ ভূমিকা পালনে কোনো বিপর্যয়ই সমাজকে কাবু করতে পারে না। ধৈর্যধারণের মাধ্যমে বিপদ মোকাবিলার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর অপার সন্তুষ্টি ও সমর্থন। সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতের এ অংশটি এখানে প্রণিধানযোগ্যÑ ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোয় কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে অর্থ সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রামে সংকটে ধৈর্যধারণ করলে।’ আল্লাহ আমাদের সবাইকে ধৈর্যশীল হওয়ার তৌফিক দিন।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর