রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

একাত্তরে রাও ফরমানের মুখোমুখি আমরা দুই গেরিলা

ধর্মদর্শী বড়ুয়া

একাত্তরে রাও ফরমানের মুখোমুখি আমরা দুই গেরিলা

বাঁয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ধর্মদর্শী বড়ুয়া, ক্র্যাক প্লাটুনের কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রুহিম দুলাল

রোমাঞ্চকর তো বটেই, ভয়ানকই বলা চলে সেই অভিজ্ঞতা। হাজার বছরেও এমনটা ঘটে না কোনো জাতির জীবনে, যা ঘটেছিল একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে। সেসব মনে পড়লে আজও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই, একই সঙ্গে আনন্দে আর আতঙ্কে শিহরিত হই- সে এক মিশ্র অনুভূতি, প্রবলভাবে ভালোলাগার, মাতৃভূমিকে ভালোবেসে অসম্ভব কিছু অর্জনের। মাঝে মাঝে একা একা ভাবী- এত সাহস, এত বরাভয় আমাদের অন্তরে ছিল কীভাবে!

একাত্তরে ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে সফলতা এসেছিল, দেশ-বিদেশের প্রচারমাধ্যমে কিছু ঘটনার প্রচারও বেশ হয়েছিল। হাবিবুল আলমের দিলু রোডের বাড়িতে, চুলু ভাইয়ের বাড়িতে (টেনামেন্ট হাউস/রমনা), সংগীতশিল্পী-পরিচালক আলতাফ মাহমুদের রাজারবাগের বাড়িতে প্রচুর রাইফেল, স্টেনগান, এক্সপ্লোসিভ, গুলি প্রভৃতি রাখা হয়েছিল। কয়েকটি বড় অপারেশনের পর রুমি, আজাদ, হাফিজ, সামাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদসহ ঢাকার আরবান-গেরিলাদের আরও অনেকে ধরা পড়ে গেলেন দখলদার পাক-সেনাদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র হানাদার সেনারা পেয়ে গেল। তখনকার মতো ঢাকা শহরের গেরিলা তৎপরতা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলেন সেক্টর-২ কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও তার অধীন সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) এ টি এম হায়দার। আমরা গেরিলারা একটু নীরব হতে বাধ্য হলাম।।

কিছুদিন পর আবার নতুন অপারেশন পরিকল্পনা, আমরা ঢাকা শহরে ফিরে এলাম। কিন্তু পরিস্থিতি তখনো প্রতিকূলেই। এখানে তখন লাগাতার কারফিউ বলবৎ হয় যখন তখন। কারফিউ মানে রাস্তায়, বাড়ির ছাদে বা জানালায় অবধি কাউকে দেখা গেলেই গুলির নির্দেশ ছিল। রাস্তায় চলাচল শুধু সামরিক বাহিনীর গাড়ি, পুলিশের গাড়ি দু-একটি, দু-একটি হাসপাতাল-রোগী-অ্যাম্বুলেন্স, আর কিছু কারফিউ পাস পাওয়া সরকারি গাড়ি, তার ফলে সারাক্ষণ সারা রাস্তা খাঁখাঁ করছে। তখন গেরিলা অপারেশন অকল্পনীয় ব্যাপার। আমরা সরাসরি অপারেশনের বদলে অন্য কৌশলের পরিকল্পনা আঁটলাম, টার্গেট নির্ধারণ করলাম গভর্নর হাউসকে (বর্তমান বঙ্গভবন)। কুখ্যাত জেনারেল রাও ফরমান আলীর দফতর সেখানে, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও অন্যসব বাঙালি নিধনযজ্ঞ পরিচালনার কুখ্যাত সব অপারেশনের সদর দফতরও সেটা। আমরা সেখানে আঘাত করা যায় কিনা তা নিয়ে প্রাপ্ত-তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। সেই লক্ষ্যে একটা পরিকল্পনা ছিল গভর্নর হাউসের দেয়ালসংলগ্ন পেট্রল পাম্পে (হাটখোলা পেট্রল পাম্প ) বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গভর্নর হাউসের সবাইকে সন্ত্রস্ত করে দেওয়া। বোমা পোঁতা হয়েছিল, কিন্তু কিছু ভুল অপারেটিংয়ের জন্য তা বিস্ফোরিত হয়নি। আশপাশের এলাকা থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে গভর্নর হাউসটি আক্রমণ করা যায় কিনা তারও একটা চেষ্টা চলল। তার আগে গভর্নর হাউসের মধ্যে জেনারেল ফরমানের কক্ষের প্রকৃত অবস্থান জানা দরকার।

নিমতলীর বিখ্যাত এক্স-রে চেম্বারের ডা. সফিউল্লাহর পুত্র নেয়ামতউল্লাহ সাবু দুলাল-মোহনদের আত্মীয়। সে তখন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি)-এর ছাত্র ফ্রন্টের সুপরিচিত নেতা। পিডিপি একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের দালাল পার্টি। সাবু চকবাজারে দুলালদের বাসায় ৩০/৩১ হেকিম হাবিবুর রহমান রোডে প্রায়ই আসত। সে একটু আড্ডাপ্রিয় মানুষও বটে। সাবু একদিন এসেই বলে উঠল, ‘তোমরা তো বেশ ভালো আসর জমিয়েছ’। আমাদের হৃৎকম্প শুরু হয়ে গেল সাবুর কথায়। তবু সহজভাবে কথা বলতে লাগলাম যাতে সাবুর সন্দেহের বাইরে থেকে তার কিছু-একটা সহায়তা নিয়ে আমাদের কাজে এগোনো যায়। আমরা ‘খেজুরে আলাপ’ মার্কা সস্তা কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা চালালাম। খানিকটা হাস্য-মশকরার পরিবেশ তৈরির চেষ্টাও চলল। সাবুর কাছে ভাব ধরলাম- ‘আমরা ছাত্র রাজনীতিতে যা-ই করি না কেন, আমাদের বাপ-ভাই-মুরব্বিরা পাকিস্তান আন্দোলন করে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াই কেমনে!’ চোখমুখ দেখে মনে হলো সাবু আমাদের তেমন একটা সন্দেহের চোখে দেখছে না। সেই সুযোগে কেউ একজন সাবুকে একটা অনুরোধ করে বসলেন, ‘ঢাকা শহরে তো এখন চলাফেরাই মুশকিল, দেখুন তো দু-একটা পাসের (নিরাপদ চলাচল পাস রাষ্ট্রের দেশপ্রেমিক নাগরিক পরিচয়ে) ব্যবস্থা করা যায় কিনা’। নেয়ামতউল্লাহ সাবু বললেন, ‘দেখি, কী করা যায়। কয়েকদিন পর তিনি ফের আমাদের সেই শেল্টারে এসে বললেন, ‘তোমরা মাহমুদ আলী সাবের সঙ্গে দেখা কর। তিনি পাসের ব্যাপারে হেল্প করতে পারেন।’ মাহমুদ আলী একসময়কার প্রগতিশীল আন্দোলনের খ্যাতিমান নেতা, কিন্তু একাত্তরে নূরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী, দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কুখ্যাত দালাল, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গী। সময়টা অক্টোবর। মাহমুদ আলী বসতেন বেইলি রোডসংলগ্ন সড়কের মুখে সার্কিট হাউসে। যাই হোক, সাবুর রেফারেন্সে আমি আর দুলাল (জিল্লুর রহিম দুলাল) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। কিছুটা ভয়ভীতি মনের মধ্যে অবশ্যই ছিল। তবে সাহস রাখলাম, ধরা যদি পড়েই যাই যা কপালে আছে তা হবে। মাহমুদ আলী আমাদের সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী সমস্যা তোমাদের?’ নেয়ামতউল্লাহ সাবু তার দলের ছাত্র ফ্রন্টের সুপরিচিত নেতা, তাই তার রেফারেন্সের গুরুত্ব আছে নিঃসন্দেহে। আমরা উত্তর দিলাম কৌশলী ভাষায়, ‘সমস্যাটা তো আমাদের ব্যক্তিগত নয়, সমস্যা রাষ্ট্রের। পাকিস্তানে আর্মির অপারেশনে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে দলে দলে বৌদ্ধরা সীমান্ত অতিক্রম করে বার্মায় চলে যাচ্ছে। বিশ্ব মিডিয়া এ খবরগুলো ফলাও করে প্রচার করছে। এতে পাকিস্তান সরকারের ভাবমূর্তির বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে।’ ভ্রু কুঁচকে গেল মাহমুদ আলীর, বললেন, ‘হ্যাঁ, বুড্ডিস্টরা চলে যাচ্ছে, তা তো সবাই জানি; কিন্তু তোমাদের উদ্দেশ্যটা কী?’ আমরা বললাম, ‘আমরা ওদের ফিরিয়ে আনব; ছাত্রনেতা হিসেবে আমার পরিচিতি আছে, আর আমি নিজেও বৌদ্ধ; তাই ওরা আমার কথা শুনবে।’ ‘ঠিক আছে, তাহলে তা-ই কর’- বললেন মাহমুদ আলী। উত্তরে আমরা বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘কিন্তু মার্শাল লর প্রবল বিধিনিষেধ, কারফিউ থাকে যখন তখন, আমরা এসবের ভিতরে কক্সবাজারের দিকে যাব কীভাবে? আপনি একটু হেল্প করলে সুবিধা হয়। দয়া করে আপনি দুটো পাসের ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হতো।’ এর পরও দুচার কথা জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। আমরা সতর্কতার সঙ্গে উত্তর দিলাম। তারপর আমাদের অপেক্ষমাণ রেখে তিনি একটু দূরে গিয়ে নিজে টেলিফোন ডায়াল করলেন, উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে কার সঙ্গে যেন কী কী কথা বললেন। টেলিফোন শেষে আমাদের ইশারায় কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আগামীকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় গভর্নর হাউসে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে তোমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, ঠিক সময় চলে যেও।’ তিনি তার পিএকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে একটা চিঠিতে স্বাক্ষর করে তা আমাদের দিলেন এবং জেনারেলকে দিতে বললেন। তখন থেকে বুকের ভিতরে দুরু দুরু একটা শঙ্কা, কৌতূহল, ভয় ইত্যাদি মিলে এক মিশ্র-অনুভূতি যা একেবারেই অচেনা-অজানা। একটাই ভাবনা- রাও ফরমান আলী গভর্নর হাউসের কোথায় বসেন তা ভালোভাবে নিরূপণ করা, ‘চলাচল-পাস’-এর ব্যাপারটা তো একটা ছুতো মাত্র। আর যদি তা পাওয়া যায়, তাহলে তো সেটা একটা বাড়তি অর্জন।

মাথার ভিতরে প্রচন্ড টেনশন, কোনোভাবে যদি ধরা পড়ে যাই, তাহলে তো নিশ্চিত ওই জল্লাদখাঁচা থেকে কেউ উদ্ধার করে আনতে পারবে না, নির্ঘাত বেজায়-নির্যাতন, তার পরে বেয়নেটে বা গুলিতে হত্যা। আমরা সারাটা বিকাল প্রস্তুতি নিতে লাগলাম, আমাদের জুতো পালিশ করানো হলো, দুটো ইউনিয়ন শার্ট কিনলাম দুজনের জন্য। প্রতিটি শার্টের দাম ছিল ৩৫ টাকা করে। এটা সে সময়ের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল শার্ট। বাসায় ফিরে খালাম্মাকে (দুলালের মাকে) পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। ক্র্যাক প্লাটুন কমান্ডার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আমাকে আর দুলালকে বারবার ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলেন গভর্নর হাউসের ভিতরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর অবস্থান, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সব পর্যবেক্ষণ করে অবশ্যই তার একটা সুন্দর নকশা মাথার ভিতরে ধারণ করে যেন নিয়ে আসি আমরা।

পরদিন দুপুর ১২টার দিকে মনের ভিতরে এক অজানা আতঙ্ক আর রোমাঞ্চ নিয়ে আমি আর দুলাল রওনা হলাম গভর্নর হাউসের উদ্দেশে। গুলিস্তান সিনেমা হল ভবনের নিচতলায় একটা বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ছিল ‘সুইট হ্যাভেন’। এটা ছিল অভিজাত লোকজনের আড্ডাস্থল। আমাদের কমান্ডার মায়া ভাই সেখানে আমাদের ফেরার জন্য অপেক্ষা করবেন, কাজে সফল হয়ে ফিরতে হবেÑ তার নির্দেশ। গুলিস্তানের কামানের কাছে রিকশাটা ছেড়ে দিলাম। হৃৎকম্প নিয়েই আমরা গভর্নর হাউসের মূল গেটের দিকে হেঁটে এগোতে লাগলাম। কয়েক গজ পরপরই সশস্ত্র সেনা-সান্ত্রীদের পাহারা। তারা কোনো বাধা দিল না। তখন দুপুর ১২টার একটু বেশি। সান্ত্রীরা ধরেই নিয়েছিল গভর্নর হাউসের দিকে এগোচ্ছে দুই তরুণ, তাদের অবশ্যই বড় কোনো পরিচিতি আছে, পাকিস্তানি দালাল নেতার বা কোনো কর্মকর্তার সন্তান বা ঘনিষ্ঠজন হবেই হবে এরা। অতএব এরা নিরাপদ- সাক্ষাৎপ্রার্থী। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা গেট রিসিপশনে পৌঁছলাম। কর্তব্যরত অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কার কাছে যাবেন?’ আমরা জবাব দিলাম, ‘জেনারেল রাও ফরমান আলী স্যারের কাছে যাব, তার সঙ্গে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমাদের নামে গেটে পাস থাকার কথা। দেখুন তো দয়া করে।’ আমরা পিডিপি নেতা মাহমুদ আলীর রেফারেন্সের কথাও বললাম। অফিসার ব্যস্ত হয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘না, আপনাদের নামে কোনো পাস নেই।’ বুকের ভিতরে একটা ধাক্কা খেলাম যেন, আতঙ্কিত হলাম- তবে কি আমরা কোনো ভাঁওতার মধ্যে পড়ে গেলাম! খানিকটা সাহস করেই বলে ফেললাম, ‘দেন তো, খাতাটায় আমরা একটু চোখ বুলিয়ে দেখি।’ অফিসার খাতাটা এগিয়ে দিলেন, খাতাটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় দেখি- আমাদের নাম দুটো আছে, দুটো পাতার ভাঁজের মধ্যে এক জায়গায়- ধর্মদর্শী বড়ুয়া ও দুলাল।। ভিজিটরস খাতায় নাম এন্ট্রি করার পর চেক করে দুজন আর্মির লোক দিয়ে গভর্নর হাউসের ভিতরে (মূল ভবনে) পাঠানো হলো আমাদের। সেখানে প্রথমে গেস্টরুমে এবং পরে জেনারেল রাও ফরমান আলীর একান্ত সচিবের কক্ষে আমাদের বসিয়ে রাখা হলো- প্রথাগতভাবে অপেক্ষমাণ রাখার নিয়মে। রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি আমার আর দুলালের সারা শরীরে সামান্য জ্বরই উঠে গিয়েছিল যেন, মাথা ঝিমঝিম করছিল। নিজেদের প্রবলভাবে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম আমরা দুজনে। সেখানে আর্মি অফিসার ও নানা ধরনের লোকজনের আসা-যাওয়া, আমাদের জন্য এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। বেশ কিছুক্ষণ পর এক সেনা অফিসার এসে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘বড়ুয়া সাব কোন হ্যায়? আইয়ে মেরে সাথ।’ বুঝলাম, জেনারেলের রুম থেকে ডাক এসেছে। দুরু দুরু বক্ষে দুজন উঠে দাঁড়ালাম। তারপর সেই আর্মি-ম্যানের সঙ্গে এগোতে লাগলাম। কিছুদূর এগিয়েছি, দেখি কালো কুচকুচে পাকানো গোঁফওয়ালা একদল সেনা সদস্য, খাকি ইউনিফর্ম পরা সবাই, প্রত্যেকেরই শার্টের বুক-পকেটের ওপরে অনেক খেতাব-প্রতীক, এমনিতেই কিম্ভূতদর্শন, তার ওপরে তাদের ইউনিফর্ম পরা পোশাকে আরও ভীতিকর মনে হচ্ছিল, ভয়ঙ্করদর্শন হয়ে উঠেছিল আর্মির সেই লোকগুলো। দখলদার সামরিক বাহিনীর দানবই বটে, হিটলার বাহিনীর প্রেতাত্মা যেন একেকটা। এরা হাবিলদার, সুবেদার (ননকমিশন্ড অফিসার) সবাই। জেনারেলের রুমের দরজা খুলতেই ভারি গলার আওয়াজÑ ‘আইয়ে মি, বড়ুয়া, আইয়ে’। দেখলাম বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ও-পাশে চশমা পরা খাকি ইউনিফর্ম পরিহিত জবরদস্ত চেহারার এক আর্মি জেনারেল, মুখে তার সামান্য হাসি লেগে আছে। টেবিলের ওপরে ফাইল স্তূপের পাশেই দুই প্যাকেট দামি সিগারেট। আমরা সামনের চেয়ারে বসলাম। জেনারেল রাও ফরমান আমাদের দুই তরুণের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কক্ষটিতে ঢুকেই আমাদের শরীর-মন আতঙ্কে অস্থির। আমাদের উদ্দেশ্য লেশমাত্র টের পেলে আমাদের কী দশা হতে পারে তা ভেবেই তো দিশাহারা। তবু মুখে স্মিত হাসি অম্লান রেখে নিজেদের স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের। কারণ কথা তো বলতে হবে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, সাহসিকতার সঙ্গে। ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে জেনারেল রাও ফরমান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আপ-লোগকো কেয়া তকলিফ হ্যায়?’ বললাম, ‘আর্মির সদস্যরা লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এই ভয়ে কক্সবাজারের বৌদ্ধরা দলে দলে পরিবার-পরিজন নিয়ে বার্মায় চলে যাচ্ছে। এতে দেশে-বিদেশে আমাদের সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বার্মা থেকে বুড্ডিস্টদের ফিরিয়ে আনা দরকার।’ কথাগুলো ইংরেজি আর উর্দু মিলিয়ে বলে ফেললাম। আমি উর্দু ভালো বলতে পারি না, দুলাল পারে। সে-ই মাঝে মাঝে সাহায্য করছিল। সহসা জেনারেল রাও ফরমানের চোখ আমাদের দিকে স্থিরভাবে নিবদ্ধ, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কিছুক্ষণ। এরপর জেনারেল অত্যন্ত ধীর ও ভারি গলায় উচ্চারণ করলেন, ‘বড়ুয়া সাব, আপ লোগ তো মুক্তি কা আদমি নেহি হ্যায়?’

দুলালের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, আমারও। কারণ আমাদের পক্ষে এমন কঠিন সত্য তো আর চোখে-মুখে লুকানো এতক্ষণ ধরে সম্ভব নয়। আমাদের দুজনেরই দশা- ‘ধরণি দ্বিধা হও, ঢুকে যাই’। চা খাচ্ছিলাম আমরা, মুখের চা আর গলা দিয়ে নামছিল না। জিবের ওপরে লেপ্টে আছে চা, গলার চা আর গেলার শক্তি নেই। উগরানোও যাচ্ছে না। আস্তে করে পকেট থেকে রুমাল বের করে তাতে মুখের চা চালান করে দিলাম সুকৌশলে। কী যে উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারছিলম না। ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ একেই বলে। সৃষ্টিকর্তাই রক্ষা করলেন আমাদের।

দুলাল বলে উঠল- ‘মাহমুদ আলী সাবের চিঠিটা দেখান না।’ ততক্ষণে একটু সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম। ভাবলাম তাই তো মাহমুদ আলীর চিঠি তো সবচেয়ে বড় ভরসা এখন। চিঠিতে লেখা আমরা ‘পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক বিশ্বস্ত লোক’। চিঠিটা তো আমার বুক পকেটেই। কাঁপা হাতে আমি চিঠিটা জেনারেল রাও ফরমানের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সেটা তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন, তার চোখ-মুখ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। জেনারেল বললেন, ‘ইয়ে পাস দে কে আপ কেয়া করিয়েগা বড়ুয়া সাব?’ বললাম, ‘ছাত্রনেতা হিসেবে আমার পরিচিতি আছে, বুড্ডিস্টরা আমাকে সবাই চেনে, ওরা আমার কথা শুনবে, ওদের আমি বার্মা থেকে ফেরত নিয়ে আসব।’ জেনারেল তখন বললেন (উর্দুতে/বাংলায় তরজমা), ‘কিন্তু বার্মায় তো এই পাস কোনো কাজে লাগবে না, আর ভিসা ছাড়া সে দেশে কে আপনাকে ঢুকতে দেবে?’ জবাবে বললাম, ‘আমাদের মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পাস বর্ডারে জমা রেখে বার্মায় ঢুকতে পারব আমি। যেহেতু বার্মিজরা বুড্ডিস্ট, আর আমিও বুড্ডিস্ট, তাই ওরা আমাকে বাধা দেবে না।’ সিগারেটে সুখটান দিলেন জেনারেল ফরমান, কিছুক্ষণ ভাবলেন, এরপর তার একান্ত সচিবকে ইন্টারকমে দুটো পাস তৈরির নির্দেশ দিলেন। দ্রুতই পাস চলে এলো। আমাদের পাস দুটোতে লেখা হলো (ইংরেজিতে) : ‘দে শুড বি অ্যালাউড টু মুভ আপটু টেকনাফ’। জেনারেল রাও ফরমান স্বাক্ষরিত সেই পাস নিয়ে কারফিউকালেও অবাধে চলাচল করা যেত। পাস হাতে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলেও আতঙ্ক একেবারে কাটেনি। খানিকটা ঘোরের মধ্যেই বলে ফেললাম, ‘কক্সবাজার-টেকনাফ যাওয়ার পথে কোনো মুক্তিবাহিনীর খোঁজ পেলে আপনাকে জানিয়ে দেব স্যার।’ শুনে তিনি বেশ খুশি হলেন। চারটি টেলিফোন নম্বর দিলেন তিনি, আরও বললেন, ‘কই মুক্তি কা হদিস মেল গ্যায়া তো, ইস নাম্বার মে ফোন করিয়েগা।’

আমরা বেরিয়ে আসছিলাম, দরজার কাছে আসতে না আসতেই পেছন থেকে ডাক ‘বড়ুয়া সাব, শুনিয়ে, শুনিয়ে।’ আমরা ফিরে তার টেবিলের কাছে গেলে তিনি আরেকটি ফোন নম্বর দিলেন এবং বললেন, ‘ইয়ে মেরে বেডরুম কা নাম্বার হ্যায়, ইয়ে কিসিকো মাত দে না।’ গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা স্বস্তি পেলাম, যেন এক দানবের খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলাম।

মায়া ভাইকে দিলাম পাস দুটো, তিনি তো মহাখুশি। সেই পাস দেখিয়ে একবার পাকিস্তান আর্মির কাকরাইল চেকপোস্টে আমরা চারজন গেরিলা গ্রেফতার থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। খোদ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মানু ভাই, দুলাল আর আমিÑ আমরা চারজন গাড়িতে, অস্ত্র ছিল; ওই পাস না থাকলে আমরা ধরা পড়তাম। সেবার হয়তো অন্যসব শহীদ-সহযোদ্ধার পরিণতি হতো আমাদেরও। প্রথমে বেজায় নির্যাতন, তারপর গুলি বা বেয়নেট চার্জে মৃত্যু।

                লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।

সর্বশেষ খবর