বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

শুভ চেতনার অভ্যুদয়

আজিম উদ্দিন আহমেদ

নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারতের বিজেপি সরকার বিপাকে পড়েছে। উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদের আবহ সৃষ্টি করে রাজনৈতিকভাবে বাজিমাতের। কিন্তু সে গুড়েবালি পড়েছে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স বলে পরিচিত রাজ্যগুলোর মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে বহিরাগত বিরোধী। বাঙালি বিদ্বেষের কার্ড ব্যবহার করে বিজেপি আসামে সরকার গঠনের সুযোগ পেলেও সেখানকার আদিবাসীরাও ফুঁসে উঠেছে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে। কারণ এই আইনে হিন্দু হলেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে চলে আসা কাউকে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার জায়েজ করা হয়েছে। এটি মেনে নিতে পারছে না আসাম শুধু নয় চারপাশের রাজ্যগুলো। মুসলমানরা নতুন নাগরিকত্ব আইনকে তাদের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করছে। সংখ্যাগুরু হিন্দুরাও খুশি নেই মতলববাজের আইনটিতে। তারা বৈষম্যমূলক আইনকে দেশের মর্যাদাহানিকর বলে ভাবছে। ফরাসি সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। বিক্ষোভে যোগ দেওয়া লাখো মানুষ বলছেন, এই আইনের মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানরা বৈষম্যের শিকার হবে।

তবে মুসলমানরা শুধু এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, এমনটা নয়। জাতিধর্ম-নির্বিশেষে আন্দোলনে শামিল হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মনুষ্যত্ব রক্ষার এই আন্দোলনে অংশ নেওয়া অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দলিত এবং পারসিরাও আন্দোলনে যোগ দিয়ে একাত্মতা প্রকাশ ও বিতর্কিত এই আইনের বিরোধিতা করছে। ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। নতুন আইন অনুসারে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে সেখানে যাওয়া মানুষ দেশটির নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু দেশটির নাগরিকরা এই আইনের বিরোধিতা করছেন। বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে টানা বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। এই আইন পাসের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। বিজেপি সরকারের জোর দাবি, এই আইন বৈষম্যমূলক নয়। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন, এমন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। দিল্লির বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন পারসি ধর্মাবলম্বী ৩২ বছর বয়সী কেরসি। যিনি কাজ করেন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে। অন্য অনেকের মতো জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন তিনি। বিক্ষোভের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। কেরসি বলেন, তিনি ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কারণ, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মাধ্যমে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি নড়ে গেছে। অতীতে আর কখনো এমনটা হয়নি। তিনি বলেন, ভারতের সংবিধানের ভিত্তি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। এতে বহুসংস্কৃত্ববাদ, বহুত্ববাদের মতো উপাদান রয়েছে। এই দেশের মূল ভিত্তিও এগুলো। এসবই আমাদের অন্য দেশ থেকে আলাদা করেছে। কেরসির মতে, নতুন এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি হুমকির মুখে ফেলেছে ভারতীয় সংবিধানের উপাদানগুলোকে। এই আইনের মধ্য দিয়ে সরকার একটি মৌলিক পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যার সঙ্গে আমরা একমত নই এবং এটা আমাদের ঠেকিয়ে দেওয়া উচিত। উচ্চবর্ণের হিন্দু মানসী। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সম্প্রতি ছুটি কাটাতে দিল্লি এসেছেন। বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ৬৪ বছর বয়সী বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। তার হাতে ছিল ভারতের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ভীমরাও আম্বেদকরের পোস্টার। ২৯ বছর বয়সী এই ভারতীয় নারী বলেন, অতীতে বিভিন্ন আইন পাস হয়েছে, যেগুলো ব্যাপক বিতর্কিত। কিন্তু বর্তমানে তারা নাগরিকত্বের অধিকার বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।  সংখ্যাগুরুদের নৈতিক দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, সরকার জাতির পরিচয় বদলে দিচ্ছে।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নন্দিনী বিতর্কিত আইনবিরোধী ওই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী তিনি। নন্দিনী বলেন, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের হামলায় তিনি হতবাক হয়েছেন। এই শিক্ষার্থীদের পাশে তিনি আছেন, এটা জানান দিতে তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। ওই অধ্যাপক বলেন, আমার মনে হচ্ছে, অনেক হয়েছে, আর নয়। ভিন্নমত পোষণের সুযোগ আমরা দিচ্ছি, এটা নিশ্চিত করা জরুরি। এই ভিন্নমতের অর্থ এই নয়, আমরা রাষ্ট্রবিরোধী। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, এমন নীতি গ্রহণ করুন, যাতে সবাই সম-অধিকার পাবে, যা বৈষম্যমূলক হবে না এবং আমাদের জাতিকে বিভক্ত করবে না। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রণব যাদব বলেন, ফ্যাসিস্ট শক্তি দেশে আক্রমণ চালালে ঘরে বসে থাকা যায় না। পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যখনই ক্ষমতায় আসে, তখনই তাদের মূল লক্ষ্য থাকে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করা। যা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। উচ্চবর্ণের হিন্দু প্রমীলা চতুর্বেদী, যার বয়স ৭৯। এই বৃদ্ধ বয়সেও তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। বলেন, তার দেহে এখন যথেষ্ট শক্তি নেই। তারপরও তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। কারণ ‘আমি সংবিধান রক্ষা করতে চাই। আমি মুসলমানদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে চাই।’ আমি তাদের এটা বলতে চাই, ‘আমরা আপনাদের পাশে আছি।’

ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বিসংবাদ। তবে এই অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয়দের প্রতিবাদ প্রকারান্তরে ভারতের মহত্ত্বকে তুলে ধরেছে। এই মহত্ত্বর কাছে হীনম্মন্যতা ও ধর্মান্ধতার শক্তির পরাভব হোক, এটি বিশ্বের সব সচেতন মানুষের কাম্য।

                লেখক : গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর