শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হাসান আবেদ

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হাসান আবেদ

স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেবামূলক বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, এ কথা মোটামুটি এ দেশের সবাই জানেন, জানেন পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষও। তিনি একজন মহান হৃদয়ের অধিকারী মানবতাবাদী ছিলেন তাও বিশ্বব্যাপী বহুজন জানেন। তাঁর মানবতাবোধ যে শুধু বাংলাদেশের মানুষেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। জাতি-ধর্ম-জাতীয়তা নির্বিশেষে তাঁর মানবতা বিস্তার লাভ করেছিল ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে, আর তাই তো ব্রিটিশ রানী তাঁকে প্রদান করেছিলেন অতিসম্মানজনক নাইট কমান্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জেমস খেতাব। পৃথিবীর বহু বরেণ্য ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যে কথাটি এ দেশের অনেকেই জানেন না, তা হলো এই যে, স্যার আবেদ ’৭১ সালে একজন বিলাতপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জানেন না এ কারণে যে তিনি এ কথাটি কখনো প্রচার করেননি। তাই আজ তাঁর তিরোধানের পর তাঁর জীবনের সেই বিশেষ দিকটি সম্পর্কে এ দেশের মানুষকে অবহিত করা তাঁদের দায়িত্ব আমার মতো যাঁদের সুযোগ হয়েছিল বিলাতভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা স্বচক্ষে অবলোকন করার।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখ। সেই দিনটিতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত পিস নিউজ পত্রিকার সম্পাদক রজার মুডি যুক্তরাজ্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ফোন করে জানালেন কয়েকজন অবাঙালি ব্রিটিশ বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং সে দেশের স্বাধীনতার দাবিকে আরও বেগবান করার জন্য একটি ব্রিটিশ কমিটি গঠনে ইচ্ছুক। তাঁরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহায়তা চাইলেন এ কারণে যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তখন প্রবল বেগে স্বাধীনতার জন্য কাজ করছিল। এর কিছুদিন আগেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দোরগোড়ায় আমার এবং আফরোজ চৌধুরীর অনশনের ঘটনা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বহুল পরিচিতি লাভ করে।

রজার মুডির ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নিল যে পরিষদের ২ নম্বর আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন), আমি (লেখক) এবং মাহমুদ এ রৌফ (বর্তমানে লন্ডনে অ্যাকাউন্টিং পেশায় নিয়োজিত এবং লন্ডন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক) পিস নিউজের বৈঠকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিত্ব করবে। সেইমতে, লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় পিস নিউজের দফতরে গিয়ে যাঁদের দেখা পেলাম তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য মাইকেল বার্নস, তরুণ লিবারেল নেতা পল কনেট এবং পিএইচডির জন্য গবেষণারত ছাত্রী মেরিয়েটা প্রকোপে। তাঁরা সবাই বাংলাদেশে গণহত্যা ও গণধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় বক্তব্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বশক্তিগুলোর নীরবতার কঠোর সমালোচনা করলেন এবং বিলাতে মুক্তি আন্দোলনকে আরও বেশি ফলপ্রসূ করার জন্য গঠন করলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামক মূলত এক ব্রিটিশ সংস্থা; যার সভাপতি হলেন পল কনেট এবং সাধারণ সম্পাদক হলেন মেরিয়েটা। সভায় মেরিয়েটা জানালেন তিনি তাঁর প্রতিবেশী ফজলে হাসান আবেদের কাছ থেকে বাংলাদেশে গণহত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের যে কথা শুনছেন তারপর আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। মূলত আবেদ ভাই-ই মেরিয়েটাকে বাংলাদেশ আন্দোলনে জড়িত হওয়ার জন্য উৎসাহ দেন। আবেদ ভাই তখনো সুপরিচিত হয়ে ওঠেননি। তাই মেরিয়েটার মুখেই প্রথম তাঁর নামটি শুনলাম। আবেদ ভাই তখন লন্ডনে অ্যাকাউন্ট্যান্সি বিষয়ে পড়াশোনা করছিলেন। এরপর যেদিন আমরা উত্তর লন্ডনের কেমডেন টাউন এলাকায় ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কার্যালয়ে প্রথম গেলাম সেদিনই সেখানে আবেদ ভাইয়ের দেখা পেলাম। মূলত অবাঙালিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির জন্য তিনি আনন্দ প্রকাশ করলেন এবং আমাদের সহায়তার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে ধন্যবাদ জানালেন। তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। সেদিনের পরিচয়ের সময় ভাবা সম্ভব ছিল না যে, এই আবেদ ভাই-ই একদিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানবকল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা হবেন। সেদিন তিনি জানালেন আমি এবং আফরোজ যখন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দরজায় অনশন করছিলাম তখন তিনিও সেখানে গিয়েছিলেন।

এরপর ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর প্রায় প্রতিটি কর্মকান্ডেই আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে এ কারণে যে, তিনি বলতে গেলে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সব কর্মকান্ডেই অংশ নিতেন। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর মিছিলে শরিক হয়ে লন্ডনের মহাসড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে স্লোগানের মাধ্যমে লন্ডনের রাজপথ প্রকম্পিত করতেন, যেসব স্লোগানের মধ্য ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, গণহত্যা বন্ধ কর, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও প্রভৃতি। পার্লামেন্টে ধরনা, রাজনৈতিক ধরনা, নেতাদের বিভিন্ন দূতাবাসে ধরনা ইত্যাদি কর্মকান্ডেও তিনি ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেন।

‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ মূলত ব্রিটিশ সংস্থা হলেও অল্প সময়েই বেশ কিছু বাঙালিও এর কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েন; যাঁদের মধ্যে ছিলেন আবেদ ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, রুনি সুলতানা, জাকারিয়া চৌধুরী (যাঁর অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া বোন আয়েশা আবেদ বাহার ছিলেন আবেদ ভাইয়ের প্রথম স্ত্রী)। এ ছাড়া সম্পৃক্ত হন আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু, রাজিউল হাসান রঞ্জু (পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত), আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার (বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে, পরবর্তীতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), বিবিসির ফজলে রাব্বি মাহমুদ হাসান (পরবর্তীতে গণসাহায্য সংস্থার ড. মাহমুদ হাসান), সুরাইয়া খানম (পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. সুরাইয়া খানম), নৃত্যশিল্পী মঞ্জু মজিদ (কবি গোলাম মোস্তফার দৌহিত্রী), লুলু বিলকিস বানু (একসময়ের ভিকারুননিসা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ) এবং তাঁর দুই মেয়ে জেরিন ও আফরিন, নুরুল আলম, আনিসুর রহমান (বর্তমানে ব্যারিস্টার হিসেবে লন্ডনে আইন পেশায় নিযুক্ত এবং ব্রিটিশ রানীর থেকে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার খেতাবপ্রাপ্ত) প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার আমাদের বিরুদ্ধে থাকায় লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসে আমরা প্রতিনিয়ত লবিং করেছি। এমনি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে জুলাইয়ে মার্কিন দূতাবাসের সামনে আমরা গণহত্যার কৃত্রিম প্রতিচ্ছবি মঞ্চায়ন করি, যে অনুষ্ঠানে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর পক্ষে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন আবেদ ভাই। উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ।

আমাদের ওই অনুষ্ঠানের পর স্বয়ং মার্কিন রাষ্ট্রদূত আবেদ ভাই, পল কনেট, মেরিয়েটা, মঞ্জু এবং আমাকে তাঁর দফতরে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন তিনি তাঁর সরকারকে আমাদের দাবির কথা জানাবেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক মাতৃসম মহিলা মিসেস ইসমাইল ও তাঁর মেয়ে রুনি সুলতানা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সংগ্রামীদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনে ছিল তাঁদের বাসা। আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে মিসেস ইসমাইলের সম্পর্ক ছিল মা-ছেলের মতো। মিসেস ইসমাইল প্রায়ই তাঁর বাড়িতে আমাদের আপ্যায়ন করে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কর্মকান্ডের ব্যাপারে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। তাঁর বাড়ির অনুষ্ঠানের আলোচনায় যোগ দিতেন আবেদ ভাই, আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু, ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, নৃত্যশিল্পী মঞ্জু মজিদ, লুলু বিলকিস বানু এবং তাঁর কন্যাদ্বয় প্রমুখ। মাঝেমধ্যে পল, তাঁর স্ত্রী ইলেন ও মেরিয়েটাও যেতেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও দু-একবার গিয়েছিলেন। মিসেস ইসমাইলের বাসায় ঘরোয়া আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বুঝতে পারতাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি, বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও আদর্শের প্রতি আবেদ ভাই কত অবিচল ছিলেন।

২০১৩ সালে পল কনেট ও তাঁর স্ত্রী ইলেন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু’ সম্মাননা নিতে এলে আমার বাড়িতে তাঁদের সম্মানে এক অনুষ্ঠানে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে এবং যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যাঁরা গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদেরও নিমন্ত্রণ করলে আবেদ ভাই এসে পল ও ইলেন কনেটকে আবার বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ করলে তার জবাবে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে পল ও ইলেন বাংলাদেশে আসেন। সে সময় একদিন আবেদ ভাই ব্র্যাক কার্যালয়ের রেস্তোরাঁয় পল, ইলেন, মঞ্জু, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মুফিদুল হক ও আমাকে দুপুরের খাবারের জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে সেটাই ছিল আমার শেষ দেখা। সেই সাক্ষাতে আমরা ’৭১-এর লন্ডন নিয়ে অনেকক্ষণ স্মৃতিচারণা করি। এক পর্যায়ে আবেদ ভাইকে বললাম তিনি কেন বিলেতে মুক্তি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার কথা বলেন না বা লেখেন না। জবাবে তিনি বললেন, সম্পূর্ণ অবসরে যাওয়ার পর তিনি তাঁর স্মৃতিকথা লেখার ইচ্ছা রাখেন। আর সেই স্মৃতিকথায় স্থান পাবে লন্ডনে ’৭১-এ তাঁর ভূমিকার কথা। আবেদ ভাই সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক আহমদ চৌধুরীরও একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আর ফারুক ভাইয়ের সঙ্গেও আমার গভীর সখ্য ছিল। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই ফারুক ভাই যুক্তরাজ্যে উপহাইকমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।

বহু বছর প্রবাসজীবন কাটানোর পর দেশে ফিরে যখন ব্যারিস্টার হিসেবে ১৯৯৩ সালে আবার নতুন করে আইন পেশা শুরু করি তখন প্রথম কাজটিই দিয়েছিলেন আবেদ ভাই আমাকে এবং তাঁর অতিঘনিষ্ঠজন ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী (বেকু ভাই)-কে। বেকু ভাইও বহু বছর প্রবাসে থাকার পর দেশে ফেরেন।

মহাখালীস্থ আড়ংয়ের পাশে এক বিশালকায় জমি ব্র্যাক কিনতে চাইল আবুল খায়ের লিটু সাহেবের কাছ থেকে। এ ব্যাপারে আইনি কাজগুলোর দায়িত্ব দিলেন বেকু ভাইকে আর আমাকে দিলেন জুনিয়রের কাজ, বললেন তুমি মাত্র দেশে ফিরেছ। পেশা জমাতে সময় লাগবে। তাই তোমাকেই কাজটি দিচ্ছি বেকুর জুনিয়র হিসেবে কাজ করার জন্য। আমার মতো একজন নবাগত ব্যারিস্টারের জন্য তখন সে কাজটি ছিল আশীর্বাদসম।

তাঁর অন্তর্ধানের পর ’৭১ এবং তৎপরবর্তী কালের স্মৃতিগুলো একের পর এক ভেসে আসছে মনের পর্দায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ। তাঁর অগ্রজ নাজমুল হাসান জাহেদ একসময় আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর বোনের ছেলে ব্রিটিশ রানী থেকে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ খেতাবপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার মঞ্জুর হাসান প্রবাসে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর জামাতা।

আবেদ ভাই যে শুধু বাঙালিদের গর্ব ছিলেন তা নয়, তিনি বিশ্বের বহু দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীরও ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বহু মানুষের মনের পর্দায় তিনি বহুকাল বেঁচে থাকবেন।

                লেখক : সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর