শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

অবেলার গল্প

তুষার কণা খোন্দকার

অবেলার গল্প

মাস দুয়েক আগে এক মন্ত্রী বলেছিলেন রাজনীতিতে গরম খবর আসছে। মন্ত্রী ঘোষিত গরম খবরের আশায় দিন গুজরান করতে গিয়ে  আমার একটা শৈশবস্মৃতি মনে এলো। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামেগঞ্জে ভল্লুকের খেলা দেখানো হতো। ভল্লুকের মালিক তার পোষা ভল্লুকের গলায় চিকন একটা চেন পরিয়ে ভল্লুকটাকে টানতে টানতে এ গ্রাম সে গ্রামে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখিয়ে টাকা নিত। একদিন আমাদের গ্রামের বাড়ির বারবাড়িতে ভল্লুকওয়ালা এসে হাঁক দিতেই পাড়ার ছোটদের দল দৌড়ে গিয়ে ভল্লুকওয়ালাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে শুরু করলাম। ভল্লুকের মালিক তার হাতের চিকন ছড়ি ওপর-নিচে ওঠায় নামায় আর বলে নাচ ভল্লুক নাচ, হেলে দুলে নাচ। ভল্লুকওয়ালার হাঁক শুনে ভল্লুক সামনের দুই পা হাতের মতো ভাঁজ করে বুকের ওপর রেখে পেছনের দুই পায়ে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে গেল। ভল্লুকওয়ালা হাতের ছড়ি বাতাসে দোল দিয়ে একবার ওপরে ওঠায় আবার নিচে নামায়। মালিকের ছড়ির ওঠা-নামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভল্লুক গা দুলিয়ে একবার বাঁ পায়ে দাঁড়ায় আবার ডান পায়ে দাঁড়ায়। ভল্লুকের খেলায় তেমন বৈচিত্র্য না থাকলেও তার গা দোলানো নাচ দেখতে আমাদের ভালোই লেগেছিল। খেলা শেষে আমরা যখন ভল্লুকওয়ালার হাতে খুচরা পয়সা দিয়ে বাড়িতে ঢুকছি তখন আমার ছোট কাকা বললেন, ভল্লুককে নাচ শেখায় কেমন করে জানিস? কাকার প্রশ্ন শুনে আমরা প্রবল কৌতূহল নিয়ে ভল্লুকের নাচ শেখানোর টেকনিক শোনার জন্য তাকে ঘিরে ধরলাম। কাকা বললেন, কিছু মানুষ বনে গিয়ে ভল্লুকের বাচ্চা চুরি করে নিয়ে আসে। তারপর সেই বাচ্চাটাকে লোহার গরম তাওয়ার ওপর দাঁড় করিয়ে তার সামনে ছড়ি ওঠায়-নামায় আর বলে নাচ ভল্লুুক নাচ, হেলে দুলে নাচ। পায়ের নিচের গরম থেকে বাঁচার জন্য ভল্লুক একবার বাঁ পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ডান পা ঠান্ডা হতে দেয়। ফের বাঁ পা বেশি গরম হয়ে গেলে ভল্লুক তার পায়ের ভার বদল করে। এমন করতে করতে একসময় ভল্লুক তার মালিকের হাতের ছড়ির ওঠা-নামার দিকে চেয়ে ভাবে এই বুঝি পায়ের তলায় গরম তাওয়ার ছ্যাঁকা লাগা শুরু হয়ে গেছে। আতঙ্কের ঘোরে ভল্লুক পায়ের ভার বদল করে আর আমরা ভাবী ভল্লুক বুঝি মনের আনন্দে নাচছে। মাননীয় মন্ত্রী! আপনাকে কষ্ট করে আর গরম খবর দিতে হবে না। বিশ্বাস করুন, স্বাধীনতার পর থেকে আমরা তপ্ত তাওয়া ও জ্বলন্ত চুলা এ দুইয়ের মধ্যেই তাল মিলিয়ে ক্রমাগত নেচে চলেছি। আপনার অতিমাত্রার গরম খবরে নাচের তাল কেটে আমরা বেতালা শুরু করতে পারি। কাজেই আপনার গরম খবর আপনি চেপে রেখে ভালোই করেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই তাঁর মন্ত্রীদের কথা কম বলতে বলেন। মান্যবর মন্ত্রীরা মন্ত্রিত্বে বহাল থাকার আরামে দরকার হলে কথা কমিয়ে বলবেন। কিন্তু গত পাঁচ বছর বাম ঘরানার যাঁরা মন্ত্রী পদমর্যাদায় ক্ষমতার বলয়ে ঘুরপাক খেয়েছেন তাঁরা মন্ত্রিত্ব হারানোর শোকে বেশি কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁদের দোষ দেওয়া ঠিক না। গত পাঁচ বছর ক্ষণে-বিক্ষণে উনারা আওয়ামী না হয়েও আওয়ামীর বাড়া জপমালা জপে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। এখন যখন চারদিকে খোলামকুচির মতো টাকার ছড়াছড়ি তখন উনাদের মন্ত্রিত্বের স্বর্গ থেকে ধাক্কা মেরে কঠিন মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কাজেই মেনন সাহেবরা এখন মনের দুঃখে আবোলতাবোল বলছেন। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে বলে ‘আজপা জপা’ অর্থাৎ যেমন কথা জপ করার কথা নয় তেমন কথা জপ করা। মেনন সাহেব মন্ত্রিত্ব হারিয়ে বললেন, ‘গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলতে পারি জনগণ গত নির্বাচনে ভোট দেয়নি।’ এরপর কোথায় কী ঘটে গেল কে জানে! মনে হলো, মেনন সাহেব জ্বর বিকারের ঘোর কাটিয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাঁর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন। মন্ত্রীগিরি না পেয়ে বিকার দেখা দিলেও এমপিগিরি রক্ষার তরিকা তিনি ভোলেননি। আজপা জপার অপরাধে উনার পদ-পদবি নড়বড় হয়ে পড়ায় তড়িঘড়ি  সরকারি দল সমীপে লিখিত দরখাস্ত পেশ করে থুক্কু কেটে বলেছেন, ‘গত নির্বাচন নিয়া যাহা বলিয়াছি তাহা মন্ত্রিত্ব হারানোর শোকে মনের ভ্রমে বলিয়াছি। ভবিষ্যতে এমপিগিরি রক্ষার স্বার্থে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া যাহা বলিব সত্য বলিব। সত্য বই মিথ্যা বলিব না।’ মন্ত্রিত্ব হারিয়ে জনাব মেননের আচমকা সত্যবাদী হওয়ার চেষ্টা দেখে সত্য-মিথ্যা নিয়ে একটি পুরনো গল্প মনে পড়ল। প্রাচীনকালে ভারতীয় ঋষিরা শিষ্যদের শিক্ষা দিতে গিয়ে সবকিছুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে চাইতেন। এমন এক ঋষি শিষ্যদের প্রশ্নের জবাবে সত্য-মিথ্যার ফারাক বের করে সত্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে নিজেও খুব একটা থই পাচ্ছিলেন না। অনেক দিন ধরে সত্যের সংজ্ঞা নির্ধারণের কাজে গলদঘর্ম ঋষি এক সকালে শিষ্যদের ডেকে বললেন, বৎসগণ! কাল রাতে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে স্বচ্ছ সরোবর জলে পূর্ণচন্দ্রের ছায়া দেখলাম। স্বপ্নের বর্ণনা শেষে তিনি বললেন, বল দেখি বৎসগণ, স্বপ্নে দেখা স্বচ্ছ সরোবর জলে পূর্ণচন্দ্রের ছায়া এ বাক্যের মধ্যে সত্য কোনটি? ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন কি সত্য? স্বপ্নের ছলে দেখা পুকুরভরা টলটলে পানি কি সত্য না মায়া? আবার দেখ, টলটলে পানির বুকে ভাসতে থাকা আস্ত একখান চাঁদের ছায়াকে মিথ্যা বলে কি উড়িয়ে দেবে? এমন জটিল প্রশ্নের জবাবে ঋষির শিষ্যরা কী বলেছিল তা আমি জানি না। তবে ঋষি ভদ্রলোক মানবজাতির সামনে বিশাল একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলিয়ে রেখে অনন্তে পাড়ি দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। কথা তো সত্য। মানুষ ভোট দিতে যায়নি তা তো বলা যাচ্ছে না। সব ভোট কেন্দ্রেই ভোট গ্রহণ বুথের বাইরে শুধু আওয়ামী লীগের একটি বুথ ছিল। সেই বুথ আওয়ামী ঘরানার নেতা-নেত্রীদের ছবি দিয়ে সুসজ্জিত। বুথে কর্মরত কর্মীদের গায়ে লাল সবুজ পোশাক। বুকে নৌকার ব্যাজ। তাদের প্রত্যেকের সামনে একটি করে ল্যাপটপ। ডিজিটাল যুগের ভোটের কায়দা কেতা জেনেই মেনন সাহেব নির্বাচন করেছেন। ভেবেছিলেন তিনি মন্ত্রী হবেন কিন্তু কপালের ফেরে হতে পারেননি। তাই বলে কি মেনন সাহেব ক্ষমতার মধু না খেয়ে দিন গুজরান করতে পারবেন? কেন পারবেন না তা বিশদে ব্যাখ্যা না করে আমি একটি গল্প বলি, শুনুন। বাংলাদেশের এক গ্রামের এক লোক যেখানে মেহমানদারি দেখে সেখানেই পাত পেতে খেতে বসে পড়ে। মেহমানির আসরে গিয়ে পাত পেড়ে বসে পড়ার জন্য সে দাওয়াত পাওয়ার মুখাপেক্ষী নয়। এভাবে দিন যেতে যেতে একসময় তার ছেলেরা বড় হয়ে গেল। তারা বাপকে এমন বিনা দাওয়াতে খেতে যেতে নিষেধ করতে শুরু করল। কিন্তু লোকটা কোনো বাধা মানে না। ছেলেদের মানসম্মানের তোয়াক্কা না করে সে তার নিজের নিয়মে বিনা দাওয়াতে খেয়ে বেড়াতে লাগল। ছেলেরা বাপের ওপর বিরক্ত হয়ে একদিন তাকে দড়ি দিয়ে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখল। যখন দুপুর হলো তখন লোকটা আপন মনে বলতে লাগলÑ এইবার পাতে ভাত দিল, এইবার দিল গোস্ত, এইবার ডাল। আহারে এবার পাতে দই দিলরে দই দিল। দই দিল বলে ডাকচিৎকার ছেড়ে লোকটা দড়ি ছিঁড়ে দাওয়াতি বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। মেনন সাহেবরা, স্মরণ করে দেখুন, স্বাধীনতার আগে-পরে কবে আপনারা দই না খেয়ে প্রাণ ধারণ করেছেন?

ইদানীং রাজনীতি-অরাজনীতি মিলিয়ে যুবলীগ দেশের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে। যুবলীগের নেতারা সবাই ভালোই ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ বেচারাদের জীবনে কেমন ছন্দপতন ঘটে গেল। র‌্যাব-পুলিশ হানা দিয়ে উনাদের টাকার সিন্দুক জব্দ করে নিয়ে গেছে। যুবলীগের ত্যাগী নেতা জনাব ওমর ফারুকের বয়স নাকি একাত্তর বছর। জাতির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত এই নেতা একাত্তর বছর বয়সেও সম্রাটদের মতো আদর্শ যুবকদের নেতৃত্ব দিয়ে কত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। একাত্তর বছর বয়সে জনাব ওমর ফারুক যুবলীগের নেতা হওয়ায় বয়স নিয়ে একটি প্রবচন মনে পড়ল। মানুষের আয়ু পিরামিডের মতো কল্পনা করুন। পিরামিডের গোড়ায় এক পাশে দোলনা আর অন্য পাশে রয়েছে কবর। ধরে নেওয়া যাক মানুষের আয়ু আশি বছর। তাহলে পিরামিডের চূড়ায় রাখুন চল্লিশ। এবার মানুষ নামের শিশুটি দোলনা ছেড়ে পিরামিডের গা বেয়ে চূড়ায় উঠতে শুরু করল। পিরামিডের গা বেয়ে চড়াই ভাঙার সময় মানুষটি যতবার পেছন ফিরে তাকাবে ততবার পিরামিডের গোড়ায় তার ছেড়ে আসা দোলনা চোখে পড়বে। চূড়ায় উঠে মানুষটি যখন একচল্লিশ-বিয়াল্লিশ করে নিচের দিকে নামতে শুরু করবে তখন তার পেছনে ফেলে আসা দোলনা চোখের আড়াল হয়ে সামনে দিব্যি আস্ত একখান কবর দেখতে পাবে। এমন করে নামতে নামতে একসময় মানুষটি সোজা গিয়ে নিজের কবরে ঢুকে যাবে। ওমর ফারুক সাহেব কত কষ্ট করে কাঁধে সিন্দুক বয়ে নিচের দিকে চেয়েছিলেন আপনারা একবার ভেবে দেখুন। নতুন আইনে যুবলীগ করার আয়ুসীমা পঞ্চান্ন বছর। অর্থাৎ এ মুহূর্তে যারা যুবলীগের টপ বস তাদের সবারই নিজেদের দোলনা চোখের আড়ালে পড়ে গেছে। আয়ুসীমার নিয়ম মেনে উনারা সবাই কবর দেখতে পাচ্ছেন। কাজেই যুবলীগের নেতারা প্রতিদিন মনে মনে জপ করবেন, ‘দি লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’ অর্থাৎ শেষ পিরানে পকেট নেই। আশা করি উনারা আর ওমর ফারুক সাহেবের মতো এত কষ্ট করবেন না।           

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর