শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

‘ধন-ধান্য-পুষ্প-ভরা...’

শাইখ সিরাজ

‘ধন-ধান্য-পুষ্প-ভরা...’

আশির দশক থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের ধারণ কাজে আমি বহুবার ঝিকরগাছায় গিয়েছি। ঝিকরগাছার গদখালী, পানিসারা গ্রামগুলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আমার বিশেষ এক অভিজ্ঞতা। এ এলাকার কৃষকই প্রথম প্রচলিত কৃষি ধান-পাট কিংবা শাক-সবজি চাষ থেকে সরে এসে ফুল চাষ শুরু করেন। পাঠক! আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে শের আলী সরদারের কথা। ১৯৮৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে শের আলী সরদার মাত্র ৩০ শতক জমিতে প্রথম চাষ শুরু করেন রজনীগন্ধা ফুলের। এর মধ্য দিয়ে এ দেশে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ ও বিপণন। গদখালীকে এখন বলা হয় ‘ফুলের রাজধানী’।  সেখানে মাঠের পর মাঠজুড়ে দেখা যায় নানা রঙের, বর্ণিল জাতের ফুল। ২০০৬ সালেও সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। অধিকাংশ কৃষক পরিবারই বসবাস করত কুঁড়েঘরে। দরিদ্রতা মানুষের চোখেমুখে ফুটে উঠত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে পরিবর্তন এসেছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে গদখালীর ফুল নিয়ে একটি ফলোআপ প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। গত তিন বছরে কতটুকু পরিবর্তন এলো গদখালীর কৃষকের জীবনে, তা দেখতে আবার ছুটে গিয়েছিলাম গত নভেম্বরে। নভেম্বরের শেষে শীতের পরশ মেখে প্রকৃতি যখন অন্য রূপে সজ্জিত হচ্ছে তখন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির ফুলের চাহিদা সামনে রেখে ফুলের রাজ্যের কৃষক মাঠে মাঠে প্রস্তুতি নিচ্ছে ফুলে ফুলে ভরে তোলার। ফুলই এখানে অর্থকরী ফসল। যশোর শহর থেকে শার্শার পথে যেতে যেতে প্রাচীন বাংলার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড কিংবা মহান স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক যশোর রোডের প্রাচীন সব বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে এসে চোখ আটকে যায় এই গদখালী বাজারে। এটিই ফুলের রাজ্যের প্রবেশমুখ। ফুল চাষিরা সাইকেল বা মোটরসাইকেলে করে ফুল নিয়ে বাজারে এসে পাইকারের কাছে বিক্রি করে যাচ্ছে। প্রথম দেখা সেই ছোট্ট বাজার এখন আকারে যেমন বড় হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে দোকানপাটেরও। কথা হলো ফুল নিয়ে আসা ফুল চাষিদের সঙ্গে। এক ফুল চাষি ৪০০ গোলাপ নিয়ে এসেছেন বাজারে। তিনি জানালেন ১০০ ফুল বিক্রি করে পান ১৫০-২০০ টাকা। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ফুল বাজারে নিয়ে আসেন। ফুল চাষ করে খুব ভালো আছেন তিনি। তার সঙ্গে মত মেলান অন্য ফুল চাষিরাও। তাদের বেশ সচ্ছল এক জীবনের সুঘ্রাণ দিয়েছে ফুল। এ বাজারে পাইকারি বিক্রেতা আছেন ১২০ জনের মতো। প্রত্যেক পাইকার প্রতিদিন ফুল কেনেন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার। সেই ফুল এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, তাদের প্রতিদিন লাভ থাকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। তারাও খুশি। ফুলের বাণিজ্যে এসে তারাও জীবনে পাচ্ছেন ফুলের সৌরভ। সাধারণত ভোর থেকে সকাল অবধি ফুলের কেনাবেচা হলেও সারা দিন জমজমাট থাকে এ বাজার। চায়ের দোকানেও ভিড় জমে থাকে। বাজারে ২৮টি চায়ের দোকান। স্থানীয় চা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললাম। প্রত্যন্ত গ্রামের এ বাজারে প্রতিদিন চা-ই বিক্রি হয় লাখ টাকার।

বাজার থেকে রওনা করলাম পানিসারা গ্রামের উদ্দেশে। যেতে যেতে মনে পড়ল বারিসানের কথা। বারিসান এ অঞ্চলের আরেক ফুল বিপ্লবী নারী। সেই ২০০৬ সালে বারিসান তার বিপ্লবের কথা আমাকে বলেছিলেন। বারিসানের স্বামী ভ্যান চালাতেন। কিন্তু এতে সংসার চলত না। ভ্যান বিক্রি করে একটা মুদি দোকান চালু করলেন। কিন্তু অল্প মূলধনের দোকানের মালামাল নিজের সংসারেই খরচ হয়ে গেল। দিশাহারা অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলেন জমি বেচবেন। জমির পরিমাণও অল্প। ২ বিঘা ৫ কাঠা জমি। সেখান থেকে ৫ কাঠা জমি বিক্রি করে ৬ হাজার টাকা পেলেন। সেই টাকায় ভারত থেকে গোলাপের বীজ আনলেন। গোলাপ পাল্টে দিল তার জীবন। প্লাস্টিকের কাগজের কুঁড়েঘর থেকে টিনের ঘর তুললেন। টিনের ঘর থেকে উঠল দালান। এখন এ অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িই পাকা ঘরের।

পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল মাঠে মাঠে ফুলের চাষ। মাঠভর্তি ফুল এখন নেই। জানুয়ারির শেষ দিকে বা ফেব্রুয়ারিতে প্রতিটি মাঠ ভরে উঠবে ফুলে। হয়ে উঠবে ফুলের স্বর্গ। ফুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকা, প্রতিদিনকার হিসাব-নিকাশ। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে গদখালীর ৭৫টি গ্রামের ৫ হাজার চাষিসহ ৫ লাখ মানুষ ফুল উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। আজকের এ পরিবর্তনের পেছনে আছে ঝলমলে এক সকালের গল্প। গদখালী, পানিসারা নীলকণ্ঠর চাষিদের সবার মনে গেঁথে আছে সেই গল্প। ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ এলাকা পরিদর্শনে নিয়ে আসি তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা ও ইউএসএআইডির মিশন চিফ রিচার্ড গ্রিনকে। উদ্দেশ্য- এ দেশে মার্কিন সরকারের কৃষিবিষয়ক নানা সহায়তার ভিতর এ এলাকার কৃষকদের স্বপ্নগুলোকে যুক্ত করে দেওয়া। সেদিন স্থানীয়ভাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ফুল চাষিদের অনেক দাবি ও প্রত্যাশার কথা উঠে এসেছিল। চেষ্টা করেছিলাম এ এলাকার কৃষির সঙ্গে দাতাগোষ্ঠীর একটি সরাসরি সেতুবন্ধ রচনার। আশার কথা, তার পর থেকে এ এলাকায় বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। আর এখন এখানকার কৃষকের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে পরিবর্তনের গল্পগুলো। পাল্টে যাওয়া দিনের প্রমাণ সব জায়গায়। চলতে চলতে দেখা হলো স্কুলশিক্ষক আতাউর রহমানের সঙ্গে। এলাকার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সবচেয়ে গোছানো রেকর্ড যেন আছে তার কাছে। তিনি জানালেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত এ এলাকা ঘুরে যাওয়ার পর পরিবর্তনের গতি বেড়েছে। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। সরকারি-অসরকারি প্রতিষ্ঠানের নানামুখী কার্যক্রমে পাল্টে গেছে তাদের জীবন। বদলে গেছে এলাকার রাস্তাঘাট ও মোড়। গ্রামের ভিতর লেগেছে নাগরিক বাতাস। পর্যটক বা স্থানীয় শৌখিন মানুষ এ গ্রামে বেড়াতে এসে ফুল কেনেন। অনেকেই বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য এখানে ফুল অর্ডার দেন। আগে এসে পানিসারা গ্রামের ভিতর লিটনের ভুনা চায়ের স্বাদ নিতাম, সেই লিটনও এখন চায়ের দোকান ছেড়ে পুরোদস্তুর ফুল ব্যবসায়ী। বললেন, ফুলই এখানকার মানুষের ধ্যান-জ্ঞান। মোহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন ক্ষুদ্র চাষি, এখন তিনি বড় ফুল চাষিতে পরিণত হয়েছেন। তরুণ বাপ্পি লেখাপড়া শেষ করে ঢাকার পাট চুকিয়ে এসেছেন গ্রামে। এখানে সে একটি ফাস্টফুডের দোকান গড়ে তুলেছেন। এ অঞ্চলটি হয়ে উঠেছে পর্যটনের এক অনন্য ক্ষেত্র। এ ফুলের রাজ্যে এখন বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। যারা জানেন তারা দূরদূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসেন। সকালের মিষ্টি রোদে পানিসারার মাঠে কাজ করতে করতে বেশ কয়েকজনের দেখা পেলাম। তারা বেড়াতে এসেছেন ফুলের মাঠে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, একসময়ের পশ্চাৎপদ, অবহেলিত ও দারিদ্র্যপ্রধান এ গদখালী শুধু ফুলের মাঠ নয়, অবকাঠামোর দিক থেকেও পরিণত হতে চলেছে বাংলাদেশের হল্যান্ডে। অর্থাৎ ইউএসএআইডির অর্থায়নে এখানে নির্মিত হচ্ছে বিশেষায়িত ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ সেন্টার ও বাজার। পাঠক! আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে আমরা তুলে ধরেছিলাম বিশ্বের সর্ববৃহৎ ফুল বিপণন কেন্দ্র ফোরা হল্যান্ডের চিত্র। গদখালীর এ ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণও হবে সে রকম ফুল বাণিজ্যের আধুনিক এক কেন্দ্র। যেখানে কৃষক প্রশিক্ষণ, ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেজিং ছাড়াও হবে নানা কাজ। নির্মাণাধীন এ কেন্দ্রে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিমের সঙ্গে। তিনি চ্যানেল আইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে গণমাধ্যমের প্রচার ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যই। তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা ও ইউএসএআইডির মিশন চিফ রিচার্ড গ্রিনকে আপনি এ এলাকায় নিয়ে এসেছিলেন বলে আমরা আমাদের দাবির কথা জানাতে পেরেছিলাম। তারই ফলে দেশের প্রথম ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও আধুনিক বাজার নির্মিত হচ্ছে গদখালীতে।’ ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে যৌথভাবে এ আধুনিক বাজার ও কুলিং চেম্বার নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি)।

গদখালীর বিশেষায়িত ফুলের বাজার ছাড়াও যশোরের গ্রামাঞ্চলে আরও ১২টি আধুনিক বাজার ও ১২টি কালেকশন সেন্টার নির্মাণ হবে এলজিইডির কৃষি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায়। এসব বাজার ও সেন্টারে চাষিদের উৎপাদিত সবজি ও ফুল আনা-নেওয়ার সুবিধার্থে নির্মাণ করা হচ্ছে ১০০ কিলোমিটার রাস্তা। বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছেন এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর্জা ইফতেখারুল হক। দিনে দিনে এ এলাকাটি পরিণত হচ্ছে পুরোদস্তুর কৃষি পর্যটনের এক অনন্য ক্ষেত্রে। কৃষির অর্থনৈতিক গুরুত্বেও এ এলাকা প্রতিনিধিত্ব করছে দেশের কৃষি অর্থনীতির নতুন এক ক্ষেত্রের। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাবে, বর্তমানে দেশের ২৪টি জেলার অন্তত ১২ হাজার একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হচ্ছে। ফুল চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ মানুষ যুক্ত। যে গদখালীতে মাত্র ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধা ফুল চাষের মাধ্যমে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ ও বিপণন শুরু করেন কৃষক শের আলী সরদার এখন সেখানে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে মাঠের পর মাঠজুড়ে দেখা যায় নানা রঙের, বর্ণের ফুল। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি ও সবজির পর যুগান্তকারী পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে ফুল। ফুলকে কেন্দ্র করে বিকশিত এ কৃষি অর্থনৈতিক অভিযাত্রার সঙ্গে থাকতে পারায় বড় তৃপ্তি বোধ হয়। এ অঞ্চলে গেলেই মনে হয় আমাদের দেশ সত্যি ‘ধন-ধান্য-পুষ্প-ভরা...’।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর