মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মমতার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না সংখ্যালঘুরা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না সংখ্যালঘুরা

ভারতের সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে পাকিস্তান, বাংলাদেশকে একই সঙ্গে আক্রমণ করছিলেন তার কয়েক মিনিট আগে নর্থ ব্লকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিরাপত্তার যে স্পেশাল প্রটেকশন পেয়ে আসছিলেন তা প্রত্যাহার করে একটি নির্দেশ জারি করা হয়। এই নিরাপত্তা প্রত্যাহার করা নিয়ে যখন সংসদের ভিতরে তৃণমূল বাদে সব রাজনৈতিক দল শোরগোল তোলে তখন বিজেপি সদস্যদের থেকে বলা হলো- আমাদের লক্ষ্য কংগ্রেসমুক্ত ভারত তখন কংগ্রেস থেকে উত্তর দিয়েছিলেন অধীর চৌধুরী। তিনি অতীতের নিদর্শন তুলে বলেছেন, কংগ্রেসের দুই নেতাকে হত্যা করা হয়েছে- ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে। তারই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা আরএসএস নেতা অমিত শাহ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটির পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এই পঙ্ক্তিতে বসিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব মুসলমান ভারতে এসেছে তাদের নাগরিকত্ব কেটে দেওয়া হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ঢাকার সাংবাদিকদের কাছে কার্যত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জানতে চেয়েছেন, কোথায় কোথায় বাংলাদেশি আছে তাদের তালিকা অমিত শাহ দিন। তালিকা দিলে আমরাই তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসব। তাদের পুশব্যাক করতে হবে না। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবাদে ভারত থেকেও বহু লোক দালালদের টাকা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। আমরা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমাদের নাগরিক নয় এমন কেউ ধরা পড়লে তাদের বের করে দেব।’ তিনি জানান, জীবিকার সন্ধানে কিছু বাংলাদেশি নাগরিক বেআইনিভাবে ভারতে গিয়ে থাকতে পারে। এমন বাংলাদেশির তালিকা দেওয়ার জন্য তারা ভারত সরকারকে বলেছেন, সেই তালিকা পেলে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, নিজের দেশে আসতে চাইলে তো তাদের আটকানো যায় না। সরকার তাদের ফিরিয়ে নেবে। পুশব্যাক করার দরকার পড়বে না।

মোমেন সাহেবের বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী অবসরপ্রাপ্ত স্বনামধন্য অফিসাররা বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, মোমেন সাহেব সঠিক কথাই বলেছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, মোদি সরকারের লজ্জা হওয়া উচিত পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একই আসনে বসানোর জন্য। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, যারা দেশের ও পৃথিবীর ইতিহাস-ভূগোল কিছুই জানে না, সেসব অর্ধশিক্ষিত লোকের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। একসময় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন দেব মুখার্জি। তিনি এই নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেছেন। তিনিও বলেছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে এক আসনে বসানো ঠিক হয়নি। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যামশরণ এবং আরেকজন পররাষ্ট্র সচিব সিব্বল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একমাত্র বন্ধু ছিল বাংলাদেশ। তারা সরাসরি মন্তব্য করেছেন- এ মুহূর্তে ভারতের কোনো পররাষ্ট্রনীতি নেই। যার ফলে তারা বারবার বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করছেন। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতের সংসদে বর্তমান শাসক দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি তাই তাদের কোনো অধিকার নেই নাগরিকত্ব বিল সংশোধনের মতো স্পর্শকাতর বিলটিকে সামনে নিয়ে আসা। এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত কমিটিতে এ বিলের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। এ বিল কেন আনা হলো তা বাংলাদেশের পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। তা হলো- ভোটব্যাংক, বাংলাদেশ থেকে গত ২০-২৫ বছরে মতুয়া সম্প্রদায় যারা পশ্চিমবঙ্গে এসেছে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলে নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদি-মমতা আশ্বস্ত করে গিয়েছিলেন। আর এই ভোটব্যাংক নিয়েই মমতা ও মোদির মধ্যে দড়ি টানাটানি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন মতুয়াদের ভোট দেওয়ার অধিকার দেননি। মমতা নয় বছর আগে ক্ষমতায় আসার আগেই মতুয়াদের মধ্যে নানা আশ্বাস দিয়ে প্রলুব্ধ করেন। ২০১৯-এর নির্বাচনে মমতার হাত থেকে সীমান্ত এলাকার ৫-৬টি লোকসভা আসন ছিনিয়ে নেয় বিজেপি। বারবার পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বাংলাদেশের মাগুরা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর প্রভৃতি এলাকায় গিয়ে মতুয়াদের আশ্বস্ত করেছেন। অর্ধশিক্ষিত এই দিলীপ ঘোষের নাম আমরা কখনো শুনিনি। তিনি পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস অফিসে একজন ছোট মাপের নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আরএসএসের লোক পাঠিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অফিস খোলা হয়েছে। যেসব জায়গায় অফিস খোলা হয়েছে তার অধিকাংশ লোকই মতুয়া। সংসদে নাগরিকত্ব বিল পাস হওয়ার পরই আরএসএস সীমান্ত জেলাগুলোয় হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন সৃষ্টি করছে। এরই প্রতিবাদে সারা দেশে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছেন। তাদের একটাই দাবি- নাগরিকত্ব বিল প্রত্যাহার করতে হবে।

সারা দেশের ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখালে আরএসএসের পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্রদের গুলি করতে দ্বিধা করেনি। তাই দেশজুড়ে গর্জে উঠেছে পড়–য়ারা। এমনকি বিজয় দিবসে দিল্লির জামিয়া-মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অমিত শাহের পুলিশ ঢুকে ছাত্রদের গুলি করেছে।

ছাত্রদের ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকা ভারতে নিষিদ্ধ। জামিয়া-মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমা আখতার তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশের গুলি চালনা নিয়ে বলেছেন, ‘এই বর্বরোচিত আচরণে আমি গভীরভাবে ব্যথিত। পুলিশ যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে লাইব্রেরিতে যারা পড়ছিল তাদের লাঠিপেটা করেছে, তা মানা যায় না। পড়–য়াদের বলছি তোমাদের সঙ্গে আছি। যত দূর যাওয়ার যাব। তোমরা একা নও।’ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথী এবং সাক্ষী আনন্দবাজার পত্রিকার বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) প্রথম সম্পাদকীয়তে লেখা হয়- ‘বাংলার মুখ।

আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস, সমগ্র দেশ পরিকীর্ণ হইবে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে উৎসবমুখর জনতার সমাবেশে। এই বৎসরের উদ্যাপন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-৭৫) জন্মশতবর্ষের সূচনা হইয়াছে এই বৎসরেই। দেশভাগ হেতু বাংলাদেশ এখন পৃথক ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। তথাপি এই প্রতিবেশী দেশটি লইয়া পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরও আগ্রহ ও উত্তেজনার অন্ত নাই। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আপাতত রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃথক দুই ভূখন্ডের সেতুবন্ধ, বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরও কম অবদান নাই। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখিয়াছিলেন, একজন বাঙালি হিসাবে যাহা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাহাই তাহাকে গভীরভাবে ভাবায়। সেই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস, বাংলা ও বাঙালির প্রতি অক্ষয় ডালপালা। এই ভালোবাসাই তাহার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করিয়া তুলিয়াছিল।’

বিজয় দিবসের কয়েকদিন ধরে মমতার অতিনাটকীয়তা দেখে কংগ্রেস ও বামপন্থিরা প্রশ্ন তুলেছেন- এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে মমতা যখন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন তখন কংগ্রেস ও সিপিএম তাঁর অতীত টেনে বলেছে, সাংসদ হিসেবে অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা দেওয়ার জন্য তিনি স্পিকারের গায়ে চাদর ছুড়ে মেরেছিলেন। বাবরি মসজিদ ভাঙা ও গুজরাট দাঙ্গার পর মমতা বিজেপির শরিক হয়ে মন্ত্রিসভায় ছিলেন। তাই পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস তাঁর ওপর আর নেই। তাই মতুয়া ও বাঙালি সংখ্যালঘুরা মমতার ওপর আর কোনো আস্থা রাখতে পারছেন না।

                লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

 

সর্বশেষ খবর